যেভাবে কোটিপতি নবীদুল

নবীদুল ইসলাম (৩৬)। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউপির চেয়ারম্যান। অল্প সময়ের ব্যবধানে বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি, প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান তিনি। সম্প্রতি সরজমিনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। কিশোর বয়সেই নিষিদ্ধ চরমপন্থি দলের সঙ্গে দরিদ্র নবীদুলের সখ্য গড়ে ওঠে। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অন্ধকার জগৎ ছেড়ে তার বাহিনীর সঙ্গে নবীদুলও আলোর পথে চলে আসেন। ৩ বছরের ব্যবধানে ২০০১ সালে সয়দাবাদ ইউনিয়নের জনপ্রিয় চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা বেলাল হোসেন খুন হন। নবীদুল ওই মামলায় প্রধান আসামিদের তালিকায় থাকলেও সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে সকল আসামি পরে মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন।
২০০৪ সালে বিএনপি সমর্থক নবীদুল আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। এরপর তিনি ইউপির ৫নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মনোনীত হন। এরপর অভাবের কারণে ছোটখাটো অপরাধে জড়িয়ে পড়তে থাকেন তিনি। ২০০৭ সাল পর্যন্ত তিনি অভি এন্টারপ্রাইজ বাসে হেলপারিও করেছেন। এ অবস্থায় দলের ভেতরেও তিনি ধীরে ধীরে নিজের প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। ২০১০ সালে মূলিবাড়িতে বেগম খালেদা জিয়ার জনসভাস্থলে ট্রেন পোড়ানোর ঘটনার পর নবীদুলের ভাগ্য খুলতে থাকে। আলোচিত এ ঘটনাকে পুঁজি করে তিনি মামলা থেকে বাঁচতে এবং মামলায় ফাঁসাতে বিএনপি সমর্থিত কারিগর ও প্রামাণিক সম্প্রদায়ের তালিকা করে বিশাল অর্থ-বাণিজ্য করেন বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এ অবস্থায় বিশাল বাহিনী গঠন করে ধীরে ধীরে তিনি পুরো এলাকা নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন। বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড়ে অবস্থিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিক নিয়ন্ত্রণ, সেখানকার পুরাতন সরঞ্জাম ক্রয়-বিক্রয় হতো তার মাধ্যমেই। অভিযোগ রয়েছে, পূর্বমোহনপুর চর থেকে অবৈধভাবে বালু কেটে ট্রাকে করে বিক্রির কমিশন পেতেন। এছাড়াও পঞ্চসোনা ও গাছাবাড়ির বালুমহালও চলতো তার ইশারায়। বঙ্গবন্ধু সেতু কর্তৃপক্ষের জায়গায় মহাসড়কের মুলবাড়ির এলাকায় তার নেতৃত্বে অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয় ট্রাক লোড-আনলোড পয়েন্ট। যেখানে অর্ধশতাধিক ট্রাক প্রতিদিন মালামাল লোড-আনলোড করে এবং ২ শতাধিক শ্রমিক এ কাজে জড়িত। এছাড়াও এলাকার মাদক ব্যবসায়ীরা তার ছত্রছায়ায় ব্যবসা করে বলেও গুঞ্জন রয়েছে। ২০১৫ সালে সদর থানা আওয়ামী লীগের ক্রীড়া সম্পাদক সাইফুল ইসলাম খুন হন। এ মামলা থেকে বাঁচাতে বিএনপির প্রভাবশালী নেতাদের কাছে থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে নবীদুলের বিরুদ্ধে।
একই বছরে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ পান তিনি। এ অবস্থায় ২০১৬ সালে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন নবীদুল। ২০১৮ সালে দলের সম্মেলনে আবারও সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন তিনি।
এসব পদ-পদবি ও প্রভাব খাটিয়ে নবীদুল ইতিমধ্যেই ২০টির মতো ট্রাক কিনেছিলেন, বর্তমানে ১২-১৩টি আছে। প্রায় ৪০ লাখ টাকায় কেনা মাইক্রোবাসে চলাচল করেন। মহাসড়কের পাশে মুলিবাড়ী এলাকায় ক্রয়কৃত সাড়ে ৪ শতক জায়গায় নির্মাণ করেছেন বিলাসবহুল ৫তলা ভবন। যা বর্তমানে ছাত্রাবাস হিসাবে ভাড়া দেয়া হয়েছে। পৈতৃক ভিটায় রয়েছে ২তলা বিশিষ্ট আরেকটি ভবন। সেখানে দুই স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে তার বসবাস। সম্প্রতি হজব্রত পালন করেছেন। তার আগে অন্তত ৫ হাজার লোককে দাওয়াত করে মজলিশ দিয়েছিলেন নবীদুল।
বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড়ের দক্ষিণ অংশে ২২ একর জায়গায় সম্প্রতি গড়ে উঠছে সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্প। সেখানে মাটি ভরাট ও জায়গা প্রস্তুতের ৫ কোটি টাকার কাজেও তার ভাগ রয়েছে।
সরজমিনে গেলে ট্রাক লোড-আনলোড পয়েন্টে দায়িত্বরত আবদুস সালাম জানান, এলাকায় যাই হোক চেয়ারম্যানতো জানেই। লোড-আনলোড পয়েন্ট চেয়ারম্যানের নিয়ন্ত্রণেই আছে। আগে এখান থেকে আয়-রোজগার ভালো হলেও বর্তমানে কিছুটা ভাটা পড়েছে।
নবীদুলের পৈতৃক বাড়ির পাশের প্রতিবেশী মুদি দোকানদার মামুন অভিযোগ করে বলেন, আমার কিছু জায়গা দখল করে নবীদুল ২ তলা বাড়ি ও বাড়ির গেট নির্মাণ করেছেন। তার প্রভাবের কারণে এ বিষয়ে কিছুই করতে পারছি না। সাংবাদিকদের কাছে এমন অভিযোগ করার পর নবীদুল তার দোকানটি বন্ধ করেছে দিয়েছেন।
চেয়ারম্যানের ইচ্ছাই চলে ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম। সমন্বয়হীনতার কারণে অনেক সদস্য পরিষদের আসেন না। এমন অভিযোগ করেছেন ১নং ওয়ার্ডের সদস্য হাজী সেলিম। তিনি বলেন, পরিষদের সকল বরাদ্দ চেয়ারম্যানের ইচ্ছায় ভাগ-বণ্টন হয়। প্রকল্পগুলো সদস্যদের মধ্যে কিছুটা বণ্টন হলেও রাজস্ব খাতের এক ভাগ আয়ের টাকা এককভাবে তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিমপাড় থানার ওসি সৈয়দ শহিদ আলম জানান, লোড-আনলোড পয়েন্টের ট্রাকগুলো সেতুর পারাপারের জন্য মহাসড়কে ওঠার সময় রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। মাঝেমধ্যেই ঘটে দুর্ঘটনা। এখানকার ধুলোবালির কারণে মহাসড়কে চলাচলকৃত যানবাহনগুলোকেও নানা দুর্ভোগ পোহাতে হয়। জায়গাটি সেতু কর্তৃপক্ষের হওয়ায় আমরা সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারছি না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বঙ্গবন্ধু সেতু কর্তৃপক্ষের এক কর্মকর্তা মোবাইলে জানান, মহাসড়কের পাশে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ট্রাক লোড-আনলোড পয়েন্টগুলো উচ্ছেদের জন্য অনেক আগেই জেলা প্রশাসকের অফিসে পত্র দেয়া হয়েছে। তারাই উচ্ছেদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন।
ইউপি চেয়ারম্যান নবীদুল ইসলাম বলেন, অনেক আগে থেকেই আমার দুধেল গরুর খামার আছে। এক সময় হোটেল ব্যবসা করেছি। সে কারণে আমার কিছু টাকা-পয়সা হয়েছে। যে মাইক্রোবাসটি ব্যবহার করি সেটি বড় ভাইয়ের। পৈতৃক ভিটার ২ তলা বাড়ি মায়ের জমানো টাকায় নির্মিত। ৫ তলা ভবনটি আমার নিজস্ব। যমুনা নদীর বালুমহালে আমার কিছু অংশ আছে। মহাসড়কের পাশে অনেক আগে থেকে ২টি লোড-আনলোড পয়েন্ট রয়েছে। যার একটি আমার নিয়ন্ত্রণে চলে। বর্তমানে সেতুর গোলচত্বর থেকে নলকা পর্যন্ত অনেকেই পয়েন্ট গড়ে তুলেছেন। নিজের মালিকানায় ১২টি ট্রাক থাকলেও ৪টির কথা স্বীকার করেন তিনি।
ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাজস্ব খাতের এক ভাগ আয়ের টাকা ইউএনও স্যারের মাধ্যমে মিটিং করেই প্রকল্প তৈরি করা হয়। ওই টাকায় আমি কোনো কাঁচা কাজ করি না, শুধু পাকা বা দৃশ্যমান কাজ করি।

No comments

Powered by Blogger.