‘আট বছর বয়সী রোগিও পাই আমরা’: কাশ্মীরের মাদক সমস্যা by আইজাজ নাজির

শ্রীনগর থেকে ৩৬ মাইল দূরের একটি গ্রামে এক রেস্তোরাঁর সিঁড়ির নিচে লুকিয়ে হেরোইন নিচ্ছিল রিয়াজ*। দশ রুপির একটা নোট রোল করে নিঃশ্বাসের সাথে হেরোইন টেনে নিচ্ছিলো সে।

আল জাজিরাকে সে বললো, “এই ডোজ নেয়ার জন্য আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। একটা জায়গা খুঁজছিলাম কোথায় এটা নিতে পারবো। কয়েক ঘন্টা ভালো থাকবো এটা নেয়ার পর, এরপর আবার চাহিদা বাড়বে, আমার অস্বস্তি লাগতে শুরু হবে এবং আমি জ্বর জ্বর এবং ঠাণ্ডা অনুভব করবো”।

বন্ধু বান্ধবদের পাল্লায় পড়ে দুই বছর আগ থেকে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে ২৪ বছর বয়সী রিয়াজ।

এই নেশার জন্য দিনে প্রায় ৩৭ ডলার খরচ করে সে।

“আমার কখনও মাদক খুঁজে পেতে সমস্যা হয়নি, যখন থেকে আমি এটা নেয়া শুরু করেছি। টাকা থাকলেই সব সময় এটা পাবেন আপনি”।

কাশ্মীরে এখন তরুণদের মধ্যে মাদকাসক্তি প্রতিদিনই বাড়ছে।

এখনও স্পষ্ট নয় যে মাদকাসক্তের সংখ্যা ঠিক কতো। তবে ডাক্তার আর বিশেষজ্ঞদের হিসেবে এই সংখ্যাটা কয়েক শ’তো হবেই।

শ্রীনগরের রাষ্ট্রিয় অর্থায়নে পরিচালিত শ্রী মহারাজা হারি সিং হাসপাতালের পুনর্বাসন কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী এই সঙ্কটের মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে।

গত বছর, এই কেন্দ্রে ছয় শতাধিক মাদকাসক্তের চিকিৎসা করা হয়েছে। অধিকাংশ রোগীর বয়স ১৫ থেকে ৩০ এর ভেতরে আর এদের ৮০ শতাংশই হেরোইনে আসক্ত।

কাশ্মীরে আরও তিনটি মাদক পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে।

শ্রী মহারাজা হারি সিং সেন্টারে কাজ করেন কাশ্মীরের মানসিক স্বাস্থ্য ও স্নায়ুবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আরশাদ হোসেন। তিনি বলেন, “আমাদের কেন্দ্রে আমরা আট বছর বয়সী মাদকাসক্তও পেয়েছি”।

“মাদক সমস্যার বহু কারণ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে সচেতনতার অভাব, সহজলভ্য, বন্ধুদের চাপ এবং সঙ্ঘাতপূর্ণ এলাকায় বসবাস”।

তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, কাশ্মীরীদের প্রতিনিয়ন যে অনিশ্চয়তা, মানসিক আঘাত, উদ্বেগের মধ্যে বাস করতে হয়, সেটার মধ্যে টিকে থাকতে অনেকে মাদক ব্যবহার করে।
কাশ্মিরে প্রতিবছরই পপির উৎপাদন বাড়ছে, ছবি: সামির মুশতাক
ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত মরফিন এবং কোডেইন বা বেঞ্জোডিয়াজেপাইন নব্বই দশকের শেষের দিকে প্রথম মাদক হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। পরে গাঁজার ব্যবহার বেড়ে যায় এবং এমনকি সামাজিকভাবেও গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায়।

কিন্তু বিগত কয়েক বছর হেরোইন ও কোকেনের মতো উচ্চমাত্রার মাদক – যেগুলোর স্বাস্থ্য ও আর্থিক ঝুঁকি অনেক বেশি – এগুলোর ব্যবহার বেড়ে গেছে।

গত ১২ জুন সরকারের নিয়োগকৃত একদল কর্মকর্তা দক্ষিণ কাশ্মীরের কিছু পপি ক্ষেতে অভিযান চালিয়ে সেগুলো ধ্বংস করে। এই পপি থেকেই আফিম তৈরি হয়। এই ধরনের অভিযান আগেও চালানো হয়েছে।

আনন্তনাগ গ্রামে পপি ধ্বংস করতে করতে এক সরকারি কর্মকর্তা জানালেন, “এ বছর প্রচুর পপি চাষ করেছে মানুষ”।

স্থানীয়রা পপি ও গাঁজার চাষ বাড়িয়ে দিয়েছে এবং এগুলো অবৈধভাবে বিক্রি করছে।

চলতি বসন্তে জম্মু ও কাশ্মির এক্সাইজ ডিপার্টমেন্ট ৫০০ একর পপি ক্ষেত ধ্বংস করেছে, এর মধ্যে ২৩৩ একরই হলো দক্ষিণ কাশ্মীরে।

এই অঞ্চলে মাদক উৎপাদনে সবচেয়ে শীর্ষে আছে অস্থির পুলওয়ামা জেলা। কর্মকর্তারা এই জেলায় ১২২ একর জমির পপি ধ্বংস করেছে।

সরকারি বিভাগের এক মুখপাত্র আল জাজিরাকে বলেন, “অন্যান্য বিভাগ থেকে আমরা পপি ও গাঁজা চাষের তথ্য সংগ্রহ করি এবং এরপর সেগুলো ধ্বংসের জন্য পুরোদমে অভিযান চালাই। অনেক সময় এইসব চাষের সাথে জড়িতদের ক্ষোভের শিকার হতে হয় আমাদের, কিন্তু এ রকম পরিস্থিতিতে আমরা পুলিশের সহায়তা নেই”।

এই মাদকগুলো শুধু স্থানীয়রাই সেবন করছে না বরং, এগুলো ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও পাচার করা হচ্ছে।

মাদকের অবৈধ বাণিজ্য, পাচার বন্ধে সরকারের প্রচেষ্টা থাকলেও নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে এড়িয়ে যাওয়া পথ খুঁজে বের করে পাচারকারীরা।

জুন মাসে জম্মু অঞ্চলের একটি চেকপয়েন্ট থেকে দুজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। ২৬০ গ্রাম হেরোইনসহ ধরা পড়ে তারা।

পুলিশ বলছে, জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে যে, এই পাচারকারীরা একটা চক্রের সাথে জড়িত, যাদের সশস্ত্র গ্রুপ হিজবুল মুজাহিদিনের সাথে যোগ রয়েছে।

জম্মু পুলিশের জেনারেল ইন্সপেক্টর এম কে সিনহা বলেন: “হিজবুল মুজাহিদীন তাদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাদক পাচার করছে”।

তবে, হিজবের মুখপাত্র সেলিম হাশমি এই দাবি নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, তার সংগঠন “ইসলামের জন্য এবং কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে। আমাদের সংগঠনের সাথে মাদকের দূরতম সম্পর্কও নেই”।

বিশেষজ্ঞ, প্রচারণাকারী ও স্থানীয় নেতারা মাদকের ব্যপারে সচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়টিকে সমর্থন করেছেন।

গত ১০ জুলাই, এক দল মুসলিম স্কলার, নাগরিক অধিকার কর্মী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতারা শ্রীনগরে এই মাদক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন।
অতিরিক্ত মাদক সেবনে দুই ব্যক্তির মৃত্যুর প্রতিবাদে গত ১১ জুলাই কাশ্মিরের অনন্তনাগে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, ছবি: সামির মুশতাক
বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা মিরওয়াইজ উমর ফারুক স্বীকার করেন যে, পুরো উপত্যকা জুড়েই নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যেই মাদক ব্যবহারের মাত্রা বেড়ে গেছে।

তিনি বলেন, “এটার সহজলভ্যতার বিষয়টির সুরাহা করতে হবে যাতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করা যায়”।

রাজনীতিবিদরাও এটা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া জম্মুর নেতা মোহাম্মদ ইউসুফ তারিগামি গত ১২ জুলাই সামগ্রিকভাবে সমাজের উদ্দেশ্য আবেদন জানান যাতে সবাই “এই সমস্যার সমাধানে সজাগ হয়, যেটা আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিচ্ছে”।

অন্যদিকে, বেশকিছু শহর ও গ্রামে তরুণদের উপর নজরদারির চেষ্টা করা হচ্ছে।

অনন্তনাগের কুলার গ্রামের অধিবাসী ইশাক বেগ বললেন, “আমরা স্থানীয়দের নিয়ে একটা গ্রুপ তৈলি করেছি যারা তরুণদের উপর নজর রাখছে যে কেউ মাদকাসক্ত হয়ে পড়লো কি না। মাদক সমস্যার সমাধানে আমরা একসাথে কাজ করছি”।

কিন্তু ফায়েজের* মতে পুনর্বাসন কেন্দ্রে প্রশিক্ষিত পেশাদার লোকের প্রয়োজন খুবই বেশি। এক বছর আগে পুনর্বাসন কেন্দ্রে ৪৫ দিন কাটিয়ে এসেছে সে।

ফায়েজ এখন একটি দোকান চালায়। সে আল জাজিরাকে জানালো, “শুরুতেই আমার ধূমপানের অভ্যাস ছিল। পরে কলেজে আমি গাঁজায় আসক্ত হয়ে পড়ি। কিভাবে এটা গাঁজা থেকে কোডেইনের দিকে এবং এরপর হেরোইনের দিকে গড়ালো, বলতে পারবো না”।

“অসংলগ্ন আচরণের কারণে আমার পরিবারের লোকেরা আমাদের সন্দেহ করেছিল। আমাকে ডাক্তারের কাছে নেয়া হযেছিল এবং সেখান থেকে আমাকে পরে মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে নেয়া হয়।

“এমনকি এখনও যখন আমার অতীতের কথা মনে পড়ে, আমার চোখে পানি চলে আসে”।

(*পরিচয় প্রকাশ না করার স্বার্থে নাম পরিবর্তন করা হয়েছে)

No comments

Powered by Blogger.