হাসিনা হাতের রেখা পড়তে পারেননি by সাজেদুল হক

১৪ই জুলাই, ২০২৪। বিকালে গণভবনে সংবাদ সম্মেলন করেন শেখ হাসিনা। অবশ্য নামেই সংবাদ সম্মেলন। এটা ছিল এক নতুন ট্রেন্ড। শাড়ি থেকে কবিতা কোনোকিছুই বাদ যেতো না। সাংবাদিকের নামে হাজির থাকতেন স্তাবকেরা। প্রশ্নের নামে চলতো দীর্ঘ বক্তৃতা। এমনই এক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের কটাক্ষ করেন শেখ হাসিনা। বলেন, ‘মানে কি? মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা মেধাবী না, যত রাজাকারের বাচ্চা, নাতিপুতিরা মেধাবী।’ তার এ মন্তব্যের প্রতিবাদে রাতেই ক্ষোভে ফেটে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৫ বছরের শাসনামলে প্রথম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন তিনি। ১৪ই জুলাই থেকে ৫ই আগস্ট। কীভাবে সবকিছু তছনছ হয়ে গেল। ইতিহাসে কখনো কখনো এমন হয়। কয়েকটি দিনে এমন সব ঘটনা ঘটে যা একশ’ বছরেও ঘটে না।

শুরুতে অনুসরণ করা হলো পুরনো রীতি। ছাত্রলীগ নামিয়ে দাও। ঠেঙ্গাও। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রকাশ্যেই শাসালেন। ঢাকা শহরের সব মাস্তান জড়ো করা হলো ক্যাম্পাসে। ছাত্রীদেরও পেটালেন তারা। এরপর নামানো হলো পুলিশ-বিজিবি-র‌্যাব। রক্তে রঞ্জিত রাজপথ। আবু সাঈদের ঝাঁঝরা বুক যেন বাংলাদেশের হৃদয়। কী অসীম সাহসের সঙ্গে বুক পেতে দিয়েছিল এক তরুণ। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরও উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। অনেকে অবশ্য বলেন, আবু সাঈদের বিশ্বাস হচ্ছিল না! স্বাধীন দেশের পুলিশ নিরস্ত্র কোনো যুবকের বুকে এভাবে গুলি চালাতে পারে। তারপর প্রতিটি দিনই ছিল রক্তাক্ত। লাশের কাউন্ট ডাউন করতে গিয়ে নিউজরুমে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। বাংলাদেশের ইতিহাসে আগে কখনো এমন ঘটনা ঘটেনি। কবরে অজ্ঞাত লাশের সারি। কতো মানুষ মারা গেলেন তার সুনির্দিষ্ট হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। কয়েকশ’ মানুষ নিহত হয়েছেন এই নৃশংসতায়। যার বড় অংশই তরুণ। অন্তত ৩২ শিশু নিহতের খবর দিয়েছে ইউনিসেফ। এই নির্মম, নিষ্ঠুরতা অবশ্য মানুষ মেনে নেয়নি। তারা গুলির মুখেও রাস্তায় নেমেছে। এটা অনেককেই বিস্মিত, হতবাক করেছে। এই সাহসের উৎস কোথায় তা অজানা! এই লেখক খেয়াল করেছেন, রোববার দুপুরে তার অফিসের পাশের রাস্তাতেই কয়েক ঘণ্টা সংঘর্ষ চলে। যেখানে পুলিশ ও ছাত্রলীগ নির্বিচারে গুলি চালায় আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে। তারা মারা যায়। কিন্তু পিছু হটে না। পরবর্তী কয়েকঘণ্টা ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আন্দোলনের নেতারা সবাইকে ঢাকায় চলে আসার ডাক দেন। পরদিন মূল কর্মসূচি ছিল গণভবন ঘেরাও। তবে এরইমধ্যে পর্দার আড়ালে বেশকিছু ঘটনা ঘটে। আন্দোলনকারীদের ওপর শক্তি প্রয়োগ না করার সিদ্ধান্ত নেয় সেনাবাহিনী। অন্যদিকে, খবর বেরিয়েছে সার্বিক পরিস্থিতিতে ওয়াশিংটন দিল্লিকে জানিয়ে দেয়, শেখ হাসিনার সময় শেষ হয়ে গেছে। এরপর কী ঘটেছে তা সবারই জানা। শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। আমেরিকা তার ভিসা বাতিল করেছে। বৃটেন তাকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়নি। তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় শুরুতে বলেছিলেন, শেখ হাসিনা আর রাজনীতি করবেন না। এখন অবশ্য বলছেন, নির্বাচনের ঘোষণা দিলে শেখ হাসিনা দেশে ফিরবেন।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী পালিয়ে যাওয়ার পর দলটি তার ইতিহাসে সবচেয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে। সাবেক মন্ত্রী, শীর্ষ নেতারা কেউ বিদেশ চলে গেছেন, বাকিরা আত্মগোপনে আছেন। কেন এই পরিণতি? এর প্রধান কারণ জনগণের ক্ষমতাকে তুচ্ছ করা, গণতন্ত্রকে বিদায় করা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর একটি বিয়োগান্তক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন শেখ হাসিনা। গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম করেন তিনি। ভোট ও ভাতের অধিকারের জন্য তার নেতৃত্বে লড়াই করে আওয়ামী লীগ। এরশাদের পতনের পর অনেকেই তাকে ক্ষমতায় দেখছিলেন। কিন্তু বিস্ময়করভাবে বিএনপি সে নির্বাচনে জয়ী হয়। এরপরও রাজনীতির মাঠে লড়ে যান তিনি। একটি সহিংসতাপূর্ণ আন্দোলনের পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হন তিনি। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তার শাসনামলের অনেকেই প্রশংসা করেন। নানা ঘটনা পেরিয়ে ২০০৯ সালে তিনি বিপুল সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেন। বিশেষত তরুণ সমাজ তার প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন জানায়। তবে মানুষের আশা ভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগেনি। সময় যত গড়িয়েছে দলের ভেতরে এবং দেশে তিনি নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। দলের সিনিয়র নেতাদের করেছেন কোণঠাসা। ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচনের পথে হেঁটেছেন। বিরোধী নেতাকর্মীদের দিয়ে পূর্ণ করেন জেল। হত্যা, গুম, খুনের শিকার হন বহু মানুষ। প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমশ নিজের কব্জায় নেন। ভোটারবিহীন নির্বাচনের পরও টিকে যাওয়া তাকে আরও একনায়কতন্ত্রের পথে নিয়ে যায়। বিরোধীদের সব আন্দোলনই তিনি কঠোরভাবে দমন করেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মতামতকে অগ্রাহ্য করেন। ২০১৮ সালে বিরোধীরা নির্বাচনে অংশ নিলেও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। ভোট হয়ে যায় রাতেই। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো বারবারই আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু দমনপীড়নের মুখে শেষ পর্যন্ত তারা টিকতে পারেনি। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা এসব আন্দোলন নিয়ে উপহাসও করতেন প্রায়ই। ২০২৪ সালেও আওয়ামী লীগ আরেকটি একতরফা নির্বাচন করে ফেলে। যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের নির্বাচনের বিরোধিতা করে আসছিল। তবে নির্বাচনের পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সরকারের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। অনেকেই ধারণা করতে থাকেন, আবারো হয়তো পাঁচ বছরের জন্য টিকে গেল সরকার।

শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশে বেশকিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। পদ্মা সেতু এবং মেট্রোরেল এরমধ্যে অন্যতম প্রধান। এগুলো দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিরও একধরনের স্মারক। তবে একইসঙ্গে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণও বেড়েছে বহুগুণ। যা ভবিষ্যতের জন্য দুশ্চিন্তার। অন্যদিকে, এ সময়ে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। নির্বাচনের নামে হয়েছে তামাশা। মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মতো ইস্যুতে বাংলাদেশের উল্টোযাত্রা দেখেছে সবাই। পবিত্র গ্রন্থে বারবার বলা হয়েছে, ‘তোমরা সীমা লঙ্ঘন করো না।’ বাংলাদেশে আমরা এর পরিণতি দেখতে পাচ্ছি। মধ্য জুলাইয়ে কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ লিখেছিলেন, ‘লেখা আছে হাতের রেখায়। জাহাজ ডুববে অহমিকায়।’ বলা হচ্ছে, দেশ একটা নতুন যাত্রা শুরু করেছে। সামনের দিনগুলোতে কী হবে তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যায় না। প্রশ্ন হচ্ছে, শেখ হাসিনা কী আর কখনো বাংলাদেশে ফিরতে পারবেন?

No comments

Powered by Blogger.