জাপানে মাফিয়া দলের সদস্য ছিল সেলিম: ছোটবেলা থেকেই বেপরোয়া by রুদ্র মিজান

শৈশব থেকেই বেপরোয়া ছিলেন সেলিম প্রধান। মাদক ও নারীর নেশা তার বেশ পুরনো। স্কুলের গণ্ডি না পেরুলেও দেশে-বিদেশে গড়েছেন সম্পদের পাহাড় । অল্পতেই ঘনিষ্ঠ হয়ে যেতেন প্রভাবশালীদের। যে দলই সরকারে থাকতো তাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলতেন তিনি। চতুর সেলিম প্রধান আর্ন্তজাতিক সন্ত্রাসী, মাফিয়াদের সঙ্গে মিশে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শক্তিশালী করেছেন নিজের অবস্থান। জাপানের সন্ত্রাসী, মাফিয়া গ্রুপ ইয়াকুজা’র সক্রিয় সদস্য তিনি। অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ও ব্যবসার জন্য জাপানে তিনি তালিকাভূক্ত অপরাধী।
অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহারের জন্য সেখানে কারভোগও করেছেন মাফিয়া ডন সেলিম প্রধান। এছাড়াও ঢাকাসহ কোরিয়া, থাইল্যান্ডে রয়েছে তার অপরাধ সাম্রাজ্য।
রাত হলেই মদ ও নারীতে মেতে উঠতেন সেলিম প্রধান। প্রায় রাতেই গুলশানের বাসায় আয়োজন করা হতো পার্টির। এসব পার্টিতে অংশ নিতেন প্রভাবশালী বেশ কয়েক রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কয়েক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। বিশেষ এই ব্যক্তিদের মনোরঞ্জনের জন্য প্রস্তুত থাকতো থাই ও কোরিয়ান সুন্দরী। তবে প্রভাবশালী এক নেতার অনুরোধে একাধিকবার রাশিয়ান তরুণীদেরও এনেছিলেন গুলশানের পার্টিতে। সেলিমের পার্টিতে শোবিজ জগতের অনেকেই অংশ নিতেন। নাচ ও গানে মাতিয়ে রাখতেন রাতভর। মাসে একাধিকবার পার্টি গার্ল পরিবর্তন করতেন সেলিম। সূত্রমতে, সেলিমের নেশা মূলত তিনটি। টাকা, মদ ও নারী। শৈশব থেকেই এই নেশায় পেয়ে বসে থাকে। দেশে-বিদেশে বিপুল সম্পদের পাশাপাশি জাপানি, আমেরিকান, রাশিয়ান ও বাংলাদেশি মিলে পাঁচটি বিয়ে করেছেন তিনি। স্ত্রী ছাড়াও একাধিক নারী সঙ্গ ছিলো তার প্রতি রাতের রুটিন।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডের টি-৩৪ নম্বর বাসাটি ছিলো সেলিম প্রধানের পিতা হান্নান প্রধানের। ওই বাসার দ্বিতীয় তলায় পরিবারের সঙ্গে শৈশব-কৈশোর কেটেছে সেলিমের। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে মেজো সেলিম। কয়েক বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন নাদিম প্রধান। বর্তমানে তারা দুই ভাই। তারা লেখাপড়া করতেন মোহাম্মদপুর বেঙ্গল মিডিয়াম স্কুলে। সেলিম প্রধানের ঘনিষ্ঠরা জানান, সেলিম ও তার বড় ভাই আলম প্রধান এবং ছোট ভাই নাদিম প্রধান কেউই স্কুলের গন্ডি পেরুতে পারেননি। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন সেলিম প্রধান। ওই সময়ে দুটি বেবিটেক্সি ছিলো তাদের। কিছুদিনের মধ্যে একটি মিনিবাস কিনেন। লেখাপড়া না হলেও ছোটবেলা থেকেই সহপাঠী-বন্ধুদের চেয়ে অনেক বেশি টাকা ব্যয় করতেন সেলিম। কিশোর বয়সেই মাদক ও জুয়ায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেন তিনি। বখাটেদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন মহল্লার মোড়ে। সময়টা আশির দশকের শেষের দিক। মোহাম্মদপুরের সুন্দরী কিশোরীরা রেহাই পেতো না তার যৌন হয়রানি থেকে। এরকম অভিযোগ ছিলো প্রায় নিত্য দিনের।
৮৯ সালের দিকে সেলিমের বড় ভাই আলম পাড়ি দেন জাপানে। শ্রমিক হিসেবে জাপানে পৌঁছে কিছুদিনের মধ্যেই প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন জাপানী তরুণীর সঙ্গে। তাকে বিয়েও করেন আলম। জাপানের ধনাঢ্য মা-বাবার একমাত্র সন্তান ওই তরুণী। শ্বশুর-শ্বাশুড়ির মৃত্যুর পর বিশাল সম্পদ চলে আসে আলম প্রধানের অধীনে। মোহাম্মদপুরের বাড়ি ছেড়ে গুলশানে বসবাস করতে থাকে এই প্রধান পরিবার। ৯০ দশকের শুরুতেই জাপানে পাড়ি দেন সেলিম। জাপানে পা দিয়েই আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন তিনি। অল্প দিনের মধ্যেই সম্পর্ক গড়েন সন্ত্রাসীদের সঙ্গে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, জাপানের বিভিন্ন ক্লাবে, বারে ছিলো সেলিমের নিয়মিত আড্ডা। মাফিয়া সন্ত্রাসী সংগঠন ইয়াকুজা’র সদস্য হয়ে বৈধ-অবৈধ নানা ব্যবসায় জড়িত হন সেলিম প্রধান। অস্ত্র, জুয়া ও পতিতা বাণিজ্যে অন্যতম মাফিয়া হয়ে উঠেন। এরইমধ্যে জাপানে বিয়ে করেন তিনি। তবে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসায় জড়িত থাকার অপরাধে জাপানের গোয়েন্দাদের নজরে পড়েন সেলিম। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান আমেরিকায়। সেখান থেকে লন্ডনে, থাইল্যান্ডে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। মাঝে-মধ্যে পা রাখতেন ঢাকায়। জাপানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ওয়ান্টেড হওয়ার পর বিপাকে ছিলেন তিনি। জাপানে নিজের বিপুল অর্থ বিনিয়োগ ছিলো। আমেরিকায় বিয়ে করে চেষ্টা করেন জাপানে পাড়ি দিতে। অতঃপর জাপানে গিয়ে আটকে যান গোয়েন্দা জালে। সেখানে দীর্ঘদিন কারাবাসের পর ফিরেন ঢাকায়।
বিএনপি তখন ক্ষমতায়। গিয়াস উদ্দিন আল মামুন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। তার সঙ্গে সখ্যতা গড়েন সেলিম। ‘উই আর ডিফরেন্ট’ স্লোগান নিয়ে গড়েন ‘প্রধান গ্রুপ’ নামে গ্রুপ অব কোম্পানী। এই গ্রুপের অধীনে বাংলাদেশে প্রথম বেসরকারি খাতে গড়ে তোলেন ‘জাপান বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপার্স লিমিটেড’ নামে প্রিন্টিং প্রেস। ওই সময়ে প্রভাব খাটিয়ে সরকারি বিভিন্ন কাজ করতেন সেলিম। এক-এগারোর সময়েও বহাল তবিয়তে ছিলেন অদৃশ্য ছায়ার বদৌলতে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কয়েক নেতা, প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়েন সেলিম প্রধান। সেলিমের বাসার দেয়ালে প্রভাবশালী অনেকের সঙ্গে তোলা ছবি টানানো থাকতো।
সূত্রমতে, বেপরোয়াভাবে সেলিম প্রধানের উত্থান শুরু হয় ২০১০ সাল থেকে। ওই সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক থেকে ৪৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ঋণ নেন তিনি। গত বছরে সেলিমের প্রতিষ্ঠান ‘জাপান বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপার্স লিমিটেড’র কাছে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২৪ কোটি টাকা। প্রভাবশালীদের তদবিরের জোরে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা পেয়েছেন সেলিম প্রধান। গত বছরের শেষের দিকে প্রধান গ্রুপের অধীনে পি২৪ গেইমিং নামক অনলাইন ক্যাসিনো স্পা ও বিউটি সেন্টার চালু করেন সেলিম প্রধান। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, অনলাইন ক্যাসিনোর মাধ্যমে উপার্জিত শত শত কোটি টাকা থাইল্যান্ড ও কোরিয়ায় পাচার করেছেন সেলিম প্রধান। তার স্পা সেন্টার ও বাসায় প্রতি রাতে বসানো হতো রিক্রিয়েশন পার্টি। মূলত প্রভাবশালী নেতা, সরকারি কর্মকর্তাদের প্রমোদালয় ছিলো তার বাসা ও স্পা সেন্টার।
গত ১৮ই সেপ্টেম্বর থেকে দেশে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরু হলে আতঙ্কে ছিলেন সেলিম প্রধান। ক্যাসিনো ব্যবসায়ী লোকমান গ্রেপ্তারের পর আত্মগোপনে ছিলেন তিনি। ৩০শে সেপ্টেম্বর দুপুরে থাইল্যান্ডে যেতে পা দেন হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে। সেখান থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। সেলিম প্রধানের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের গাউসিয়া এলাকায়।
গুলশান থানার ওসি কামরুজ্জামান জানান, সেলিম প্রধানসহ তার দুই সহযোগীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত দুটি মামলা তদন্ত করবে ডিবি ও সিআইডি। আদালতের নির্দেশে শুক্রবার রিমান্ডে নিয়ে তাদের এসব বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

No comments

Powered by Blogger.