চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে করুণ দৃশ্য: আল জাজিরার রিপোর্ট
গত সপ্তাহের সোমবার কাজ থেকে বাসায় ফিরছিলেন অনিক। এ সময় বিক্ষোভকারী ও পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যান রাস্তায়। কী ঘটছে তা বুঝে ওঠার আগেই ছররা গুলি এসে তার মুখমণ্ডলে লাগে। তিনি মাটিতে পড়ে যান। অচেতন হয়ে পড়েন। পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। ঢাকা সহ বিভিন্ন জেলা থেকে আনা প্রায় ৫০০ রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল।
হাসপাতালের রেকর্ড বলছে এর মধ্যে কমপক্ষে ২৭৮ জনের শরীরের অন্যান্য অঙ্গেও ক্ষত হয়েছে। মোটরসাইকেল ওয়ার্কশপে কাজ করে ১০ বছর বয়সী মোহাম্মদ শামীম। গত শুক্রবার মিরপুরে সংঘর্ষ চলাকালে তার দুই চোখেই ছররা গুলি বিদ্ধ হয়। সে কোনোদিনই পুরোপুরি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবে না বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। শামীমের পিতা মোহাম্মদ ইদ্রিস সন্তানের এই পরিণতির জন্য কাঁদছেন। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক গোলাম মোস্তাফা নিশ্চিত করেন যে, এসব মানুষ আহত হয়েছেন বিক্ষোভের সময় সংঘর্ষে শটগানে ছররা গুলি ব্যবহার করার কারণে। এসব গুলি চোখে প্রবেশ করে আটকে আছে কেন্দ্রীয় অঞ্চল রেটিনায় অথবা শক্তির ফলে তা বেরিয়ে গেছে। এসব কারণে আংশিক অন্ধত্ব দেখা দিতে পারে।
ধাতব ছররা গুলি শটগান, আইন প্রয়োগকারীদের ব্যবহারের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। তারা বলেছে, এটা ব্যবহার যথার্থ নয়। তা প্রয়োজনীয়তা ও আনুপাতিকের নীতিকে লঙ্ঘন করে। বেশ কিছু নিরাপত্তা বিশ্লেষক অনেক ছবি ও ফুটেজ যাচাই করে বলেছেন, বাংলাদেশ পুলিশ ও নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা ১২ গজ পাম্প-অ্যাকশন শটগান ব্যবহার করেছে। তাতে এসব ধাতব ছররা গুলির কার্ট্রিজ থাকে।
এ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে টেক্সট মেসেজে যোগাযোগের চেষ্টা করে আল জাজিরা। কিন্তু কোনো সাড়া পায়নি আল জাজিরা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক সেলিম মাহমুদ আল জাজিরাকে বলেছেন, বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কোনো রকম প্রাণঘাতী অস্ত্র পুলিশ বা আধা সামরিক বাহিনী ব্যবহার করেছে কিনা তা তিনি চেক করে দেখবেন। কিস্তু যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অভিযোগ করেছে বিক্ষোভ চলাকালে অতিরিক্ত শক্তি ব্যবহার করেছে বাংলাদেশের নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। একই রকম উদ্বেগ জানিয়েছে আরেক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। তারা বলেছে, বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে তাদের ওপর সরাসরি গুলি, কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট এবং শটগান থেকে ছররা গুলি ছোড়া হয়েছে। চোখে আহত হয়ে যারা বেঁচে আছেন তারা ও তাদের পরিবার দাবি করেছে, বৈষম্যমূলকভাবে শক্তি প্রয়োগ করেছে পুলিশ। কোনো বিরতি না দিয়ে গুলি করেছে। দক্ষিণের বরিশালে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন রকিবুল আহসান। তিনি বিএম কলেজে পরিসংখ্যানে চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। গত মঙ্গলবার তিনি সহপাঠীদের সঙ্গে রাস্তায় অবস্থান নিলে তার দুই চোখেই গুলি করা হয়েছে। তার চোখ পুরোপুরি ভালো হবে কিনা তা নিশ্চিত নন ডাক্তাররা। রকিবুল আহসান বলেন, আমরা একটি আইনগত বিষয়ে প্রতিবাদ করছিলাম।
এর জন্য আমাদের গুলি করা হলো। এখানে কোনো ন্যায়বিচার নেই। সেলসম্যান অনিকের সঙ্গে হাসপাতালের একই ওয়ার্ডে আছেন মাদারীপুরের সুমন মিয়া। তিনি একজন রাজমিস্ত্রি। তার ডানচোখে গুলি বিদ্ধ হয়েছে। আহসান বা অনিকের মতো তিনি সরকার বিরোধী প্রতিবাদে জড়িত নন। তিনি কাজ থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। অপারেশন সত্ত্বেও চিকিৎসকরা তার চোখটি বাঁচাতে পারেননি। তার ওই চোখের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। তার বোন লিপি আকতার বলেন, কোনো প্রতিবাদে যুক্ত ছিল না আমার ভাই। তাকে কেন গুলি করা হলো? এর জন্য কাকে দায়ী করা হবে?
No comments