কখনো কখনো শুধু কেঁদেছি

ধর্ষণকে যেখানেই যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়, সেখানকার নির্যাতিত নারীর পাশে দাঁড়াতে চান রাজিয়া সুলতানা। মিয়ানমারের ধর্ষিত, যৌন নির্যাতিত নারীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের শক্তি জুগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। মিয়ানমারের মংডুতে জন্ম হলেও রাজিয়া সুলতানা বড় হয়েছেন বাংলাদেশে। রোহিঙ্গা নারীদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের বিষয়ে তিনি সাক্ষ্য দিয়েছেন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে। সাহসিকতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে অভিজাত ইন্টারন্যাশনাল ওমেন অব কারেজ অ্যাওয়ার্ড পুরস্কার দিয়েছে। তিনি একজন আইনজীবী ও অধিকারকর্মী। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে যখন স্রোতের মতো নির্যাতিত রোহিঙ্গারা পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে থাকেন, নারীরা যে ভয়াবহ যৌন নির্যাতনের শিকারে পরিণত হন- তাদের সামনে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন। বাংলাদেশে তিনি রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জন্য একজন শিক্ষাবিদ, অধিকারবিষয়ক প্রচারক ও দোভাষী।
মিয়ানমারে ধর্ষিত হয়ে বেঁচে থাকা যেসব নারী পালিয়ে বাংলাদেশের এসেছেন, এমন কয়েক শত নারীর সাক্ষাৎকার নেয়ার পর তিনি তাদের কাউন্সিলিং ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য পরামর্শ দেয়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন রোহিঙ্গা ওমেনস ওয়েলফেয়ার সোসাইটি। যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে সাহসিকতার জন্য ইন্টারন্যাশনাল ওমেন অব কারেজ অ্যাওয়ার্ড পুরস্কার দেয়ার পর যখন তিনি ওয়াশিংটনে অবস্থান করছিলেন, তখন টেলিফোনে তার একটি সাক্ষাৎকার নেন বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের সাংবাদিক লাইগনি ব্যারন। এখানে তার অনুবাদ তুলে ধরা হলো:
প্রশ্ন: রোহিঙ্গা নারী ও বালিকাদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতার ঘটনা কিভাবে প্রামাণ্য আকারে ধারণ করা শুরু করলেন?
উত্তর: ২০১৬-২০১৭ সালে ঢলের মতো বাংলাদেশে শরণার্থী অনুপ্রবেশের পর বিষয়টি এলোমেলো মনে হয়েছিল। আমাকে নারীদের সাহায্য করতে হয়েছিল। ধর্ষিত হওয়া, অঙ্গছেদ করা ও প্রিয়জনদের হত্যা অথবা প্রহৃত হওয়ার দৃশ্য তারা প্রত্যক্ষ করেছেন। যারা এসব অপরাধ করেছে তাদের সামনে কথা বলতে স্বস্তিকর অবস্থানে ছিলেন না এসব নারী। সেসব ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা তারা আমার সঙ্গে ভাগাভাগি করেছেন।
প্রশ্ন: কিসের জন্য আপনি এর ওপর রিপোর্ট লেখা শুরু করলেন?
উত্তর: ২০১৪ সালে আমার এক বন্ধু আমাকে একটি রিপোর্ট দিয়েছিলেন। এটা ছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সহিংসতা নিয়ে, যেখানে যৌনতাকে তারা অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করে বর্ণনা করেছে ‘লাইসেন্স অব রেপ’ অর্থাৎ ধর্ষণের লাইসেন্স। তারপর ২০১৬ সালে যখন রোহিঙ্গা শরণার্থী পালিয়ে বাংলাদেশে আসছিলেন, তখন তারা কি রকম সহিংসতার শিকার হয়েছেন তা শুনে আমি বিস্মিত হয়েছি। কালাদান প্রেসের (রোহিঙ্গাদের মিডিয়া বিষয়ক সংগঠন) জন্য কিছু সাক্ষাৎকারকে ভাষান্তরে সহায়তা করছিলাম। এমন কয়েকটি সাক্ষাৎকারের পর আমার কাছে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেল। তা হলো, বেশির ভাগ নারী যৌন সহিংসতা, নির্যাতন, হয়রান ও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আমার সম্পাদককে বললাম, ‘লাইসেন্স অব রেপ’-এর মতো রিপোর্ট করা দরকার আমাদের। তিনি আমাকে বললেন, ওকে আপনি এটা করতে পারবেন?
প্রশ্ন: নারীরা কি এসব যৌন নির্যাতনের ঘটনা প্রামাণ্য আকারে ধারণ করা হোক এমনটা চেয়েছেন?
উত্তর: অনেক নারী ভীষণ ক্ষুব্ধ। ক্ষোভ থেকে তারা বলেছেন, আমরা কেন আর এখন এসব কথা লুকিয়ে রাখবো? অনেকেই সাহসী। আবার কিছু আছেন, যারা নীরব থাকতেই পছন্দ করেছেন।
বিষয়টি আমার কাছে জটিলও। বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকার নেয়ার পর আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। কখনো কখনো শুধু কেঁদেছি। জানি না কেন কেঁদেছিলাম। কখনো কক্সবাজার থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। কারণ, সেখানে আমি ভীষণ বেদনাবোধ করছিলাম। আমি চিকিৎসকের কাছে গেলাম। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, আপনি কি করতে চান?
তাকে আমি বললাম, আমার মানুষদের সাহায্য করতে চাই।
আমার কথা শুনে তিনি বললেন, ঠিক আছে। তাহলে আপনাকে অনেক দৃঢ় মানসিকতার হতে হবে।
প্রশ্ন: রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মধ্যে এই ইস্যুটি কতটা উন্মুক্তভাবে আলোচনা করা হয়?
উত্তর: তাদের মধ্যে ভীষণ রকম লজ্জাবোধ। নারীরা তাদের পরিবারের সুনাম নিয়ে সচেতন। একজন চিকিৎসকের কাছে যেতেও তারা ভয় পান। একজন ডাক্তার দেখলেও তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। ২০১৬ সালে আমি একজন নারীর সঙ্গে কথা বলি। তিনি ছিলেন অবিবাহিত যুবতী। তিনি নড়তে পর্যন্ত পারছিলেন না। তার সমস্ত শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল। আমাকে যে সূত্র এ বিষয়ে খবর দিয়েছে তার কাছে জানতে চাইলাম, এই যুবতীকে একজন ডাক্তারের কাছে না নিয়ে আপনি আমাকে কেন এখানে এনেছেন?
প্রশ্ন: পরিবারগুলো কেমন সাপোর্ট দেয়?
উত্তর: কিছু নারীর স্বামী ও তাদের পরিবার ভালো। আবার কিছু পরিবার আছে, যারা ধর্ষিত স্ত্রী বা অবিবাহিত মেয়েদের আর গ্রহণ করতে চায় না। এক্ষেত্রে আপনি বিষয়টিকে ৫০-৫০ বলতে পারেন। তাই অনেক নারী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ার পরও এমন পরিস্থিতিতে নিজের অবস্থা প্রকাশ করেন না। আমরা ডাস্টবিন থেকে উদ্ধার করেছি ৫ অথবা ৬টি শিশুকে।
প্রশ্ন: যৌন সহিংসতা যে পদ্ধতিগত অথবা আপনার রিপোর্ট যেমনটা বলেছে, কমান্ড থেকেই ধর্ষণ হচ্ছে- এ বিষয়গুলো আপনি কিভাবে স্থির হলেন?
উত্তর: জাতিগত এলাকাগুলোতে এটা হলো মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর একটি পুরনো কৌশল। প্রথমেই তারা টার্গেট করে নারীদের। এমনটা করা হলেই মানুষ পালাতে থাকে। যুদ্ধের কৌশল হিসেবে ধর্ষণের অর্থ হলো আতঙ্ক সৃষ্টি করা। মানুষ যখন দেখে তাদের মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনী, তখন তারা ভাবেন আমাদের আর বাড়িঘরের দরকার নেই। আমাদের মেয়েদের বাঁচাতে হবে। রক্ষা করতে হবে পরিবারের সুনাম। তাই তারা বাড়িঘর ছেড়ে যান। তাদের ভূমি ছেড়ে যান। দেশ ছেড়ে যান।
এই যৌন সহিংসতা সুস্পষ্টতই কোনো ব্যক্তিবিশেষের যৌনতা সংক্রান্ত বাসনা থেকে ঘটেনি। দল বেঁধে চালানো হয়েছে এ সহিংসতা। তারা যুবতী নারী ও বয়স্ক নারীদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়েছে। তারপর তাদের ধর্ষণ করেছে। ২০১৬ সালে যখন ‘উইটনেস টু হরর’ শিরোনামে আমার রিপোর্টগুলো সংকলন করছিলাম তখন মাত্র ১৪ বছর বয়সী একটি বালিকার সাক্ষাৎ পাই আমি। তাকে কমপক্ষে ৩০ জন সেনাসদস্য ধর্ষণ করেছে। সেনাবাহিনী নারীদের স্তন কেটে ফেলেছে। উপড়ে ফেলেছে তাদের চোখ। তারা শুধু ধর্ষণ করেই থেমে থাকেনি। এটা হলো এই সম্প্রদায়কে শাস্তি দেয়ার অস্ত্র।
প্রশ্ন: যুদ্ধাপরাধে ধর্ষণ হলো সবচেয়ে কম গুরুত্ব দিয়ে রিপোর্ট করা হয় যেসব বিষয়ে তার একটি। রোহিঙ্গা নারীদের ক্ষেত্রে দৃষ্টি আকৃষ্ট করার জন্য আপনি কি পরিবর্তন আনার আশা করেন?
উত্তর: শুধু মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, বসনিয়া, ঘানা বা অন্য জায়গাগুলোই নয়, বিশ্বের যেখানেই ধর্ষণকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে আমি তার প্রতিটি স্থানের জন্যই কাজ করছি। আমরা ন্যায়বিচার চাই। একটি আন্তর্জাতিক আইন থাকা উচিত অবশ্যই। তা হলো সেনাবাহিনীকে অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। কোনো জবাবদিহিতা ছাড়াই এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে এই পর্যায়ে সহিংসতার মুখোমুখি কিভাবে হচ্ছেন নারীরা?
প্রশ্ন: নৃশংসতার নিন্দা না জানিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে অব্যাহত অবস্থান নিয়েছেন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি। এতে অনেক পশ্চিমা দেশ হতাশ। আপনি এ বিষয়ে কি বলবেন?
উত্তর: আমার জন্য এটা অত্যন্ত জটিল বিষয়। কারণ, আমরা তার (সুচি) জন্য লড়াই করেছি। তাহলে কেন তিনি আমাদের দুর্ভোগের বিষয়ে নীরব? যা ঘটেছে তার দায়দায়িত্ব তারও আছে। এটা সত্যি যে, তার কোনো ক্ষমতা নেই। তিনি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা সরকারের হাতের পুতুল। কিন্তু তবুও, তিনি হলেন গণতান্ত্রিক নেত্রী। তাই তার দেশের ভিতর কি ঘটছে সে বিষয়ে জানা তার দায়িত্ব। সেনাবাহিনী নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করছে। আর তিনি বলছেন, তিনি কিছুই জানেন না! হয়তো এ বিষয়ে তিনি কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। কারণ, তিনি জেলে ছিলেন। এখন তিনি মুক্তি পেয়েছেন। তাই তিনি ক্ষমতা হারাতে চান না।
প্রশ্ন: যেসব রোহিঙ্গা নারী পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন এবং বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করছেন তাদের কাছে জীবনের অর্থ কি?
উত্তর: এটা হলো এক জেলজীবন। নারীরা মুক্তভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা অথবা শিক্ষা পান না তারা। এটা তো কোনো জীবন হলো না। এমনকি তারা তাদের তাঁবুর বাইরেও যেতে পারেন না, যা বাস্তবেও তাঁবু নয়। এগুলো হলো অস্থায়ী আশ্রয়স্থল। রোহিঙ্গা সমাজ অত্যন্ত রক্ষণশীল। তাই যখন কোনো বেড়া, কোনো গোপনীয়তা থাকে না, তখন নারীরা শুধুই ঘরের ভিতর অবস্থান করেন। তারা রান্না করেন। ফেলে আসা জীবনের স্বপ্ন দেখেন।
রাতে টয়লেটে যাওয়ার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা নারীরা নিরাপত্তাহীনতা বোধ করেন। তারা একা একা টয়লেটে যেতে পারেন না। প্রচুর হয়রান হতে হয় তাদের, যা মানসিক নির্যাতনের চেয়েও বেশি কিছু।
আশ্রয় শিবিরে করার মতো কিছু নেই তাদের। তাদের কাছে একটি দিন যেন একটি বছর। এই আশ্রয় শিবিরে তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তারা শুধু বসবাস করছেন জীবজন্তুর মতো। বিশেষ করে যুবসমাজ হতাশায় মগ্ন। কারণ, তাদের কোনো কাজ নেই। শিক্ষা নেই। পাচারকারীদের শিকারে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে তারা ঝুঁকিতে। এসব পাচারকারী তাদের ভালো চাকরি, বিয়ে ও অন্য যেকোনো কিছুর প্রলোভন দেখায়। প্রতিশ্রুতি দেয়।
প্রশ্ন: যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এক্ষেত্রে কি করতে পারে?
উত্তর: নৃশংসতা বন্ধের জন্য মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তদন্ত করা উচিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) এবং তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত। পুরো একটি সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রহীন করে দেয়ার কোনো অধিকার নেই মিয়ানমারের। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গারা শুধু বাংলাদেশের বোঝা নন। এ সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেয়া উচিত পুরো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যা ঘটছে, নারীদের বিরুদ্ধে যে যৌন সহিংসতা ঘটছে তা যে গণহত্যার অংশ তা এখনও মেনে নিচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র। শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবরোধ এক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তন আনতে পারে। কারণ, মিয়ানমারের বড় সব কোম্পানির মালিক হলো সেনাবাহিনী। এই অবরোধ আরোপের কাজটি করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী ও এ বাহিনীতে নিয়োজিতদের সন্তানদের অধিকার কেড়ে নিতে পারে। 
প্রশ্ন: এরপর আপনি কি করবেন?
উত্তর: আমাদের উচিত আমাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা ও রাজনৈতিক দাবি পুনর্গঠন করা। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সব সময়ই প্রস্তাব দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত রোহিঙ্গাদের দ্বারাই। এই সম্প্রদায়টি জানে, তাদের জন্য উত্তম কি। আমাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব গড়ে তোলা উচিত। একটি স্পষ্ট কূটনৈতিক অবস্থান গড়ে তোলা উচিত। এর আগে আমি রাজনীতিক হতে চাইনি। কিন্তু এখন দেখছি এটা প্রয়োজনীয়। আমাদের অনেক যোগ্য নেতা আছেন, যারা আমাদের এজেন্ডার প্রকাশ ঘটাতে পারেন। আমি তাদের সাহায্য করতে পারি। এমন রাজনৈতিক গ্রুপের অংশ হতে পারি আমিও।

No comments

Powered by Blogger.