দিনভর দুর্ভোগ, সন্ধ্যায় ধর্মঘট প্রত্যাহার ডাক্তারদের

ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনায় সারা দেশে প্রায় দশ ঘণ্টার ধর্মঘটে রোগীদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। চিকিৎসকদের কর্মবিরতিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে রোগীরা পড়েন চরম বিড়ম্বনায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চিকিৎসাসেবা না পেয়ে তারা বাধ্য হয়ে যান রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি মেডিকেলে। এদিকে, সরকারের আশ্বাসে চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনায় স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি’ আগামী চব্বিশ ঘণ্টার জন্য স্থগিত করেছেন আন্দোলনরত চিকিৎসকরা।  বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান আইনগত ব্যবস্থা ও নিরাপত্তার স্বার্থে ঢাকার ৮টি বড় হাসপাতালসহ বিভাগীয় পর্যায়ের প্রতিটি হাসপাতালে ‘ওয়ান স্টু ওয়ান’ অর্থাৎ একজন চিকৎসকের সঙ্গে একজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য রাখার শর্তে জরুরি সেবাসহ হাসপাতালের সাধারণ সেবা চালু রাখা হবে। তবে তাদের দাবি আদায়ে আগামী সাত দিনের জন্য বন্ধ থাকবে বহির্বিভাগের রোগী দেখা।

গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রশাসনিক ব্লকের সভাকক্ষে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমের সঙ্গে দীর্ঘ সময় রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে এমনটাই ঘোষণা দেন আন্দোলনরত চিকিৎসকরা। এর আগে বিভিন্ন হাসপাতালের অচলাবস্থা ও হামলার খবর পেয়ে রোববার দুপুরে ঢাকা মেডিকেলে আসেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম। সেখানে তিনি হাসপাতালের পরিচালক, প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ আন্দোলনকারীদের নিয়ে আলোচনায় বসেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহসহ আরও অনেকে। বৈঠকের একপর্যায়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যান সারজিস আলম।

কিছুক্ষণ পর হাসনাতও সেখান থেকে বেরিয়ে বাইরে চলে যান। এরপরও চলে বৈঠক। চার ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে উপদেষ্টা হাসপাতালের যেখানে হামলা হয়েছে সেসব স্থান ঘুরে দেখেন। সন্ধ্যার পর তিনি বলেন, চিকিৎসকরা যেই দাবিগুলো জানিয়েছেন, সেগুলো আসলেই যুক্তিপূর্ণ। তারা আমাদের কাছে তিনটি দাবি জানিয়েছেন। প্রথমত যারা এই হামলার সঙ্গে জড়িত তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। আমরা সেই চেষ্টা ইতিমধ্যেই শুরু করেছি। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে হামলাকারীদের শনাক্ত করা হচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যেই তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে। দ্বিতীয়ত চিকিৎসকরা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন। তারা বলেছেন- হাসপাতালে পর্যাপ্ত পরিমাণ পুলিশ, সেনাবাহিনী বা বিজিবি সদস্য মোতায়েন করতে হবে। আমরা সেটাও মেনে নিয়েছি। এখানে কাল রাত থেকেই আমাদের সেনাবাহিনী-পুলিশ কাজ করছে। বিজিবি রয়েছে। তারা আর একটা দাবি করেছে- স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে হাসপাতালের চিকিৎসকদের জন্য সার্বক্ষণিক স্বাস্থ্য পুলিশের ব্যবস্থা করা। যে প্রসঙ্গে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। কারণ এটা একটা আইনের বিষয়। আমি এ বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পরই জানাতে পারবো। তাই আমি তাদের বলেছি, আপনাদের সব দাবি মেনে নেয়া হবে তবে আমাদের কিছুটা সময় প্রয়োজন। চিকিৎসাসেবা চালুর বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, আপাতত তারা তাদের জরুরি সেবাসহ হাসপাতালের সাধারণ সেবা দিয়ে যাবে। চিকিৎসকরা তাদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি থেকে সরে এসেছেন।

এ সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, চিকিৎসকেরা কর্মবিরতিতে থাকলেও কিন্তু আমাদের হাসপাতালের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীদের চিকিৎসাসেবা চলমান রয়েছে। অন্যান্য যেই বিষয়-জরুরি বিভাগ, ক্যাজুয়ালিটি, নিউরো সার্জারিসহ অন্যান্য চিকিৎসাসেবাও শুরু হচ্ছে। একইসঙ্গে কর্মরত ডাক্তারদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসার সদস্যরা সার্বক্ষণিক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।

স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ও হাসপাতাল পরিচালকদের ব্রিফিংয়ের মধ্যেই সেখানে একদল চিকিৎসক এসে মারমুখী আচরণ করেন। সেখানে হট্টগোল শুরু হয়ে যায়। চিকিৎসকেরা বলেন, আমরা আমাদের কোনো কর্মসূচি স্থগিত করিনি। আমরা স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে আমাদের নিজেদের মধ্যে মিটিং করছিলাম। এর মাঝেই কীভাবে আমাদেরকে না নিয়ে কর্মসূচি স্থগিতের ঘোষণা দেয়া হয়। কিছু সময় নিয়ে তারা আবারো ফিরে আসেন। এ সময় আন্দোলনরত চিকিৎসকদের পক্ষে ডা. মো. আহাদ ও ডা. সুমন রানা বলেন, হামলাকারীদেরকে আইনের আওয়ায় আনা এবং জরুরি বিভাগে একজন চিকিৎসকের সঙ্গে একজন পুলিশ, সেনাবাহিনী বা বিজিবি সদস্য দেয়া হলেই আমরা শুধুমাত্র আগামী ২৪ ঘণ্টার জন্য ঢাকাসহ সকল বিভাগীয় পর্যায়ের হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা চালু করবো। এটা যদি এখনই করে তাহলে আমরা এখনই সেবা দিবো। আর তারা যদি এই নিরাপত্তা দিতে বিলম্ব করে তাহলে চিকিৎসাসেবাও বিলম্বিত হবে। আর আগামী ৭ দিনের মধ্যে আমদের নিরাপত্তার জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন পাস ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে বিশেষ স্বাস্থ্য পুলিশের ব্যবস্থা করতে হবে। আর সেটা না হওয়া পর্যন্ত আগামী ৭ দিন আউটডোর সেবা বন্ধ থাকবে। তবে আইসিইউ এইচডিউ সেবা চলমান আছে বলেও জানান তারা। তারা বলেন, একই দিনে এই হাসপাতালে তিনটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানো হয়েছে। একজন ভর্তি রোগীকে হাসপাতালের ভেতর কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। চিকিৎসকদের পেটাতে পেটাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পৃথিবীর আর কোথাও এমন ঘটনার নজির নেই। আমরা শুধু চিকিৎসক নয়, হাসপাতালের রোগীদেরও নিরাপত্তা চাই। আমাদের দাবি আদায় না হলে আমরা আবারো আমাদের কর্মসূচি ঘোষণা করবো।
এদিকে ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনায় একাত্মতা ঘোষণা করে গতকাল কর্মবিরতি পালন করেন মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালসহ বেশ কয়েকটি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। এ সময় কর্মবিরতি যাওয়ায় তাদের ওপর হামলা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। অপরদিকে চিকিৎসকদের কর্মবিরতিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে রোগীরা পড়েন চরম বিড়ম্বনায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চিকিৎসাসেবা না পেয়ে তারা বাধ্য হয়ে যান রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি মেডিকেলে।

স্টাফ রিপোর্টার, রংপুর থেকে জানান, সারা দেশের মতো রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালেও কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন করছে চিকিৎসকরা। রোববার ঢাকা থেকে এ কর্মসূচির ডাক দিলে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের গেটে তালা লাগিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে হাসপাতালের দুই শতাধিক ইন্টার্ন চিকিৎসক। এতে করে জরুরি বিভাগে আসা কিছু রোগী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে চিকিৎসাসেবা নিতে চলে যায়। চিকিৎসকদের কর্মবিরতির কারণে উত্তরের দুই কোটি মানুষের ভরসাস্থল রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা বন্ধ রয়েছে। দুপুরের পর থেকে নতুন করে কোনো রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেনি। এতে করে রোগী ও তাদের স্বজনরা ভোগান্তিতে পড়েছেন। মেডিসিন বিভাগে রোগীর স্বজন কুড়িগ্রাম চিলমারীর রবিউল ইসলাম বলেন, দুপুর থেকে হাসপাতালে চিকিৎসকরা বিক্ষোভ করছে। এতে করে রোগী ও আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি।

No comments

Powered by Blogger.