দুপুরের আগেই টিসিবি’র পিয়াজ শেষ

ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ায় দেশে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায় পিয়াজের দাম। এর প্রেক্ষিতে পণ্যটির দাম কমাতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে খোলা বাজারে পিয়াজ বিক্রি শুরু করে সরকার। কিন্তু দাম কম ও চাহিদা খুব বেশি থাকায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দুপুরের আগেই শেষ হয়ে যায় টিসিবির গাড়িতে থাকা পিয়াজ। গাড়িতে প্রতি কেজি পিয়াজের দাম রাখা হচ্ছে মাত্র ৪৫ টাকা। একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ দুই কেজি পিয়াজ কিনতে পারেন।
সরজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর ৩৫টি স্থানে টিসিবির মাধ্যমে পিয়াজ বিক্রি হলেও লাইনে দাঁড়িয়েও পিয়াজ পাননি না বলে অভিযোগ করেছেন ভোক্তারা। এছাড়া সরবরাহ কম থাকা, সঠিক সময়ে পিয়াজের ট্রাক না আসাসহ বেশকিছু অভিযোগ করেন ক্রেতারা।
গতকাল রাজধানীর সচিবালয় গেটে গিয়ে দেখা যায়, বেলা না গড়াতেই ফুরিয়ে গেছে পিয়াজ।
অন্যান্য পণ্য থাকলেও পিয়াজ শেষ। এদিকে, দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও পিয়াজ না পেয়ে ফেরত যেতে হয়েছে অনেককেই।
এক ক্রেতা বলেন, সকাল ১০টার দিকে এসে দেখি টিসিবির গাড়ি এখনও আসেনি। তাই নিজের কাজ শেষ করে এসে দেখছি পিয়াজ শেষ। তারেক নামে এক ক্রেতা পিয়াজ কেনার পর পলিথিন খুলে দেখান তার মধ্যে বেশ কিছু পচা পিয়াজ। আর রয়েছে অতিরিক্ত আবর্জনা। আর পিয়াজের সাইজও তুলনামূলক অনেক ছোট। তিনি বলেন, দাম কম বলেই এই পিয়াজ কিনছি, তা না হলে কিনতাম না।
টিসিবি’র এক পিয়াজ বিক্রেতা বলেন, প্রতিদিন ৪০০ কেজি করে পিয়াজ পাই। আজ (গতকাল) পিয়াজের ক্রেতা একটু বেশি, তাই দ্রুত শেষ হয়ে গেছে। টিসিবির প্রতিটি গাড়িতে ১ হাজার কেজি পিয়াজ দেয়ার কথা থাকলেও তারা ৪০০ কেজি করে প্রতি গাড়িতে পিয়াজ দিচ্ছে।
এ বিষয়ে টিসিবির মুখপাত্র মো. হুমাউন কবির বলেন, এতদিন প্রতি ট্রাকে ৪০০ কেজি পিয়াজ দেয়া হয়েছে। শনিবার থেকে ১ হাজার কেজি করে পিয়াজ দেয়া হবে। তখন পিয়াজ না পাওয়ার ভোগান্তি থাকবে না। তিনি বলেন, পিয়াজ নিয়ে আতঙ্কিত হবার কিছু নেই। প্রতিদিনই মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পিয়াজ আসছে। ফলে ২/১ দিনের মধ্যে পিয়াজের দাম কমে যাবে বলে আশা করছি। বর্তমানে রাজধানীর ৩৫টি স্থানে পিয়াজ বিক্রি করা হচ্ছে। প্রয়োজনে তা আরো বাড়ানো হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
জানা গেছে, কোরবানি ঈদের পর থেকেই পিয়াজের দাম বাড়তে শুরু করে। এরপর হঠাৎ করেই ভারত পিয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ায় এক লাফে দাম বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ১৩০ টাকায়। তবে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়া পিয়াজের দাম কমতে শুরু করেছে। পুরান ঢাকার শ্যামবাজারের আড়তে গত দুই দিনে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটির দাম কেজিপ্রতি ২৫-৩০ টাকা কমেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। অবশ্য খুচরা বাজারে ততটা প্রভাব পড়েনি। শ্যামবাজারে প্রতি কেজি দেশি পিয়াজ ৭০ থেকে ৭৫ টাকা, ভারতীয় পিয়াজ ৬৫ থেকে ৭০ টাকা এবং মিয়ানমারের পিয়াজ ৫৮ থেকে ৬০ টাকা দরে বিক্রি হয় বলে জানান ব্যবসায়ীরা। ঢাকার কয়েকটি খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দেশি পিয়াজ কেজিপ্রতি ১০০ টাকা এবং ভারতীয় পিয়াজ ৯০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ফলে, আগের চেয়ে দাম কেজিপ্রতি ১০ টাকার মতো কমেছে। অবশ্য কোথাও কোথাও সেরা মানের দেশি পিয়াজের দাম কেজিপ্রতি ১২০ টাকায় উঠেছিল, যা এখন ১১০ টাকায় নেমেছে।
ভারত রপ্তানি বন্ধের আগে শ্যামবাজারে প্রতি কেজি ভারতীয় পিয়াজ ৫৫-৫৬ এবং দেশি পিয়াজ ৬০-৬৫ টাকায় বিক্রি হতো। খুচরা বাজারে বাছাই করা দেশি পিয়াজ ৭৫-৮০ টাকা, সাধারণ দেশি পিয়াজ ৭০ টাকা এবং ভারতীয় পিয়াজ ৬০-৬৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করতেন বিক্রেতারা। ফলে দেখা যাচ্ছে, পাইকারিতে দাম আগের দরের কাছাকাছি চলে এসেছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বুধবারের কেনা দেশি পিয়াজ ১১০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। তবে বৃহস্পতিবার কেনা প্রতি কেজি পিয়াজ ১০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। তারা বলছেন, দু’একদিনের মধ্যে দাম আরো কমবে। শান্তিনগরের পিয়াজ ব্যবসায়ী বলেন, ভারত পিয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ার ফলে হঠাৎ করে দাম বেড়েছে। তবে মিয়ানমারসহ অন্যান্য দেশ থেকে সরকার জরুরি ভিত্তিতে পিয়াজ আমদানি করায়, বিদ্যমান সংকট কমে আসছে। এ কারণে পিয়াজের দাম কমছে।
বুধবার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, আগামী দুই-এক দিনের মধ্যে পিয়াজের দাম ৮০ টাকায় নামবে। এরই মধ্যে মিয়ানমার থেকে ৪৮৩ টন পিয়াজ আনা হয়েছে। আরো ৫০০ টন পিয়াজ দেশে পৌঁছানোর অপেক্ষায়। মন্ত্রী বলেন, প্রতিদিনই পিয়াজ কম বেশি আমদানি করা হচ্ছে। কেজি প্রতি পিয়াজের আমদানি মূল্য ৪৫ টাকা। পাইকারি মূল্য, যাতায়াত মূল্য, সব মিলিয়ে ৫০ কিংবা ৬০ টাকা কেজি হওয়া উচিৎ। পিয়াজের দাম বৃদ্ধির কারণ খুঁজতে ১০টি মনিটরিং টিম কাজ করছে। বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং গুদামকে জরিমানা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে প্রতিবছর দেশে পিয়াজের চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে গত ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে দেশে উৎপাদন হয়েছে ২৩.৭৬ লাখ টন। এছাড়া এই সময়ে আমদানি ১০ থেকে ১১ লাখ টন পিয়াজ আমদানি হয়েছে। ফলে, দেশে পর্যাপ্ত পিয়াজ মজুত থাকার পরেও দাম বেড়েই চলেছে।
যে ৩৫টি স্থানে পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে: সচিবালয়ের গেট, জাতীয় প্রেস ক্লাব, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল, বাংলাদেশ ব্যাংক চত্বর, দৈনিক বাংলা মোড়, শাহজাহানপুর বাজার, ফকিরাপুল বাজার ও আইডিয়াল জোন, মতিঝিল বক চত্বর, ভিক্টোরিয়া পার্ক, কাপ্তান বাজার, শান্তিনগর বাজার, মালিবাগ বাজার, বাসাবো বাজার, রামপুরা বনশ্রী, খিলগাঁও তালতলা বাজার, রামপুরা বাজার। এছাড়া সায়েন্সল্যাব মোড়, নিউ মার্কেট/নীলক্ষেত মোড়, ঝিগাতলা মোড়, পলাশী মোড়, শ্যামলী/কল্যাণপুর, খামারবাড়ি ফার্মগেট, রজনীগন্ধা সুপার মার্কেট, কলমীলতা মোড়, কচুক্ষেত, আগারগাঁও তালতলা ও নির্বাচন কমিশন অফিস। অন্যদিকে, উত্তরার রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্স, আশকোনা হাজি ক্যাম্প, মহাখালী কাঁচাবাজার, মিরপুর-১ নম্বর মাজার রোড, মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বর, শেওড়াপাড়া বাজার, মোহাম্মদপুর টাউনহল কাঁচাবাজার, দিলকুশা, মাদারটেক নন্দীপাড়া কৃষি ব্যাংকের সামনে টিসিবির পেঁয়াজ বিক্রি করা হচ্ছে।
এদিকে, পিয়াজ রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। এর জেরে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার পিয়াজের বাজারে আগুন লেগেছে। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ও নেপালের। এই তিন দেশে কোথাও দ্বিগুণ, কোথাও বা তিনগুণ বেড়ে গেছে পিয়াজের দাম। কলম্বোতে এখন পিয়াজের দাম শ্রীলঙ্কার মুদ্রায় ২৮০ থেকে ৩০০ (ভারতীয় মুদ্রায় ১২০ থেকে ১৩০ টাকা)। শ্রীলঙ্কা ইতিমধ্যেই চীন এবং মিশর থেকে আমদানির অর্ডার দিয়েছে। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর এক সবজির বাজারে গৃহিণী সীমা পোখারেল রয়টার্সকে বলেন, পিয়াজের এবারের মূল্যবৃদ্ধি রীতিমতো ভয়ংকর। গত মাসের তুলনায় এবার দামটা দ্বিগুণ।

No comments

Powered by Blogger.