পুলিশকে ধ্বংস থেকে উদ্ধারে জরুরি করণীয় : নতুন সরকারের জন্য সুপারিশ by ড. মেহযেব চৌধুরী
এই সংকট গভীর। হাজার হাজার পুলিশ সদস্য এখন কাজে ফিরতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। তাদের মধ্যে ব্যাপক ভীতি রয়েছে যে তারা এবং তাদের পরিবার প্রতিশোধমূলক সহিংসতার শিকার হতে পারেন। থানাগুলো আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে অনেক জায়গাতেই। কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের দমনমূলক ও অমানবিক আচরণের প্রতিক্রিয়া এটা। বাংলাদেশ পুলিশের বিরুদ্ধে অত্যাচার, অন্যায়ভাবে আটক করে রাখা এবং গুমের মতো অপরাধের অভিযোগ রয়েছে ভুরি ভুরি। তাদের অপকর্মের তালিকা দীর্ঘ ও কলঙ্কিত।
তাহলে কীভাবে এগুবো আমরা? একটি স্বাধীন সমৃদ্ধ দেশ কার্যকরী পুলিশ ছাড়া চলতে পারে না। সারা দেশে চলছে অরাজকতা। ডাকাতি হচ্ছে প্রতি রাতে। তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মা-বোনকে। কীভাবে আমরা সংস্কার করবো আমাদের পুলিশ ফোর্স? যারা কাজ করবে জনগণের জন্য কোনো ভয়ভীতি ছাড়া।
নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগ (এনওয়াইপিডি) থেকে কিছু শিক্ষা নেয়া সম্ভব। একটি পুলিশ বাহিনীর মধ্যে সিস্টেমিক দুর্নীতি মোকাবিলা কীভাবে করা যায় তার স্পষ্ট উদাহরণ এনওয়াইপিডি। ১৯৭০-এর দশকে এনওয়াইপিডি একের পর এক দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়তে থাকে। একটি নাম এখন ইতিহাসে লেখা- অফিসার ফ্রাঙ্ক সের্পিকো। তিনি লড়েছিলেন নিউ ইয়র্ক পুলিশের দুর্নীতির রহস্যভেদ করতে। এই রহস্য প্রকাশের ফলে ন্যাপ কমিশন গঠিত হয়, যা দুর্নীতির ব্যাপকতা উন্মোচন করে। বেরিয়ে আসে কীভাবে কর্মকর্তারা অপরাধীদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ করে আর তাদের অবৈধ কার্যক্রম করতে সাহায্য করতেন।
সের্পিকো দুর্নীতিবাজদের মুখোশ উন্মোচন করার পরও সংস্কার হয় ধীরগতিতে। ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত এনওয়াইপিডিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায়নি। নতুন পুলিশ কমিশনার উইলিয়াম ব্র্যাটনের নিয়োগের মাধ্যমে একটি পরিবর্তন ঘটে। ব্র্যাটন কম্পস্ট্যাট নামের একটি প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করেন। যা অপরাধ পরিসংখ্যান ব্যবহার করে পুলিশ ম্যানেজারদের কার্যকলাপের ন্যায্যতা প্রমাণ এবং তাদের দায়িত্বাধীন অফিসারদের কর্মের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য করে। এছাড়াও, ইন্টারনাল অ্যাফেয়ার্স ব্যুরো (আইএবি) শক্তিশালী করা হয় এ সময়ে, যা পুলিশের অসদাচরণ কঠোরভাবে তদন্ত ও দমন করে। এই সংস্কারকালীন পদক্ষেপের কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর কিছুটা হলেও আস্থা পুনরুদ্ধারে সহায়ক হয়।
যুক্তরাজ্যও হতে পারে উদাহরণ। তাদের পুলিশে অভ্যন্তরীণ জবাবদিহি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার যাত্রাটি ছিল দীর্ঘ ও জটিল। ১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশকে যুক্তরাজ্যের পুলিশ জড়িত ছিল দুর্নীতি এবং অসদাচরণ কেলেঙ্কারিতে। বার্মিংহাম সিক্স এবং গিল্ডফোর্ড ফোরের মতো ঘটনা তাদের ইতিহাসের অংশ। ষড়যন্ত্র করে মানুষকে দোষী সাব্যস্ত করা। নিজেদের দোষ লুকিয়ে নিরপরাধ মানুষকে অভিযুক্ত করা। অসৎ তদন্ত করে মিথ্যা কারাদণ্ড দেয়া। সবই হয়। ধীরে ধীরে জনগণের আস্থা নষ্ট করে এসব কর্মকাণ্ড। যুক্তরাজ্য সরকার ১৯৮৫ সালে পুলিশ কমপ্লেইন্টস অথরিটি (পিসিএ)সহ তৈরি করে বেশ কয়েকটি সংস্থা। তবে শুরু থেকই পিসিএ’র করা সমালোচনা হয়েছিল, কারণ এটি সম্পূর্ণভাবে না ছিল স্বাধীন, না দিতে পেরেছিল তার পুলিশ সদস্যদের দায়বদ্ধ রাখতে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা।
২০০৪ সালে পিসিএ’র পরিবর্তে ইন্ডিপেন্ডেন্ট পুলিশ কমপ্লেইন্টস কমিশন (আইপিসিসি) প্রতিষ্ঠিত হয়, যা অধিকতর স্বাধীনতা এবং বিস্তৃত তদন্তের ক্ষমতা নিয়ে আসে। তারপরও সমালোচনা অব্যাহত ছিল কারণ গুরুতর অসদাচরণের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হতো বিলম্ব। এর ফলে ২০১৮ সালে ইন্ডিপেন্ডেন্ট অফিস ফর পুলিশ কন্ডাক্ট (আইওপিসি) সৃষ্টি হয়, যা আরও স্বচ্ছ এবং কার্যকর। আইওপিসি উচ্চ-প্রোফাইল তদন্ত পরিচালনা এবং জন-আস্থা উন্নত করতে সফল হয়েছে কিছুটা হলেও। তাদের জন্য প্রতিষ্ঠানগত বর্ণবাদ মোকাবিলা এবং প্রকৃত দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা এখন মূল চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশের জন্য সুপারিশসমূহ
এনওয়াইপিডি এবং যুক্তরাজ্যের উদাহরণগুলো বাংলাদেশ পুলিশকে সংস্কারের জন্য মূল্যবান শিক্ষা প্রদান করতে পারে। তবে, বাংলাদেশের নিজস্ব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, পুলিশের অসদাচরণের ইতিহাস এবং সামাজিক চাহিদাগুলো বিবেচনা করে একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন। যার মধ্যে থাকতে পারে:
১. পুলিশ সদস্যদের নিরাপত্তা ও অবকাঠামো পুনর্গঠন: এই সংস্কারকালীন সময়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই লক্ষ্যে, পুলিশ বাহিনী পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত এবং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনীকে রাস্তায় রাখা প্রয়োজন। এই সহায়তা একটি স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করবে, যেখানে পুলিশ পুনর্গঠন এবং সংস্কারে মনোনিবেশ করতে পারবে। এদিকে, যত দ্রুত সম্ভব ধ্বংসপ্রাপ্ত থানাগুলো মেরামত এবং পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা উচিত। যেখানে এটি সম্ভব নয়, সেখানে অস্থায়ী থানা স্থাপন করতে হবে যাতে আইন প্রয়োগের কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। এই কার্যক্রম চলা পর্যন্ত কর্মকর্তাদের সুরক্ষা এবং একসঙ্গে অবকাঠামো পুনর্গঠন স্থিতিশীলতা আনতে এবং কার্যকর পুলিশ সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত তৈরি করতে অপরিহার্য হবে। সরকারকে আশ্বাস দিতে হবে যে, পুলিশ সদস্যদের ওপর জনগণের বিচারবহির্ভূত প্রতিশোধমূলক সহিংসতা বন্ধ হবে। ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে সমন্বয় করতে সহায়তা করতে পারে।
২. স্বাধীন তদারকি সংস্থা প্রতিষ্ঠা: বাংলাদেশে একটি স্বাধীন এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ পুলিশ তদারকি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, যেমন: যুক্তরাজ্যের আইওপিসি বা এনওয়াইপিডির ইন্টারনাল অ্যাফেয়ার্স ব্যুরো। যা পুলিশের দুর্নীতি, সহিংসতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো সকল ধরনের অসদাচরণ তদন্ত করতে পারবে। এই সংস্থাকে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন হতে হবে, হতে হবে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত এবং থাকতে হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা যার মধ্যে মামলা দায়েরের সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত।
৩. স্বচ্ছতা ও জনসম্পৃক্ততার ওপর জোর: পুলিশের ওপর জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে স্বচ্ছতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তদারকি সংস্থাটি তার অনুসন্ধান এবং অসদাচরণের প্রতিক্রিয়ায় গৃহীত পদক্ষেপের ওপর নিয়মিত রিপোর্ট প্রকাশ করতে হবে। ন্যাপ কমিশনের মতো জনসাধারণের শুনানিগুলোও অনুষ্ঠিত হতে পারে যাতে ব্যবস্থাগত সমস্যাগুলো প্রকাশিত হবে এবং নাগরিকদের উদ্বেগ প্রকাশ করার সুযোগ দেয়া হবে।
৪. ডাটা-চালিত দায়বদ্ধতা বাস্তবায়নকরণ: কম্পস্ট্যাট প্রোগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়ে, বাংলাদেশ একটি অনুরূপ সিস্টেম তৈরি করতে পারে যা পুলিশ পারফরম্যান্স নিরীক্ষণ করবে, কর্মকর্তাদের আর স্টেশনগুলোকে দায়বদ্ধ রাখবে। এই সিস্টেমটি শুধুমাত্র অপরাধের পরিসংখ্যানই নয়, কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, অসদাচরণের ঘটনা এবং তদন্তের ফলাফলও ট্র্যাক করবে। নিয়মিত নিরীক্ষা এবং মূল্যায়নের মাধ্যমে এই সিস্টেমটি কার্যকর এবং ন্যায্যভাবে কাজ করছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. কমিউনিটি পুলিশিং শক্তিশালীকরণ: বাংলাদেশ পুলিশের অন্যতম প্রধান ব্যর্থতা হলো তারা যেসব সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীকে সেবা দেয় তাদের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তুলতে না পারা। কমিউনিটি পুলিশিং বিশ্বের সব প্রান্তেই সফল হয়েছে। এই পদ্ধতিতে পুলিশের সঙ্গে জনগণের মধ্যে আস্থা এবং সহযোগিতা গড়ে তোলার ওপর জোর দেয়া হয়। যেখানে পুলিশ কর্মকর্তারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে, তাদের উদ্বেগগুলো সমাধান করে এবং অপরাধ প্রতিরোধ করে একসঙ্গে। তাই শান্তিপূর্ণ সমাধান, সাংস্কৃতিক যোগ্যতা এবং যোগাযোগের প্রশিক্ষণ সমস্ত কর্মকর্তাদের জন্য বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত।
৬. পুলিশকে অরাজনৈতিককরণ: বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব ছিল, এখনো আছে। দুর্নীতি এবং অসদাচরণের প্রধান কারণই এটি। সমাধান একটাই। পুলিশ নিয়োগ এবং পদোন্নতি রাজনৈতিক আনুগত্যের ওপর নয় বরং মেধারভিত্তিতে হতে হবে। নিয়োগ এবং পদোন্নতির প্রক্রিয়া তত্ত্বাবধানের জন্য একটি স্বাধীন সংস্থা থাকা উচিত যাতে এটি ন্যায্য এবং স্বচ্ছ হয়। রাজনৈতিক তদবির যাতে নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রভাবিত না করে তা নিশ্চিত করতে হবে।
৭. আন্তর্জাতিক মান এবং সর্বোত্তম অনুশীলন প্রবর্তনকরণ: সফল পুলিশ সংস্কার করতে হলে আমাদের পুলিশ সাইন্স পড়তে হবে, জানতে হবে। নরওয়ে এবং নিউজিল্যান্ডের মতো দেশগুলো মানবাধিকার, দায়বদ্ধতা এবং সমপ্রদায়ের সম্পৃক্ততার ওপর জোর দিয়ে পুলিশ তদারকি মডেল প্রয়োগ করেছে। জাতিসংঘ এবং ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েশন অব চিফস অব পুলিশ (আইএসিপি) কর্তৃৃক নির্ধারিত আন্তর্জাতিক মান গ্রহণ করতে হবে।
৮. প্রশিক্ষণ এবং প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্টে তহবিল বরাদ্দকরণ: পুলিশ সংস্কার শুধুমাত্র দায়বদ্ধতার বিষয়ে নয় বরং কর্মকর্তাদের পেশাদারিত্ব এবং দক্ষতা উন্নত করারও বিষয়। নৈতিকতা, মানবাধিকার এবং সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততার বিষয়ে ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা উচিত। তাছাড়া, কর্মকর্তাদের উচ্চ শিক্ষা এবং বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করলে আরও যোগ্য ও নৈতিক পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে পারবেন।
উপসংহার: বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ যে সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হবে তা নির্ধারণ করবে যে দেশটি একটি ন্যায়বিচার, সততা এবং আইনের শাসন সমর্থনকারী পুলিশ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবে কিনা। যদি অক্ষম হন, তাহলে সেই একই সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা দেখায় যে, পুলিশ সংস্কার সম্ভব, তবে এর জন্য প্রতিশ্রুতি, স্বচ্ছতা এবং কঠিন সত্যের মুখোমুখি হতে হবে। এখনই কাজ করার সময়। একটি স্বাধীন তদারকি সংস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে; পুলিশ বাহিনীকে অরাজনৈতিক করার মাধ্যমে এবং কমিউনিটি পুলিশিং পলিসি গ্রহণ করার মাধ্যমে; বাংলাদেশ দীর্ঘ প্রক্রিয়ার শুরু করতে পারে যাতে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার হয় এবং একটি এমন পুলিশ বাহিনী তৈরি হয় যা জাতিকে গর্বিত করে।
লেখক: ড. মেহযেব রহমান চৌধুরী একজন উদ্ভাবক, প্রশিক্ষক, অপরাধবিদ এবং ব্যারিস্টার। পঞ্চাশটিরও বেশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। বর্তমানে তিনি যুক্তরাজ্যের নর্থামব্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
No comments