বাংলাদেশের নতুন শুরু -ইকোনমিস্টের রিপোর্ট

অসম্ভব মনে হলেও সত্যি গত ৫ই আগস্ট বাংলাদেশ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে গেছেন। যিনি জনতাকে ২০০৯ সাল থেকে প্রায় ১৫ বছর ধরে নিজের কর্তৃত্ববাদী শাসনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছিলেন। রাজধানীর সড়কে সড়কে বিশাল জনতার উপস্থিতি তাকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা হয়েছে বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। অনেকেই স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পর এই গণঅভ্যুত্থানকে ‘দ্বিতীয় মুক্তি’ বলে অভিহিত করেছেন। দেশজুড়ে উল্লাস প্রকাশ করছেন জনগণ। যদিও বাংলাদেশের সামনে এখন আরও বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা তাদের এখন দীর্ঘ স্বৈরতান্ত্রিক সময় থেকে মুক্তির পর বাংলাদেশকে নতুন করে সাজানোর কাজে সময় দিতে হবে। দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে এখন ঢেলে সাজাতে হবে। এরমধ্যে ভালো খবর হচ্ছে এক স্বৈরাচারের বিপরীতে বাংলাদেশে এখন একজন নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ দেশ গোছানোর সুযোগ পেয়েছেন।

দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় তুলে দিতে তার হাতে সময় খুবই কম। এখন দেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সিদ্ধান্তের উপর এখন বাংলাদেশের ১৭ কোটি মাসুষের ভবিষ্যৎ ঝুলে আছে। বিশ্ব রাজনীতিতেও বাংলাদেশ এখন আগের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। চীন, ভারত, রাশিয়া এবং পশ্চিমাদের মধ্যে বাংলাদেশ ইস্যুতে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হতে পারে।

জুলাই থেকে বাংলাদেশে যে উত্তাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তার রেশ এখনও কিছুটা বিদ্যমান। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। দাবি ছিল কোটার মাধ্যমে যে বৈষম্য করা হচ্ছে তার অবসান। কেননা আন্দোলনকারীরা কোটা ব্যবস্থাকে হাসিনার দলীয় কর্মীদের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যম হিসেবে দেখছিলেন। এছাড়া দেশে কোনোরকম গণতান্ত্রিক ভাবধারা বজায় না থাকায় জনতার মধ্যেও ক্ষোভ বাড়তে থাকে। বিশেষ করে এ বছর জানুয়ারিতে সরকার বিরোধী দলবিহীন যে নির্বাচন করে তাতে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এছাড়া ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর দমন-পীড়ন ছিল হাসিনা সরকারের সাধারণ বিষয়। হাসিনার সার্বিক পরিস্থিতি জনমনে যে বিক্ষোভের বারুদ জ্বালিয়ে দিয়েছিল তার প্রতিফলন ঘটেছে জুলাইয়ে সংঘটিত ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। যখন আন্দোলন তুঙ্গে তখন হাসিনার একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা আরও ক্ষুব্ধ হন এবং নতুন কর্মসূচি দেন। যেখানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জনতার ঢল নামে। যা একসময় সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। এরপর শুরু হয় ব্যাপক সহিংসতা। যাতে ৪৫০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।

এমন পরিস্থিতিতে যখন ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে হিমশিম খায় পুলিশ বাহিনী। তখন হাসিনা সেনাবাহিনীর সাহায্য চান। কিন্তু সেনারা তার প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন। কার্যত এ কারণেই জনতার বাঁধভাঙা জোয়ারে ভেসে যায় হাসিনা সরকার। জনতা হাসিনার পদত্যাগের দিন তার সরকারি বাসভবন তথা গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় দখল করে নেয়। এরপর জরুরি ভিত্তিতে দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। যার প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচিত হয়েছেন ৮৪ বছর বয়সী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ইতিমধ্যেই গতকাল রাতে তার অধীনে মোট ১৭ জন শপথগ্রহণ করেছেন। তবে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতদিন চলবে- তা এখনও স্পষ্ট নয়।  

১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হওয়ার পর বেশির ভাগ সময় অগণতান্ত্রিক উপায়ের মধ্য দিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। মাঝে দীর্ঘদিন সামরিক শাসনও প্রত্যক্ষ করেছে জনগণ। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে ক্ষমতার কেন্দ্রে এসেছে বড় দু’টি রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবদী দল (বিএনপি)। ঘুরে ফিরে এ দু’দলই শাসন করেছে জনগণকে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিশাল জয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। তার শাসনামলে তিনি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে নজর দিয়েছিলেন। বিশেষ করে পোশাক খাতের মাধ্যমে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সচেষ্ট হয়েছিলেন হাসিনা। কূটনৈতিকভাবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন তিনি। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে করেছিলেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক। এছাড়া পশ্চিমাদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেছিল হাসিনার সরকার।
এত কিছুর পরেও হাসিনার কর্তৃত্ববাদী আচরণের ফলে তার ওপর জনগণের ক্ষোভ বাড়তে থাকে। তিনি জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের নেতাদের কারারুদ্ধ করেন। এ বছর আগের সীমাহীন লুটপাটের ফলে অর্থনৈতিক চাপ আগের তুলনায় আরও প্রবল হয়। কর্মসংস্থানের অভাবে দেশে তরুণ বেকারদের সংখ্যাও ঊর্ধ্বগামী। হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। ২০২০ সালে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। ২০২১ সাল থেকে দেশের বৈদেশিক রিজার্ভ অর্ধেকেরও নিচে নেমে মাত্র ১৯ বিলিয়নে দাঁড়ায়। সেই ঘাটতি পূরণ করতে ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ থেকে প্রায় ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ঋণ নিয়েছিল। মূলত এমন কোনো জায়গা নেই যে বিষয়ে হাসিনার ওপর জনতুষ্টি বাকি ছিল। সকল খাতেই তিনি জনগণের বিরাগভাজন হয়েছেন। যার বাস্তবতা দেখা গেছে গত ৫ই আগস্ট।

যে মুহূর্তে হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন সেখান থেকে দেশকে সমৃদ্ধের পথে টেনে তুলতে ড. ইউনূসের বেশ বেগ পেতে হবে বলে মনে করা হচ্ছে। কেননা দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি, দুর্নীতি, প্রতিশোধমূলক সহিংসতা অতীতে নতুন সরকারের রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতি থেকে উদ্বেগ দূর করতে ড. ইউনূসকে এক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। অর্থাৎ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে দেশের সবার প্রতিনিধিত্ব করতে হবে তাকে। এক্ষেত্রে তাকে খুব সতর্ক হতে হবে। কেননা আর্থিক সংকট আরও খারাপ হলে বাংলাদেশকে ঋণ এবং অস্ত্রের জন্য আরও চীন নির্ভরতার দিকে ঝুঁকতে হতে পারে। ফলে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক অস্থিতিশীল হতে পারে যাতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাও হুমকিতে পড়তে পারে। নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি আওয়ামী লীগের পরিবর্তে ক্ষমতায় আসতে পারে। কেননা দলটি গত ১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনার দমন-পীড়নের শিকার হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে দলটির আগের চরিত্র খেয়াল রাখতে হবে।
ইউনূসকে এ বিষয়ে দ্রুত কাজ করতে হবে। কেননা কোনো অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘ সময় থাকলে তার ন্যায্যতা হারাতে পারে। এছাড়া সামরিক শক্তিও মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে অবশ্যই নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তার প্রাথমিক কাজ হচ্ছে শেখ হাসিনার তৈরি করা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা। বিশেষ করে হাসিনার সময় গড়ে ওঠা বিচারব্যবস্থা ও আইন ব্যবস্থার পরিবর্তন করা। পাশাপাশি তাকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা দূর করতে কাজ করতে হবে। ইউনূসের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালঞ্জ হচ্ছে- দেশে নতুন রাজনৈতিক কার্যক্রম এবং নেতৃত্ব তৈরিতে ভূমিকা রাখা। এমন নেতৃত্ব তৈরির পথ উন্মোচন করা যার মাধ্যমে দেশের তরুণ প্রতিনিধিত্ব সৃষ্টি হয়। এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যেন কোনোধরনের দ্বিধা ছাড়াই নতুন নেতৃত্ব কাজ করতে পারবে। অর্থাৎ দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য থেকেই নতুন রাজনৈতিক ধারা তৈরির পথ উন্মোচন করা- যাতে দীর্ঘদিন ধরে চলা বিষাক্ত রাজনীতি বন্ধ হয়।

No comments

Powered by Blogger.