অনলাইনে প্রথম যে জিনিসটি দেখা গিয়েছিল তা হলো ‘মৃতদের ডিজিটাল ইয়ারবুক’ by মুজিব মাশাল ও সাইফ হাসনাত

একজন পার্টটাইম শিক্ষকের ঘাড়ে গুলি লেগেছে। একজন সাংবাদিক যিনি দুই সন্তানের  বাবা, তার মাথা ভেদ করে গেছে গুলি। এক দোকানদারের ছেলেরও  গুলি গিয়ে লেগেছে সোজা মাথায়। গত সপ্তাহে ছাত্র বিক্ষোভের উপর একটি ভয়ঙ্কর ক্র্যাকডাউনের পরে যখন বাংলাদেশের মানুষকে প্রায় গোটা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছিল, তখন অনলাইনে প্রথম যে জিনিসটি আবির্ভূত হয়েছিল তা হলো  ‘মৃতদের ডিজিটাল ইয়ারবুক’।

সরকারি চাকরিতে  সংরক্ষিত কোটার বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হিসেবে যা শুরু হয়েছিল, তা দমন করার নামে সরকারি বাহিনী রীতিমতো হত্যাযজ্ঞ চালায়।  মৃতের সংখ্যা প্রায় ২০০-এর কাছাকাছি। হাজার হাজার আহত হয়েছেন। শুধু রাজধানী ঢাকার একটি হাসপাতালেই ২৫০ জনেরও বেশি লোকের মুখে পেলেট বা (রাবার বুলেট) গুলি করার পর চোখের অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। নিহতদের অধিকাংশই যুবক, তাদের বয়স ২০। স্থবির অর্থনীতির জেরে  চাকরির সম্ভাবনা  ক্ষীণ হওয়ার কারণে তারা রাজপথে একত্রিত হয়েছিল। রাষ্ট্র নেতারা চাকরির মেধাভিত্তিক বণ্টনের জন্য তাদের দাবিকে প্রত্যাখ্যান করার পাশাপাশি সরকারি দুর্নীতি এবং দায়মুক্তি হিসেবে তারা যা প্রত্যক্ষ করেছিল  তা তাদের  মনে একটু একটু করে ক্ষোভের  সঞ্চার করে।

২৩ বছর বয়সী হৃদয় চন্দ্র তারুয়া ইতিহাসে ডিগ্রি শেষ করে গৃহশিক্ষক হিসেবে কাজ করছিলেন। তার বাবা একজন কাঠমিস্ত্রি,  মা ঘর সামলান। কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পর সে মাকে সাহায্য করতো। জামাকাপড় ধুয়ে দিতো, মসলা পিষে দিতো। মাকে সান্ত্বনা দিতো এই বলে-চাকরি পাওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার। এরপরে আর কষ্ট করতে হবে না। কিন্তু হৃদয়ের আর বাড়ি ফেরা হলো না।
নিহত তিন সাংবাদিকের একজন হাসান মেহেদি (৩৫)। তিনি তার স্ত্রী ও দুই  কন্যাসন্তানকে রেখে গেছেন, যাদের বয়স তিন বছরের কিছু  বেশি। তার স্ত্রী ফারহানা ইসলাম পপি বলে ওঠেন, ‘আমার ছোট মেয়ে সবেমাত্র  ‘আবু, আবু’ বলতে শিখেছে। আমার মেয়েরা কখনই জানতে পারবে না যে, তাদের বাবা আসলে কে ছিলেন।’

দমনপীড়ন শুরু হওয়ার সময় মাহমুদুল রহমান সৈকত (২০) তার  দোকানটি  বন্ধ রেখেছিলেন। তার বোন সাবরিনা সাবন্তী জানান, আহত ছাত্রদের সাহায্য করতে ছুটে গেলে তাকে হত্যা করা হয়। দুই বোনের সঙ্গে ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার মাহমুদুল রহমান সৈকতের খুনসুটির সম্পর্ক ছিল। সাবন্তী অশ্রুসজল নয়নে বলছেন-  ‘যখন তারা ভাইকে কবর দিতে নিয়ে গিয়েছিল, তখন সমস্যা হচ্ছিলো। কারণ ভাই এতটা লম্বা ছিল।’

নিহতদের পরিবারের জন্য তাদের প্রিয়জনের মৃত্যুর  পরের কাজটি ছিল সব থেকে কঠিন। ফোন বন্ধ থাকার কারণে মৃতদেহ অনুসন্ধান করা, দাফন সম্পন্ন করা প্রতি পদক্ষেপে তাদের বাধার মুখে পড়তে হয়। সাবন্তীর কথায়, ‘আমি জানি না, আমরা আর কখনো মন খুলে হাসতে পারবো কিনা। আমার মা সারাদিন কাঁদে। বাবা সারাদিন কাঁদে। আমরা শুধু ভাইয়ের কথাই ভাবতে থাকি।’
বিক্ষোভ, যা ক্র্যাকডাউন এবং কারফিউ’র পরে প্রশমিত হয়েছে, এই মাসের শুরুতে একটি একক দাবিতে শুরু হয়েছিল। ছাত্ররা এমন একটি ব্যবস্থার অবসান চেয়েছিল যেখানে সরকারি চাকরিতে ‘মুক্তিযোদ্ধাদের; বংশধরদের জন্য ৩০% কোটা বরাদ্দ ছিল। প্রায় ১০ দিন আগে বিক্ষোভটি বিশৃঙ্খলায় নেমে আসে,  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীকে পুরো সুসজ্জিত করে রাস্তায় নামিয়েছিলেন।

হাজার হাজার মানুষকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় যা ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক বন্দিদের ভিড়ে পরিপূর্ণ। এলাকায় এলাকায় টহল দিতে থাকে নিরাপত্তা বাহিনী।  ঘরবাড়িতে ঢুকে শুরু হয় চিরুনি তল্লাশি এবং রাস্তায় লোকজনকে দাঁড় করিয়ে তাদের ফোন ঘেঁটে দেখা হয় সেখানে বিক্ষোভের কোনো  ফুটেজ আছে কিনা যা অনলাইনে পোস্ট করা যেতে পারে। হাসিনার বাহিনীও বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তিনজন ছাত্রনেতার একজনকে আহত অবস্থায়  হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে তাকে  তুলে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান তিনজন ছাত্রনেতার গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন,  ‘বিক্ষোভ চালিয়ে যাবার জন্য ছাত্রদের হুমকি দেয়া হচ্ছিলো। শুধুমাত্র তাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য, আমরা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবো।’
হাসিনা তার রাজনৈতিক বিরোধীদের সহিংসতার জন্য দায়ী করেছেন, বলেছেন যে তারা তার সরকারকে পতনের চেষ্টা করতে বিক্ষোভে অনুপ্রবেশ করেছিল। অন্তত তিনজন পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়, তার দলের একজন সদস্যকে মারধর করা হয় এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ভাঙচুর করা হয়। বিশ্লেষক ও কূটনীতিকরা বলছেন, খুব সম্ভবত দীর্ঘদিন ধরে দমে থাকা  বিরোধী দলগুলো এই মুহূর্তটি কাজে লাগাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিন্তু তারা এটাও বলে হাসিনার প্রতিক্রিয়া জানানোর একটি প্যাটার্ন আছে:    সংঘাতকে তীব্র পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, তারপর নিজের ক্ষমতাবলে সমর্থকদের রক্ষা করা ও বিরোধীদের দোষারোপ করা।

ডিজিটাল ইয়ারবুকে ২৫ বছর বয়সী আবু সাঈদের মৃত্যুকে ১ নম্বরে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তার প্রতিকৃতিতে  শোভা পাচ্ছে বাংলাদেশের পতাকা। সাঈদ উত্তরাঞ্চলীয় শহর রংপুরের ছাত্র ছিলেন। তার পরিবার বছরের পর বছর ধরে কিছু জমিজমা বিক্রি করে সংসার চালায়। তিনি রংপুর থেকে দূরে সরকারি চাকরি করে জীবন গড়তে চেয়েছিলেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন যে, সামনে অনেক প্রতিকূলতা রয়েছে। তার  একজন চাচাতো ভাই যিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেও এখনো কোনো সরকারি চাকরি খুঁজে পাননি।  তাই সাঈদ সিভিল সার্ভিসে কোটা সিস্টেম নিয়ে বেশ ক্ষুব্ধ ছিলেন।  প্রতিবাদ করার ক্ষেত্রে তার সংকল্পের আরেকটি কারণ ছিল: হাসিনা  রাজাকারদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের তুলনা করার পর তার দলের যুব শাখার সদস্যরা সাঈদের পাশাপাশি  শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলা চালিয়েছিল। মৃত্যুর আগে ধারণ করা একটি ভিডিওতে সাঈদকে বলতে শোনা যায় যে, তাকে মুখে থাপ্পড় মারা হয়েছে। তার পরিবার জানিয়েছে,  হত্যার একদিন আগে এই  ঘটনা ঘটে।

আরেকটি ভিডিও ১৬ই জুলাই বিকাল থেকে ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ার আগে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। যাতে দেখা যায়  সাঈদ একটি কালো টি-শার্ট পরে আছেন এবং একটি লাঠি ধরে আছেন। তিনি তার বাহু প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছেন  যখন পুলিশ অফিসাররা তাকে লক্ষ্য করে  গুলি চালায়। সেই সময়ে  ভিডিওতে একটি কণ্ঠস্বর ভেসে ওঠে ‘তাকে গুলি করা হয়েছে, তাকে গুলি করা হয়েছে’। তারপর   আবার উঠে দাঁড়ান নির্ভীক সাঈদ। আবার গুলি চলতে থাকে তাকে লক্ষ্য করে। সাঈদের শরীরে বেশির ভাগ ক্ষত রাবার বুলেটের। কিন্তু তার মৃতদেহ গ্রহণকারী তার ভাই রমজান আলী বলেছেন যে,  সাঈদের মাথার কাছে যে গুলিটি গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল সেটি অন্তত রাবার বুলেট ছিল না। সাঈদকে একটি হাসপাতালে মৃত ঘোষণা করার পর তার বন্ধুরা তার লাশ বিক্ষোভস্থলে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু পুলিশ তা ছিনিয়ে নিয়ে লুকিয়ে রাখে। তার ভাই রমজান আলী বলছেন  যে, তিনি যখন হাসপাতালে পৌঁছান তার ভাইয়ের লাশ শনাক্ত করতে তখন কয়েক ঘণ্টা ধরে  খোঁজাখুঁজি ও অনুনয়-বিনয় করতে হয়েছিল। আলী কিছু কাগজপত্রে সই করে ফিরে আসার পর দেখেন সাঈদের  লাশ গায়েব। তিনি আরও কয়েক ঘণ্টা খোঁজাখুঁজি ও অনুনয়-বিনয় করার পর পুলিশ জানায় লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কী ঘটছে তা তার কাছে পরিষ্কার ছিল। পুলিশ ইচ্ছা করে সময় নষ্ট করছিল।

মধ্যরাতের পর ছাত্রছাত্রীরা লাশ ফেরতের দাবিতে হাসপাতালে হামলার হুমকি দিলে কর্মকর্তারা সূর্যোদয়ের আগে সাঈদের লাশ দাফন করার জন্য তার পরিবারের ওপর চাপ দিতে থাকে। এমনকি লাশ দেয়ার আগে পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হবে কিনা তাও জানতে চায় পুলিশ। আলী বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম মামলা  করবো না।  কারণ আমরা ভয় পেয়েছিলাম, তাহলে হয়তো ভাইয়ের লাশটাও আমরা পাবো না।’

(লেখক: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের দক্ষিণ এশিয়ার ব্যুরো প্রধান। তিনি বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল এবং ভুটান সহ ভারত এবং এর আশেপাশের বিভিন্ন অঞ্চলের কভারেজে সাহায্য করেন)।
সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস

No comments

Powered by Blogger.