‘আমি কীভাবে খেলছি, এটা আল্লাহ্‌ই জানেন’ by সৌরভ কুমার দাস

১৮ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে চাপ সামলে ভালো খেলার অসংখ্য উদাহরণ আছে সাকিব আল হাসানের। মাঠের বাইরে নানাকাণ্ডে সমালোচিত হলেও মাঠে ঠিকই দারুণ পারফর্ম করেন তিনি। তবে এবার পরিস্থিতিটা কল্পনার বাইরে চলে যায়। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নিজে সংসদ সদস্য পদ হারান। এরপর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত এক পোশাককর্মী হত্যা মামলার আসামিও করা হয় তাকে। এসব মাথায় নিয়ে খেলা সাকিব এবার তাই বলেই বসলেন, আমি কীভাবে খেলা চালিয়ে যাচ্ছি- এটা আল্লাহ্‌ই জানেন। দেশে যখন সরকার পতন হয় সাকিব তখন কানাডায় গ্লোবাল লীগ খেলছেন। এরপর পাকিস্তানে জাতীয় দলের শিবিরে যোগ দেন সরাসরি। দেশে এত ঘটনা পিছনে রেখে মাঠে খেলার প্রসঙ্গে সাকিব বলেন, ‘পুরোপুরি ভিন্ন চিত্র। দেশে অনেক কিছু বদলে গেছে, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে কেমন খেলছি, কেমন প্রস্তুতি নিচ্ছি, পাকিস্তানে কেমন খেলছি। ভাগ্য ভালো ছিল, ভালো ফল করেছি, যেমন ফলাফল চেয়েছি।’ বাংলাদেশ ক্রিকেটে প্রায় সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন সাকিব সবচেয়ে ভালো চাপ সামলাতে পারেন। সেই সাকিবও এবার বোধহয় কিছুটা চাপ স্বীকার করলেন। গতকাল কানপুরে সংবাদ সম্মেলনে সাকিব বলেন, ‘কঠিন, খুবই কঠিন। আমি কীভাবে খেলা চালিয়ে যাচ্ছি এটা আল্লাহ্‌ই জানেন। আমিও জানি না আসলে (হাসি)। যেটা বললেন যে একটা মামলা হয়েছে, আসলে সবারই অধিকার আছে। কিন্তু আপনারা সবাই জানেন, এটা কেমন ধরনের মামলা ছিল কিংবা আমি ওই সময় কোথায় ছিলাম। আমার কাজ কী ছিল কিংবা আমি কী করছিলাম। সুতরাং এ বিষয়টা নিয়ে খুব বেশি বলতে চাই না।’ দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড় ও সবচেয়ে সমালোচিত ক্রিকেটার কে? দুটো প্রশ্নের উত্তরে যে কেউ এক বাক্যে সাকিব আল হাসানের নামই উচ্চারণ করবেন। একই সঙ্গে নন্দিত এবং নিন্দিত- দেশের সবচেয়ে বড় তারকাকে নিয়েই এটা সবচেয়ে সেরা একবাক্যের সারাংশ। সেই সাকিবের পথচলা শেষ হয়েছে টি-টোয়েন্টিতে, আগামী মাসে ফুলস্টপ পড়বে টেস্টেও। সাকিবের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ক্যারিয়ার শুরু ২০০৬ সালে। দারুণ সম্ভাবনাময় অলরাউন্ডার হিসেবে জাতীয় দলে আবিভার্ব হয় তার। এরপর ধীরে ধীরে দেশ তো বটেই বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার হয়ে ওঠেন সাকিব। পরিসংখ্যান ধরলে তো নিজ যুগের সেরা অলরাউন্ডার। ক্রিকেট ইতিহাসের একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে তিন ফরম্যাটেই একসঙ্গে শীর্ষ অলরাউন্ডার ছিলেন সাকিব। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে এই কীর্তি গড়েন তিনি। এরপর নানা সময়ে আবার একসঙ্গে ফিরেছেন, তবে চলতি বছরের আগে কখনও কোনো ফরম্যাটে পাচের নিচে নামেননি। ২০০৬ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচে অভিষেক হয় সাকিব আল হাসানের। এরপর গত ১৮ বছরে বাংলাদেশের জার্সিতে খেলেছেন ১২৯ ম্যাচ। যেখানে তার শিকার ১৪৯ উইকেট। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আর বিশ্ব ক্রিকেটে তৃতীয় সর্বোচ্চ। ব্যাট হাতে এই ফরম্যাটে রান করেছেন ২৫৫১, যেটা টাইগার জার্সিতে সর্বোচ্চ। এই সংস্করণে তার ১৩ ফিফটিও বাংলাদেশের সর্বোচ্চ। ১২বার টি-টোয়েন্টিতে ম্যাচসেরা হয়েছেন সাকিব, এটাই বাংলাদেশের সেরা। সর্বোচ্চ ভারতের সূর্যকুমার যাদব ১৬বার। বাংলাদেশের দ্বিতীয় সেরা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ৫বার। এই সংস্করণে সাকিবের টুর্নামেন্ট সেরার সংখ্যা ৫। যেটা বিশ্ব ক্রিকেটে ৪জনের সঙ্গে যৌথভাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তিন সংস্করণ মিলে সেটা ১৭ বার, এটা বাংলাদেশের সেরা। গেল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ফিফটি করেন সাকিব। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ১০০তম আন্তর্জাতিক ফিফটি এটা। আর বিশ্ব ক্রিকেটে ১৯তম। ভারতের রোহিত শর্মা আর সাকিবই একমাত্র ক্রিকেটার যারা সব টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলেছেন। এই ফরম্যাটে অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে খেলার রেকর্ড শুধুই সাকিবের। ২০০৬-এর ২৮শে নভেম্বর থেকে ২০২৪-এর ২৪শে মার্চ পর্যন্ত ১৭ বছর ২০৯ দিন আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলেছেন বাংলাদেশের এই বাঁহাতি স্পিনিং অলরাউন্ডার। টি-টোয়েন্টিতে দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি ৪৩ বিশ্বকাপ ম্যাচ খেলার রেকর্ডও সাকিবের। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি উইকেটও তার, ৫০টি। ইতিহাসের প্রথম ও একমাত্র অলরাউন্ডার হিসেবে টি-২০তে এক হাজার রান পাওয়ার পাশাপাশি ১০০ উইকেট শিকারি সাকিব। স্বীকৃত টি-২০ ফরম্যাটে কোনো একটি ভেন্যুতে সবচেয়ে বেশি উইকেট সাকিবের। মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে সাকিবের শিকার ১৭৪ উইকেট। সাকিবই একমাত্র ক্রিকেটার, যার দুই ধরনের (ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি) বিশ্বকাপেই কমপক্ষে ৮০০ রান ও ৪০ বা তার বেশি উইকেট আছে। পাঁচবার ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলা সাকিবের রান ১৩৩২, উইকেট ৪৩টি। আর মাত্র দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসাবে (অন্যজন ভারতের রোহিত শর্মা) সব কটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলা সাকিবের এই প্রতিযোগিতায় রান ৮১৭, উইকেট ৪৩টি। টেস্ট ক্রিকেটে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাকিবকে নিয়মিত না দেখার আক্ষেপ আছে সমর্থকদের। তিনিও নিজেও টেস্টের প্রতি খুব বেশি আগ্রহী কিনা এটা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তবে রাজকীয় এই ফরম্যাটেও সাকিবের রেকর্ডের বই বেশ সমৃদ্ধ। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাটিতে জয়, তার অধিনায়কতে ওয়েস্ট ইন্ডিজে প্রথমবার সিরিজ জয়সহ আছে নানা রেকর্ড, মাইলফলক। বাংলাদেশের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭০টি টেস্ট খেলেছেন সাকিব। সর্বোচ্চ মুশফিকুর রহিমের ৯১ ম্যাচ। এই ফরম্যাটে তার রান ৪৬০০। যেখানে ৫টি সেঞ্চুরি রয়েছে। সর্বোচ্চ ইনিংস ২১৭ রানের। এর বাইরে বল হাতে ২৪২ উইকেট শিকার করেছেন সাকিব। ১৯ বার শিকার করেছেন ৫ উইকেট। যেটা দেশের হয়ে সর্বোচ্চ। আগামী মাসে মিরপুরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এই ফরম্যাটে শেষ ম্যাচ খেলতে চান সাকিব। যেখানে তিন ফরম্যাট মিলিয়ে রেকর্ড ২৫২ উইকেট আছে এই বাঁহাতি স্পিনারের। এখানে সর্বোচ্চ রানও সাকিবের। তিন সংস্করণ মিলে ১৪১ ম্যাচে করেছেন ৪ হাজার ৬৭৭ রান। টেস্টে সবচেয়ে কম ম্যাচ ৫৪ খেলে ৩,০০০ রান এবং ২০০ উইকেট নেন এই অলরাউন্ডার। পঞ্চম ক্রিকেটার হিসেবে তিনি এ কীর্তি গড়েন। এই ফরম্যাটে টেস্টে সবচেয়ে কম ১৯৯ ম্যাচে ৫,০০০ রান  ও ২৫০ উইকেট পাওয়া ক্রিকেটার। পঞ্চম ক্রিকেটার সাকিব। বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সে টেস্টে নেতৃত্ব দেন সাকিব। ২০০৯-এর ১৭ই জুলাই গ্রেনাদার সেন্ট জর্জেস গ্রাউন্ডে ২২ বছর ১১৫ দিন বয়সে টেস্টে অধিনায়ক সাকিবের অভিষেক হয়। এই রেকর্ড গড়ার পথে সাকিব ভাঙেন মোহাম্মদ আশরাফুলের রেকর্ড। ২০০৭-এর ২৫শে জুন কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবে শ্রীলংকার বিপক্ষে ২২ বছর ৩৫৩ দিন বয়সে টেস্টে অধিনায়ক হন আশরাফুল। টেস্টে একই ম্যাচে সেঞ্চুরি আর ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তি আছে সাকিবের দুবার। বাঁহাতি স্পিনারদের মধ্যে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক উইকেট সাকিবের। তিন সংস্করণ মিলিয়ে ৪৮২ ইনিংস বোলিং করে ৭০৭ উইকেট নিয়েছেন সাকিব।  দুইয়ে থাকা নিউজিল্যান্ডের ড্যানিয়েল ভেট্টোরির তিন সংস্করণ মিলিয়ে ৪৯৮ ইনিংসে ৭০৫ উইকেট। পেস ও স্পিন মিলিয়ে বাঁহাতি বোলারদের মধ্যে তিনে আছেন তিনি। ৯১৬ উইকেট নিয়ে শীর্ষে আছেন পাকিস্তানি কিংবদন্তি বাঁহাতি পেসার ওয়াসিম আকরাম। সাকিবের ওপর থাকা শ্রীলঙ্কার চামিন্দা ভাসের উইকেট ৭৬১টি।
mzamin

No comments

Powered by Blogger.