জৌলুস হারাচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত by ওয়াহিদুর রহমান রুবেল

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার ঘিরে গড়ে উঠেছে পর্যটন শিল্প। এ শিল্পের বিকাশ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় নানা পরিকল্পনার কথা বলা হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। কার্যত তা বক্তব্যে সীমাবদ্ধ রয়ে যায়। আর সুপরিকল্পিত কর্মপন্থা না থাকা ও সৈকত রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় জৌলুস হারাচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত। রয়েছে সাগরের আগ্রাসন আর প্রভাবশালীদের দখলদারিত্ব। এ অবস্থায় পর্যটন শিল্প রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছে সচেতন মহল।

এদিকে বড় কোনো আয়োজন না থাকলেও আজ শুক্রবার র‌্যালি, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কক্সবাজারে পালিত হবে বিশ্ব পর্যটন দিবস। পর্যটক না আসায় হোটেল-মোটেলগুলোতেও আয়োজন করা হয়নি কোনো অনুষ্ঠান।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আতাউল গনি ওসমানী বলেন, পর্যটন দিবস সামনে রেখে গতকাল বৃহস্পতিবার রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে শিশু একাডেমি। সৈকতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম করে পৌরসভা। আজ শুক্রবার সকাল ৯টায় সুগন্ধা পয়েন্ট থেকে একটি বর্ণাঢ্য র‌্যালি বের করা হবে। এটি লাবনী পয়েন্টে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। সন্ধ্যায় স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে লাবনী পয়েন্টের ওপেন মঞ্চে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন রয়েছে। অক্টোবরের শেষের দিকে প্রতি বছরের মতো এবারও কার্নিভালের আয়োজন করা হবে।

তথ্য বলছে, কক্সবাজারে ঘুরে বেড়ানোর প্রধান স্পট সমুদ্রসৈকত। দেখার জন্য রয়েছে রাখাইন সম্প্রদায়ের বৌদ্ধ মন্দির ও প্যাগোডা, ধাতু ও ব্রোঞ্জের তৈরি বুদ্ধমূর্তি, ছোট-বড় ১৩টি বুদ্ধমূর্তি নিয়ে লাল সিং ও পাশে সাদা সিং নামের বৌদ্ধবিহার, বৈচিত্র্যময় জীবনধারা, ডুলাহাজারার বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির, সোনাদিয়া দ্বীপ, কুতুবদিয়া দ্বীপ, চকরিয়া ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক, হিমছড়ি ঝরনা। রয়েছে দেশের একমাত্র ফিশ অ্যাকুয়ারিয়াম।

অভিযোগ রয়েছে, এসব পর্যটন স্পট সুরক্ষায় কিংবা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে সংশ্লিষ্টদের কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না। সরকার বিভিন্ন সময় নানামুখী পদক্ষেপের কথা বললেও কার্যত তার কিছুই হয়নি। উল্টো কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সুগন্ধা, কলাতলী, লাবনী পয়েন্টসহ বিভিন্ন স্থানের বালুকাবেলা দখল হয়েছে অসাধু চক্রের হাতে। আর বালিয়াড়ি দখল করতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে লাইসেন্সও দেওয়া হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন সময় পর্যটকরা বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। আবার অনেক সময় ছিনতাইকারী ও টমটম চালকদের হাতে হেনস্তার শিকার হয়েছেন অনেক পর্যটক। রয়েছে ভাতের হোটেল ও আবাসিক হোটেলগুলোতে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগও।

সরেজমিন কক্সবাজার সুগন্ধা পয়েন্ট ও কলাতলী পয়েন্টে গিয়ে দেখা যায়, বর্ষার পানির তীব্র স্রোতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে সমুদ্রসৈকত। গর্ত হয়ে পানি জমে থাকায় ঝুঁকি তৈরি করছে পর্যটকদের জন্য। রয়েছে জেলা প্রশাসনের দেওয়া টোকেন দিয়ে তৈরি করা ঝুপড়ি দোকান। এতে সৈকতের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে পড়ছে। দরিয়ানগর ও হিমছড়ির অবস্থাও একই। জোয়ারের আঘাতে ভেঙে গেছে সৈকতের পাড়। তলিয়ে গেছে কয়েকশ ঝাউগাছ। প্রতিনিয়ত সৈকতের সৌন্দর্য নষ্ট হলেও তা রক্ষায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি। পর্যটক হয়রানি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কক্সবাজার পর্যটন শিল্পের ভবিষ্যৎ বাধা হতে পারে সুপেয় পানির সংকট। এ ছাড়া পর্যটকদের বিনোদনের জন্য নেই কোনো জাতীয় উদ্যান, থিম পার্ক, হেরিটেজ পার্ক, মেরিন মিউজিয়াম, নেই কোনো আন্তর্জাতিক মানের কনফারেন্স সেন্টার। অতিরিক্ত গাড়ি ভাড়া, হোটেল ভাড়া, খাবার বিল, নিত্য পর্যটক হয়রানি, ছিনতাই, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় যেখানে সেখানে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। এ ছাড়া সৈকতে ঝুপড়িগুলো সৌন্দর্য নষ্ট করছে। রাতদিন ভিক্ষুকদের দৌরাত্ম্য ও বখাটের উৎপাত পর্যটন শিল্প বিকাশের পথে বাধা। এ ছাড়া সাগরে নেই নেটিং ব্যবস্থা। ফলে পানিতে ভেসে গিয়ে ঘটছে মৃত্যুর মতো দুর্ঘটনা। এসব বাধার পাশাপাশি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা শিশু-কিশোর এখন পর্যটন এলাকায় ছিনতাই ও ভিক্ষুকের কাজ করছে।

কক্সবাজারে বেড়াতে আসা পর্যটক রহিম উল্লাহ বলেন, কয়েক মাস আগে বন্ধুদের নিয়ে কক্সবাজার এসেছিলাম। সে সময় সৈকতের যে পরিবেশ ছিল, এখন তা নেই। পুরো সৈকতের বেহাল অবস্থা। কলাতলী ও সুগন্ধা পয়েন্টে বালিয়াড়ি বিভক্ত হয়ে গেছে।

সাইফুল করিম নামে আরেক পর্যটক বলেন, বউ-বাচ্চা নিয়ে হিমছড়ি গিয়েছি। ওখানে টমটম চালকের টানাহেঁচড়া চরম অসহ্য। আর হিমছড়িতে যে পরিমাণ দোকান নির্মাণ করা হয়েছে, হাঁটাচলাও করা মুশকিল।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজারের সভাপতি এইচএম এরশাদ কালবেলাকে বলেন, অবৈধ পাহাড় কাটা, বনাঞ্চল নিধন, সরকারি খাসভূমি দখল, অপরিকল্পিত ইমারত তৈরির ফলে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। ব্যবসার নামে যত্রতত্র নির্মাণ করা হচ্ছে ইট-পাথরের স্থাপনা। সৈকতে গড়ে তোলা হয়েছে ঝুপড়ি দোকান। এতে সৈকতের সৌন্দর্য নষ্ট করছে। এ ছাড়া পর্যটন করপোরেশনের কোনো কর্মকাণ্ডও আমাদের চোখে পড়ে না।

আমরা কক্সবাজারবাসী সংগঠনের সমন্বয়ক মো. কলিম উল্লাহ বলেন, এখন পর্যটন শিল্পের অন্যতম সমস্যা রোহিঙ্গা ও মাদক। আর যেভাবে পাহাড় ও পরিবেশ ধ্বংস করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে মরুভূমি হবে কক্সবাজার। তাই এসব অনিয়ম বন্ধে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

কক্সবাজার সিটি কলেজের প্রভাষক ও ট্যুরিজম এবং হসপিটালিটি বিভাগের বিভাগীয়প্রধান মঈনুল হাসান পলাশ কালবেলাকে বলেন, পর্যটন শিল্পের বিকাশে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। এজন্য নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।

পর্যটন করপোরেশন কক্সবাজারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও হোটেল শৈবালের ব্যবস্থাপক রায়হান উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ করা হচ্ছে। আর পর্যটন বোর্ড পর্যটন শিল্প সংশ্লিষ্টদের নিয়ে কাজ করছে। আশা করছি ভালো কিছু হবে।

রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম ডালিম বলেন, বিভিন্ন সময় দেশে নানা সমস্যার কারণে ব্যবসা অত্যন্ত মন্দা গেছে। অনেকে তো রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তা করেছিল। তবে এখন কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে। আস্তে আস্তে বন্ধ থাকা রেস্তোরাঁও খুলছে। তবে আগের মতো সে অবস্থা নেই। তারপরও আমরা আশাবাদী ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারব।

কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেলিম নেওয়াজ বলেন, সৈকতের সৌন্দর্য রক্ষায় বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটিতে বারবার দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। মাঝে মাঝে পর্যটক হেনস্তার ঘটনায়ও এ শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ফলে ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে আমাদের।

ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজারের সহকারী পুলিশ সুপার আবুল কালাম কালবেলাকে বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তায় সর্বদা সচেষ্ট রয়েছে ট্যুরিস্ট পুলিশ।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক ও বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ সালাউদ্দিন কালবেলাকে বলেন, আমি সবেমাত্র দায়িত্ব নিয়েছি। ইতোমধ্যে পর্যটন নগরীকে কীভাবে সাজানো যায়, সেটা নিয়ে হোমওয়ার্ক শুরু করেছি। পর্যটন এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে কউক, সড়ক ও জনপথ, কক্সবাজার পৌরসভা, পর্যটন করপোরেশনের শৈবাল-প্রবাল, বিমানবাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে নিয়ে বৈঠক করে ছয়টি করণীয়ও নির্ধারণ করেছি। নাগরিকদের নিয়ে একটি সুপারভিশন কমিটি গঠন করা হয়েছে। এক কথায় কক্সবাজার ঘিরে আমাদের সামগ্রিক প্ল্যান রয়েছে। তবে সবার সমন্বিত উদ্যোগ ও সহযোগিতা কামনা করেছেন তিনি।

জৌলুস হারাচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত

No comments

Powered by Blogger.