পথের চাঁদা কমেছে বাজারে আগের মতোই by সুদীপ অধিকারী
সরজমিন দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সবজি বোঝাই করে একের পর এক ট্রাক এসে থামছে কাওরান বাজারের ওয়াসা, জনতা টাওয়ার, প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স ভবন, ইত্তেফাক ভবনসহ বিভিন্ন রাস্তায়। কিছু গাড়ি আবার প্রধান সড়কে পার্কিং করে সেখান থেকে ভ্যানে করে আড়তগুলোতে পণ্য নিয়ে আসছে। এমনই এক গাড়ির চালক মো. সাগর। তিনি নীলফামারীর সৈয়দপুর থেকে সবজি বোঝাই করে কাওরান বাজারের আড়তে নিয়ে এসেছেন। সাগর বলেন, ৫ই আগস্টের আগে আমার এই ট্রাকটি কাওরান বাজার আসতে পাগলাপীর বাজার, বালাবাড়ী হাইওয়ে পুলিশ তল্লাশি চৌকি, সৈয়দপুর উপজেলা শহর, রংপুর নার্সিং কলেজ এলাকা, রংপুর-বগুড়া মহাসড়কের শঠিবাড়ী, গোবিন্দগঞ্জ, মোকামতলা, বগুড়ার প্রথম বাইপাস, মাটিডালি, চারমাথা, ভবেরবাজার, হাটিকুমরুল, টাঙ্গাইল, এলেঙ্গা, মীরেরবাজারসহ অন্তত ১৪ স্থানে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হতো। কিছু কিছু স্পটে মাসিক চুক্তি ছিল। নির্দিষ্ট মোবাইল ব্যাংকিং নম্বরে মাসে ২ থেকে ৪ হাজার টাকা দেয়া লাগতো। পুলিশ থেকে রাজনৈতিক নেতা সকলে ওই টাকার ভাগ পেতো। তবে এখন আর পথে আগের মতো চাঁদা দেয়া লাগছে না। সাগরের মতোই চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থেকে সবজির ট্রাক নিয়ে এসেছেন রায়হান। সড়কে চাঁদাবাজির বিষয়ে তিনি বলেন, এখন পথে গাড়িতে কোনো চাঁদা দেয়া লাগে না। আগে যার কাছ থেকে যেমন পারতো চাঁদা নিতো। গাড়ি আটকালেই চাঁদা দেয়া লাগতো। একটা ট্রিপ নিয়ে ঢাকায় আসতে আগে ১ হাজার থেকে ১৫শ’ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দেয়া লাগতো। হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। চাঁদা না দিলেই গাড়ির গ্লাস ভেঙে দিতো। ২-৩শ’ টাকার জন্য ৮-১০ হাজার টাকার গ্লাস ভেঙে দেবে বলে কেউ কিছু বলতো না। এ ছাড়া পুলিশের উৎপাত তো ছিলই। যেই জেলা পার করতাম সেসব হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির নামে চাঁদা নেয়া হতো। রাতে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশির নামেও টাকা আদায় করা হতো প্রতি গাড়ি থেকে। এখন এসব বন্ধ হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় আছে, তবে আগের মতো না। তিনি বলেন, মাঝে কিছুদিন বন্ধ থাকলেও এখন আবারো কাওরান বাজারে সিটি করপোরেশনের গাড়ি পার্কিংয়ের নামে ২০০-৩০০ টাকা চাঁদা নেয়া হচ্ছে। এই টাকা না দিলে কেউ কাওরান বাজারে গাড়ি ঢোকাতে পারে না। সুমন নামে আরেক ট্রাকচালক বগুড়া থেকে সবজি নিয়ে নিয়মিত আসেন ঢাকাতে। সড়কের চাঁদাবাজির বিষয়ে তিনি বলেন, আগে পুলিশের নামে, শ্রমিক ইউনিয়নের নামে, মালিক সমিতির নামে, সিটি করপোরেশন, পৌরসভার নামে, এই টোল, ওই টোল বিভিন্ন বাহানায় চাঁদা নেয়া হতো। রাতে রাস্তায় মাঝে মধ্যে পুলিশের লোক আমাদের চোখে টর্চলাইট, লেজার লাইট মেরে সিগন্যাল দিতো। কোথাও কোথাও লাল পতাকা বাঁধা লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতো। মালবাহী ট্রাক দেখলেই ডাউন দিতো, দৌড়ে চলে আসতো। তাদেরকে টাকা না দিয়ে কেউ গাড়ি নিয়ে যেতে পারতো না। তিনি বলেন, ঢাকায় ঢোকার পরও শ্যামবাজারে মাল নামিয়ে কাওরান বাজারে আসতে আসতে এই সাত কিলোমিটার রাস্তায় তিনটি স্থানে চাঁদা দেয়া লাগতো। তবে পট পরিবর্তনের পর থেকে সড়কের মোড়ে মোড়ে চাঁদা নেয়া বেশির ভাগই বন্ধ আছে। তবে এখনো যাত্রাবাড়ী ও কাওরান বাজারে সিটি করপোরেশনের নামে স্লিপ দিয়ে টাকা নেয়া হয়। সড়কের চাঁদা নেয়া বন্ধ ও তেলের দাম কম হওয়ায় ট্রাক ভাড়া কমেছে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ট্রাক ভাড়া সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করেন ট্রাকের মালিকরা। আর তেলের দাম কমেছে সীমিত। তাই পণ্য পরিবহনে ভাড়া আগের মতোই আছে। সাগর, রায়হান, সুমনের মতো সাতক্ষীরা থেকে নিয়মিত কাওরান বাজারে সবজি নিয়ে আসেন ইসরাফিল হোসেন। তিনি বলেন, আগে সাতক্ষীরা থেকে শুরু করে খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, ঢাকা পর্যন্ত কয়েকটি স্পটে রাস্তায় চাঁদা দেয়া লাগতো। পুলিশও টাকা নিতো। তিনি বলেন, কেউ যদি রাতে সবজির ট্রাকে ঢাকায় আসতো সে বুঝতো কোথায় কোথায় চালকদের টাকা দেয়া লাগতো। আর ওসব চাঁদাবাজের যে কি খারাপ ব্যবহার তা শুধু আমরাই জানি। তিনি বলেন, আল্লাহ্র রহমতে এখন আপাতত তেমন একটা চাঁদা দেয়া লাগছে না। পুলিশেরও ঝামেলা নেই। তবে এমন কতো দিন থাকবে তার নিশ্চয়তা নেই।
এদিকে মিরাজ সহ কাওরান বাজারের একাধিক আড়তদার বলেন- রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাট, ময়মনসিংহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, যশোর, ফরিদপুর, মাদারীপুর, সাভারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানভর্তি আলু, পিয়াজ, পেঁপে, মিষ্টি কুমড়া, টমেটো, মুখিকচু, ফুলকপি, মরিচ, গাজর, বেগুন, ধনেপাতা, শসা, করলা, লাউসহ বিভিন্ন শাক-সবজি আমাদের বাজারে আসে। এ ছাড়াও পাহাড়ি এলাকা থেকে আনারস, কলা সহ বিভিন্ন ফলমূল আসে আমাদের আড়তে। যারা নিয়মিত আড়তে মাল নিয়ে আসেন তারা ক্ষেত থেকে সবজি সংগ্রহের আগে আড়তদারদের ফোন দিয়ে জেনে নেন বাজারদর। তারপর পণ্য ট্রাকে করে রাতে কাওরান বাজারে নিয়ে আসেন। এখানে আসার পর প্রথমে ট্রাকপ্রতি পার্কিং বাবদ ২-৩ শ’ টাকা দেয়া লাগে। এরপর ট্রাক থেকে মাল নামাতে গাড়ি প্রতি ২৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা লেবার খরচ দিতে হয়। আর ভ্যানে মাল নামলে সেই খরচ আলাদা। এরপর যেই আড়তের মাধ্যমে মাল নামাবে সেই আড়তের মালিককে লাখে ১০ হাজার অর্থাৎ একশ’ টাকার মাল নিয়ে আসলে আড়তদারকে ১০ টাকা খরচ দিতে হবে। লাভ-লসের হিসাব পড়ে। এই খরচগুলো দেয়ার পর মাল বিক্রি করে যা বাঁচবে সেটাই পাবে ব্যাপারী। মাল বিক্রি হোক আর না হোক সবজির ট্রাক ঢুকলে এই খরচগুলো দেয়াই লাগবে। আর কেউ যদি সম্পূর্ণ মাল একবারে আড়তদারের কাছে বিক্রি করে দেয় তাকেও এই খরচ দেয়া লাগে। আবার হাতে কেটে অর্থাৎ নিজের মাল নিজে বিক্রি করবে তাকেও এই খরচ দিতে হয়। কারণ আড়তদারের বাইরে কেউ কাওরান বাজারে পণ্য বিক্রি করতে পারে না। বিশ বছর আগে যেই নিয়ম ছিল এখনো তাই আছে। সবই আগের মতোই চলছে।
No comments