সাভারে দখলের হাত বদল, সংঘাত by শরিফ রুবেল

শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরে অশান্ত হয়ে উঠেছে সাভার ও আশুলিয়া। ইন্টারনেট, ডিশ, ফুটপাথ, বাসস্ট্যান্ড, ঝুট ব্যবসা, কুলিবিট, হাট-বাজার, জমি দখল নিয়ে গ্রুপ-উপগ্রুপের মধ্যে লড়াই চলছে। ইতিমধ্যে গার্মেন্টস ঝুট ব্যবসা দখলকে কেন্দ্র করে এক গ্রুপের সঙ্গে আরেক গ্রুপের হামলা, ভাঙচুর, মারধরের ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনায় একাধিক মামলাও হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিদিনই বিভিন্ন শিল্পকারখানায় হানা দিচ্ছেন তারা। কেউ কেউ আবার শ্রমিকদের মাঠে নামিয়ে ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। ক্ষমতার পালাবদলের পরপরই বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা ব্যবসাগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। গত ১৫ বছর ধরে এসব নিয়ন্ত্রণ করতেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

গত ৫ই আগস্টের পর থেকে পটপরিবর্তন শুরু হয়। সাভার উপজেলার সবচেয়ে আলোচিত দখল ও চাঁদাবাজির স্পট হেমায়েতপুর, আশুলিয়া, সাভার সদর ইউনিয়ন। এসব জায়গায় দখলবাজির চিত্র ও এর পেছনে কারা নেতৃৃত্ব দিচ্ছেন সরজমিন ঘুরে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে।

সবচেয়ে বেশি দখলবাজি হেমায়েতপুরে: ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরে সাভার উপজেলার প্রথম দখলবাজি, চাঁদাবাজি, মারধর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও গার্মেন্টস নিয়ন্ত্রণ শুরু হয় হেমায়েতপুরে। ৭ই আগস্ট থেকে ৩১শে আগস্ট পর্যন্ত হেমায়েতপুরের সকল ফুটপাথ, ভ্রাম্যমাণ মার্কেট, কুলিবিট, বাসস্ট্যান্ড, বাজার-ঘাট, স্কুল-কলেজ, মসজিদ কমিটি, গার্মেন্টস ঝুট, হাউজিং ব্যবসা দখলে নেন স্থানীয় আন্তঃজেলা ট্রাকচালক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন ৭নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সভাপতি মোশারফ হোসেন মুশা। গত ১৫ বছর হেমায়েতপুরের এসব স্পট একক নিয়ন্ত্রণ করতেন সাভার উপজেলা চেয়ারম্যানের ভাই ফখরুল আলম সমর। তবে রাজিব সমর পতনের পরে দখল হাত বদল হয়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে, মুশা ও তার ৫ ভাই মিলে পুরো হেমায়েতপুর একক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। নিজস্ব বাহিনী দিয়ে ব্যবসায়ীদের ওপর হামলা করে বর্তমানে হেমায়েতপুরে দখলবাজি ও চাঁদাবাজিতে মূর্তিমাণ আতঙ্কের নাম মোশারফ হোসেন মুশা। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দখলে বাঁধা দিতে  গেলে স্থানীয় কয়েকজনকে বেধড়ক মারধর ও কুপিয়ে জখম করেন মুশার লোকজন। এদের মধ্যে এস আলম কাউন্টার মাস্টার হাসমত, আরিফ, ফিট ব্যবসায়ী আশরাফুল ইসলাম, মেহেদি, আব্দুল মজিদ মারধরের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন।

সরজমিন দেখা গেছে, হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ডে এক্সিম ব্যাংক থেকে এনআরবি ব্যাংক পর্যন্ত সিংগাইর সড়কে কয়েকশ ভ্রাম্যমাণ দোকান রয়েছে। এসব দোকান থেকে প্রতিদিন ৩শ’ থেকে ৫শ’ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। টাকা তোলেন মোশারফের  লোকজন। হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ডের উত্তর পাশে জয়নাবাড়ি সড়কে ও হেমায়েতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের জমিতে নির্মিত মার্কেটে শতাধিক দোকান রয়েছে। এসব দোকান থেকে প্রতিদিন ২শ থেকে ১ হাজার টাকা তোলা হয়। স্কুলের নাম করে এসব চাঁদা তোলা হলেও পুরোটাই মোশারফের পকেটে চলে যায়। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি বিলুপ্ত করলেও হেমায়েতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি গঠন করে সভাপতি বনে গেছেন মোশারফের ভাই শরিফ ইসলাম। হেমায়েতপুর এলাকার লক্ষাধিক ইন্টারনেট ও ডিশ সংযোগ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন মোশারফ ও তার ভাই রকিব, রাসেল। শুধু ডিশ ইন্টারনেটই নয়, পোশাক শিল্পের অস্থিরতার মধ্যেই সম্প্রতি মোশারফের ভাই শরিফের নেতৃত্বে দলবল নিয়ে আমিনবাজার এলাকার টিমটেক্স গার্মেন্টসের ঝুট ব্যবসা দখল করে। এ ছাড়াও তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের এজেআই গ্রুপ, ডেকো গ্রুপসহ আরও বেশকিছু কারখানার ঝুট দখলের পাঁয়তারা শুরু করেছে মোশারফ বাহিনীর লোকজন। ওই কারখানা থেকে মানববন্ধনও করা হয়েছে। মুশার ছোট ভাই ইউনিয়ন বিএনপি সহ-সভাপতি মেহেদি হাসান, শরিফ ইসলাম, রাকিব হাসান, রাসেল, রাকিব, আরিফ। একসময় হেমায়েতপুরের  ডিস ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন জাকির হোসেন। এখন সেই ব্যবসা দখলে নিয়েছেন  ইউনিয়ন বিএনপি’র সহ-সভাপতি মেহেদি হাসান। ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন রাজিব। এখন তা নিয়ন্ত্রণ করেন রাসেল। স্থানীয়রা বলেন, প্রতিদিন দুপুর  ও সন্ধ্যায় নিজস্ব বাহিনী নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে মহড়া দেন মোশারফ। আগে বর্জ্য পরিচ্ছন্নতার কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন আনিস আহমেদ এখন তা নিয়ন্ত্রণ করেন রাসেল, রাকিব, শরিফ, মোশারফ। বাদল হোসেন নামের এক ফুটপাথ দোকানি বলেন, মোশারফের লোকজন দিনের বেলায় চাঁদামুক্ত করতে মাইকিং করেন, আবার সন্ধ্যা হলে তারাই দোকানপাট থেকে চাঁদা তোলেন। তারা সমর চেয়ারম্যানের হাউজিং দখল করে নেন। সেখানে শতকোটি টাকার প্লট আছে। ২০ আগস্ট তারা দলবেঁধে গিয়ে হলমার্কের কোটি কোটি টাকার মালামাল ট্রাক ভরে লুট করে নিয়ে এসেছে। হলমার্কের ম্যানেজার প্রতিবাদ করলে তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়। অভিযোগের বিষয়ে  মোশারফ হোসেন মুশা মানবজমিনকে বলেন, আমার পরিচিতজন ও আত্মীয়স্বজনরা দখলবাজি করলে সেই দায় আমি নিতে পারবো না। আমার নাম করে অনেকে এই কাজ করছে। আমি কোনো চাঁদাবাজি ও দখলবাজির সঙ্গে জড়িত নই। ফুটপাথের চাঁদাবাজি বন্ধে আমি মাইকিং করেছি। আমি কেন ফুটপাথে চাঁদা তুলতে যাবো? আর গার্মেন্টসের ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আমার ভাই মেহেদির যে ভিডিও বের হয়েছে সেটা ভুল বোঝাবুঝি  থেকে হয়েছে। এজে গার্মেন্টস স্বেচ্ছায় আমাদের ঝুট দিচ্ছে। আমি ব্যাবিলন গার্মেন্টসে গেছিলাম। তারা ঝুট দিতে রাজি হয়নি, চলে এসেছি। আমি হলমার্কের মালামাল লুট করিনি। তবে আমার আত্মীয়স্বজন এর সঙ্গে জড়িত আছে। এই দায় আমি নিবো না।

সাভারে যেভাবে দখল চলছে: সাভার সদর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পাশাপাশি চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠছে বিএনপি’র নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। সাভারের ইসলামনগরে ডিশ ব্যবসা করে আসছিলেন শামসুল হক নামের এক ব্যক্তি। তিনি অভিযোগ করেন, ৬ই আগস্ট পাথালিয়া ইউনিয়ন যুবদলের নেতা ইকবাল কবির, আহসানুল্লাহসহ নেতাকর্মীরা তার প্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে দেন। এরপর থেকে বিলও তারাই তুলছেন। ১৩ই আগস্ট কবির মুঠোফোনে তাকে হত্যার হুমকিও দিয়েছেন। সাভারের ছোট বলিমেহের মৌজায় সফুরা বেগম ও রোকেয়া বেগমের কাছ থেকে ২০১০ সালে ৫ শতক ও ২০১২ সালে ৫ শতক জমি কেনেন আবুল কালাম আজাদ, জিয়াউল ইসলাম ও ফিরোজা বেগম নামের তিনজন। আবুল কালাম আজাদ বলেন, ওই জমির খাজনা, পৌরকর, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল পরিশোধ করেছেন তারা। ২০২১ সালে ভবন নির্মাণের জন্য রাজউকের কাছ থেকে নকশা অনুমোদনও পেয়েছেন। ক্ষমতা পালাবদলের পর ধামরাই পৌর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মো. মাছুম আহম্মেদসহ আগের মালিকদের কয়েকজন আত্মীয়স্বজন ওই জমির সীমানা দেয়ালের ফটকের তালা ভেঙে ফেলেছেন। সর্বশেষ ১৮ আগস্ট টিনের একটি ছাপরাঘর তুলে জমি দখলের চেষ্টা করছেন। এই এলাকার ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম  মোস্তফা।

আশুলিয়ায় ইপিজেডের ঝুট নিয়ে অস্থিরতা: সাভারের সবচেয়ে বেশি গার্মেন্টস কারখানা আশুলিয়া এলাকায়। আশুলিয়া ইপিজেডে প্রায় ৬০টি কারখানার ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিতে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের মধ্যে একাধিকবার হামলা মারধরের ঘটনা ঘটেছে। তবে এখনো কেউ এককভাবে এই এলাকার ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি। সরকার পতনের আগে আশুলিয়ার ঝুট ব্যবসা পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম। তবে সাইফুল পালিয়ে যাওয়ার পরে তিনি কৌশলে ঝুট ব্যবসার পুরো নিয়ন্ত্রণ দিতে চান ঢাকা জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব খানকে। তবে এতে আব্দুল গফুর গ্রুপের সঙ্গে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। এ নিয়ে দেড় মাস ধরে অস্থিরতা চলছে আশুলিয়ার রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড)। বিএনপি ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নাম ব্যবহার করে এরই মধ্যে ঝুট ব্যবসার দখল নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে একটি গ্রুপ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর স্থানীয় কয়েকজন নেতা ও তাদের ক্যাডার বাহিনী অন্তত ৫০টি কারখানা দখলের চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে। দখল করতে গিয়ে ইপিজেডের মধ্যেই দু’পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ই আগস্টের পর ইপিজেডের ঝুট ব্যবসা দখলে নিতে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে যাচ্ছেন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর ভূঁইয়া গ্রুপ ও আইয়ুব খান গ্রুপ। এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে ঠেকাতে কারখানা থেকে বহির্গামী মালবাহী গাড়িগুলো আটকে দিচ্ছে। ৮ই আগস্টের পর থেকে সাসা, সিকেডিএল, হোপলং, ওয়াইকেকে ও শান্তা নামক ফ্যাক্টরিতে বিশৃঙ্খলা, হুমকি, মালপত্র আটকে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ৫ই আগস্টের পর থেকে বিএনপি নেতা মনিরের নেতৃত্বে ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে বাক্সটার, ব্রেন্টন, চেরি, ইয়ংওয়ান, ঢাকারিয়া, এফসিআই, তালিসমা, প্যাডক্স ও পেক্সার কারখানায়। মনিরের সঙ্গে এই গ্রুপে রয়েছে তাদের বোনের স্বামী মিজানুর রহমান মিজান। মিজানের নেতৃত্বে আলিম, সমির, ফারুক, সোহরাব, মাহবুব, শিমুল ও রুবেলসহ (ভাইগনা রুবেল) অন্তত ৫০ জনের গ্রুপ ইপিজেডে বিভিন্ন দখলবাজিতে কাজ করছে। এর মধ্যে রুবেলের নেতৃত্বে ইপিজেডের গেটে তিন ট্রাক মাল ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আগস্টের শেষে ইয়াংঅন থেকে ঝুট বের করার সময় গেটে রুবেলসহ ২০ থেকে ৩০ জনের একটি গ্রুপ ট্রাক তিনটি ছিনতাই করে নিয়ে যায়। আশুলিয়ার বারইপাড়ায় রোজ ইন্টিগ্রেটসের ঝুট ব্যবসা দখলে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে আইয়ুব খানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত শিমুলিয়া ইউনিয়ন বিএনপি’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. রুবেল শেখ, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সদস্য মো. শামীম, যুবদলকর্মী নূর ইসলামের বিরুদ্ধে। তারা একই এলাকার তানজিলা টেক্সটাইল লিমিটেডের ঝুট ব্যবসাও দখলে নিয়েছেন। এ ছাড়া কবিরপুরে ইউরো আর্তে অ্যাপারেলস লিমিটেড নামের কারখানার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিতে একটিপক্ষ চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।  

এ ব্যাপারে গফুর ভূঁইয়া বলেন, আমি কোনো ঝুট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নই। আমার নিজেরই গার্মেন্টস আছে। আইয়ুব খানের সাথে আমার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি ভিত্তিহীন বলে তিনি মন্তব্য করেন।

No comments

Powered by Blogger.