গাজা নিয়ে আরব পরিকল্পনায় সমর্থন বৃটেন ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালির

গাজা নিয়ে পাল্টাপাল্টি শান্তি পরিকল্পনা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের একতরফা শান্তি পরিকল্পনার পাল্টা শান্তি পরিকল্পনা দিয়েছেন আরব নেতারা।  তাদের এই পরিকল্পনায় সমর্থন দিয়েছে মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিজ (ওআইসি), বৃটেন এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশ। গাজাবাসীকে উৎখাত করে সেখানে ‘রিভেইরা’ গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। তার প্রস্তাবের বিপরীতে গিয়ে মিশরের নেতৃত্বে আরব জাহান নতুন পরিকল্পনা উত্থাপন করেছে। এই পরিকল্পনায় সমর্থন জানিয়েছেন বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। এই চারটি দেশ যৌথ এক বিবৃতিতে বলেছে, আরবদের উদ্যোগের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তারা। শান্তি পরিকল্পনাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ এক ইঙ্গিত বলে আরবদের উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন তারা। কিন্তু মিশরের গৃহীত শান্তিপরিকল্পনা মঙ্গলবার গ্রহণ করেছেন আরব নেতারা। তাদের পরিকল্পনা ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশ অনুমোদন করলেও প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরাইল ও ট্রাম্প।

আরবদের পরিকল্পনায় গাজাকে পুনর্গঠনে প্রয়োজন ৫৩০০ কোটি ডলার। এজন্য গাজাবাসীকে তাদের উপত্যকা ছাড়তে হবে না। ফলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শক্তিধর যুক্তরাষ্ট্র ও আরব জাহানের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক এক লড়াই শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে আরবদের, বিশেষত নির্যাতিত, নিপীড়িত গাজাবাসীর পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বৃটেন সহ ইউরোপের ওই দেশগুলো। সামনের দিনগুলোতে গাজাকে সমর্থনকারী দেশের তালিকা দীর্ঘ হতে পারে। অনলাইন আল-জাজিরা বলছে, গাজাবাসীর জন্য সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছে ইসরাইল। তাদেরকে ‘ভাতে মারবো, কাপড়ে মারবো, গুলি করে মারবো’- যেন এমন নীতিতে পৌঁছে গেছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির প্রথম দফা চলাকালেও তিনি গাজাবাসী, পশ্চিমতীরের ওপর হামলা চালিয়েছেন। রাফায় হত্যা করেছেন আরও দুই ফিলিস্তিনিকে।

গাজায় সপ্তাহব্যাপী চলছে ব্লকেড। এর ইতি ঘটানোর আহ্বান জানানো হচ্ছে জাতিসংঘসহ বিশ্ববাসীর পক্ষ থেকে। কিন্তু বৈশ্বিক সেই আহ্বানকে উপেক্ষা করছেন নেতানিয়াহু। এর কারণ, তিনি প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থন পেয়েছেন। এমনিতেই তাকে সমর্থন দিয়ে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি সমর্থন দিচ্ছেন ট্রাম্প। জো বাইডেন বলেননি গাজাবাসীকে উৎখাত করে সেখানে ‘রিভেইরা’ বানানো হবে। কিন্তু ট্রাম্প বলেছেন। তিনি বলেছেন, গাজাবাসীকে গাজা থেকে অন্য দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে। এতে আরও উজ্জীবিত নেতানিয়াহু। তার চোখেমুখে হাসি লেগেই আছে। কিন্তু বিবেক বিক্রি করে দেননি বৃটেন সহ ইউরোপের নেতারা। তারা দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছেন গাজাবাসীর ওপর কী নিষ্ঠুর, নৃশংস অত্যাচার, হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে এবং হচ্ছে। ফলে ট্রাম্পের ‘মিডল ইস্টার্ন রিভেইরা’ দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে ওআইসি, বৃটেন, ইউরোপের অনেক দেশ। এমন অবস্থায় গাজায় ওষুধ, খাদ্য সহ অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রের বিরুদ্ধে ইসরাইলের ব্লকেড তুলে নিতে ইসরাইলকে চারদিনের সময় বেঁধে দিয়েছে ইয়েমেনের হুতিরা।

 তারা সতর্ক করে বলেছে, যদি এর মধ্যে ব্লকেড তুলে নেয়া না হয় তাহলে নতুন করে নৌপথে অভিযান চালানো হবে। ওদিকে গাজার ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় দফা নিয়ে আলোচনার জন্য মিশরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে শনিবার আলোচনা করছিলেন হামাসের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল। গাজার ওপর থেকে ব্লকেড তুলে না নিলে, যুদ্ধবিরতি না করলে হামাসের হাতে এখন যে কয়েকজন জিম্মি আছেন, তাদেরকে হত্যা করার হুমকি দিয়েছে তারা। কমপক্ষে ৫০ জন মুক্ত জিম্মি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কাছে চিঠি লিখেছেন। তাতে গাজায় যুদ্ধবিরতি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়নের অনুরোধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, গাজায় এখনও যেসব জিম্মি আটক আছেন, তাদের মুক্তি নিশ্চিত করতে। শনিবার বিশ্বজুড়ে পালিত হয় নারী দিবস। এ দিন গাজার মিডিয়া অফিস থেকে বলা হয়েছে- এ পর্যন্ত যুদ্ধে কমপক্ষে ১২,৩১৬ জন ফিলিস্তিনি নারীকে হত্যা করেছে ইসরাইল।

ওদিকে গাজা উপত্যকায় এই পবিত্র রমজানে ইসরাইলের ব্লকেড অতিক্রম করেছে সাত দিন। ফলে গাজার নির্যাতিত মুসলিমরা খেয়ে না খেয়ে পালন করছেন পবিত্র রমজান। তাদের কাছে সাহায্য নেই, কোনো খাবার নেই, কোনো ওষুধও নেই। তারা হারিয়েছেন ঘরবাড়ি, আয়ের পথ। সবকিছু।  এমন এক পরিস্থিতিতে সমস্ত পণ্যের দাম আকাশ ছোঁয়া। এজন্য বাড়তি দামে পণ্য কেনার সামর্থ্য হারিয়েছেন গাজাবাসী। অসংখ্য ফিলিস্তিনি এই পরিস্থিতিতে পড়ে ইফতার করার মতো সামান্য খাবারও জোটাতে পারছেন না। তাদের ফুরিয়ে গেছে রান্নার গ্যাস। সামান্য কিছু জোগাড় করতে পারলেও তা সিদ্ধ করতে খুঁজে বেড়াতে হচ্ছে কাঠ। সব মিলে গাজায় মানবিক অবস্থা ধসে পড়েছে। তারা অখণ্ড অপেক্ষার সময় কাটাচ্ছে- কখন একটা সুসংবাদ শুনবে যে, সীমান্ত ক্রসিং খুলে দেয়া হয়েছে।

ওদিকে লন্ডনের বিগবেন টাওয়ার ফিলিস্তিনের পতাকা দিয়ে ঢেকে দিয়েছে এক ব্যক্তি। প্যালেস অব ওয়েস্ট মিনস্টারের পাশে এ সময় ওই ব্যক্তি আরোহন করে ফ্রি প্যালেস্টাইন বলে চিৎকার করতে থাকে। মেট্রোপলিটন পুলিশের এক মুখপাত্র বলেছেন, বিষয়টি নিরাপদ সমাপ্তির চেষ্টা করছেন তারা।

mzamin
গাজার অধিবাসীদের গাজা ছেড়ে চলে যাওয়ার আল্টিমেটাম দিয়েছেন কিছু মন্ত্রী । যদি তারা না যান, তাহলে গাজায় ‘নরকের দরজা’ খুলে দেবেন। এর আগে গত রোববার ইসরাইল সরকার জীবন রক্ষাকারী ত্রাণ ও অতি গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রিসহ সব পণ্য গাজায় সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। জোর যার মুল্লুক তার- পরিস্থিতি সর্বশেষ এমন পর্যায়ে এসে দাড়িয়েছে। এর কড়া নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘর মানবাধিকার বিষয়ক কমপক্ষে ২০ জন নিরপেক্ষা অধিকারকর্মী, বিশেষজ্ঞ। ওদিকে হোয়াইট হাউস নিশ্চিত করেছে যে, ১৯৯৭ সালের পর ইসরাইলি বংশোদ্ভূত মার্কিন জিম্মিদের মুক্তি ও গাজা যুদ্ধ বন্ধ করতে প্রথমবারের মতো সরাসরি আলোচনা হচেছ হামাসের সঙ্গে। এর আগে হামাসকে গাজায় সব ইসরাইলি জিম্মি মুক্তি দেয়ার শেষ সতর্কতা দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। উদ্ভূত এ পরিস্থিতিতে  ইসরাইল সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কড়া নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘের ওই বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া এবং গাজায় নরকের দরজা খুলে দেয়ার যে হুমকি দিয়েছে ইসরাইল, তা হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তির লঙ্ঘন। এতে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হয়। শান্তির প্রত্যাশা বিপন্ন হয়। বৃহস্পতিবার ওই বিশেষজ্ঞরা একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। এর আগে ইরাইলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিপরিষদ থেকে ঘোষণা দেয়া হয় যে, তারা যুদ্ধবিরতি চুক্তি থেকে সরে যেতে প্রস্তুত। অনেক মন্ত্রী প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন যে, যুদ্ধবিধ্বসত গাজাকে নরকের দরজায় পরিণত করা হবে। বিশেষজ্ঞরা বিবৃতিতে বলেন, তাদের এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনের ভয়াবহ লঙ্ঘন। একটি দখলদার বাহিনী হিসেবে ইসরাইলের আইনগত কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। নিশ্চিত করতে হবে পর্যাপ্ত খাদ্য সহায়তা, মেডিকেল সরঞ্জাম সরবরাহ ও সব রকম ত্রাণের প্রবাহ। বিবৃতিতে তারা আরো বলেন, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য, বিকলাঙ্গদের সাপোর্টসহ গুরুত্বপূর্ণ সব সেবাখাতকে অবরুদ্ধ করে মানবাধিকার সহায়তাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ইসরাইল। তাদের এসব কর্মকান্ড আন্তর্জাতিক ও মানবাধিকার বিষয়ক আইনের মারাত্মক লঙ্ঘন।  রোম স্ট্যাটু-এর অধীনে মানবতার বিরুদ্ধে একে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধ হিসেবে দেখা যেতে পারে। এসব নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞের মধ্যে আছেন ফ্রাসেস্কা আলবানিজ। তিনি দখলীকৃত ফিলিস্তিন ভূখন্ডের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ র‌্যাপোর্টিউর। মাইকেল ফাখরি। তিনি খাদ্য অধিকার বিষয়ক স্পেশাল র‌্যাপোর্টিউর। তারা মাঠপর্যায়ে পরিস্থিতি জাতিসংঘের কাছে তুলে ধরেন। নিরপেক্ষ এসব বিশেষজ্ঞ কাজ করেন স্বেচ্ছাভিত্তিতে। তারা জাতিসংঘের সদস্য নন এবং তাদের কাজের জন্য কোনো বেতনও পান না।



No comments

Powered by Blogger.