যুদ্ধাপরাধ থেকে মার্কিন সেনাদের রক্ষা করার চেষ্টা করছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প

মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত কয়েকজন সেনাকে দায়মুক্তি দিতে প্রয়োজনীয় বিচারিক কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য বিচার মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে ২০১০ সালে আফগানিস্তানে নিরীহ ব্যক্তিকে হত্যার দায়ে ম্যাথিও গোলেস্টিন নামে এক মার্কিন সেনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের কথা উল্লেখ করা যায়। মার্কিন আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেদেশের ইতিহাসে যুদ্ধাপরাধীদের দায়মুক্তির ঘটনা নজিরবিহীন। মার্কিন আইনজ্ঞরা এ জন্য চিন্তিত যে কয়েকজন সেনার দায় মুক্তির জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উদ্যোগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সংক্রান্ত সামরিক ও বিচারিক আইনকে গুরুত্বহীন কিংবা দুর্বল করে দেবে।
মার্কিন সেনারা ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধে নজিরবিহীন যুদ্ধাপরাধ করেছে। এ কারণে মার্কিন কর্মকর্তারা ওই দুই দেশের জনগণের ক্ষোভ ও প্রতিবাদের মাত্রা কমিয়ে আনার জন্য উত্থাপিত বিভিন্ন অভিযোগ তদন্ত করে দেখার কথা বলে। এমনকি যুদ্ধাপরাধের যেসব ঘটনা ঘটেছে সে সম্পর্কে যাতে মিডিয়ায় বেশি হৈ চৈ না হয় সেজন্য তারা প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। এ ব্যাপারে মার্কিন সাময়িকী 'রুলিং স্টোন' এ কথা ফাঁস করে দিয়েছে যে, "মার্কিন সেনারা ইরাক ও আফগানিস্তানে ভয়াবহ যুদ্ধাপরাধ করেছে। এমনকি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পেন্টাগনও স্বীকার করেছে মার্কিন সেনারা প্রকাশ্যে ও ইচ্ছাকৃতভাবে যুদ্ধাপরাধ করেছে এবং এ বিষয়ে তারা অবহিত ছিল।"
বিনোদনের জন্য মানুষ হত্যা, কে কত জনকে হত্যা করতে পেরেছে তা প্রমাণের জন্য নিহত ব্যক্তিদের আঙুল কেটে এনে প্রমাণ হাজির করা, নিহত ব্যক্তিদের সঙ্গে সেলফি তোলা, দুর্বল ইউরেনিয়ামযুক্ত বোমা ব্যবহার যার ফলে ইরাক ও আফগানিস্তানের বহু মানুষ ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রকমের দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে এসবই মার্কিন সেনাদের যুদ্ধাপরাধের কিছু দৃষ্টান্ত।
হত্যা করে সেলফি তুলছে মার্কিন সেনারা
এ ছাড়া, ইরাক ও আফগানিস্তানে হাসপাতাল ও জনসেবামূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলা, নিহত বেসামরিক মানুষের দেহ পুড়িয়ে দেয়া কিংবা কেটে টুকরা টুকরা করা, অমানবিক ও নিষ্ঠুর উপায়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা, ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রাখা, এক সপ্তাহ ধরে ঘুমাতে না দেয়া প্রভৃতি নির্যাতনের কথা উল্লেখ করা যায়।
আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটিও এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ'র জেলখানাগুলোতে আটক বন্দীদেরকে পুরো অন্ধকারের মধ্যে রাখা হয়। অত্যন্ত কষ্টদায়ক উচ্চ শব্দযুক্ত মিউজিক বাজানো হয়। এমনকি শীতের মৌসুমে ঘর গরম করার ব্যবস্থা না করায় প্রচণ্ড শীতে অনেক বন্দীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। আফগানিস্তানের বালখ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ ফরহাদ আজিমি বলেছেন, তার দেশে মার্কিন সেনাদের যুদ্ধাপরাধের বহু প্রমাণ রয়েছে কিন্তু হোয়াইট হাউজ এসব ঘটনা প্রকাশে বাধা সৃষ্টি কোরে বিচারের হাত থেকে তাদেরকে রক্ষা করছে। তিনি বলেন, ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের যুদ্ধাপরাধ তদন্ত ও বিচারের ব্যাপারে মার্কিন সরকার ও বিচারবিভাগের অনীহার কারণে শেষ পর্যন্ত হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে এ সংক্রান্ত অপরাধ বা বিভিন্ন অভিযোগ বিচারাধীন রয়েছে।
২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের কার্যকলাপ ও যুদ্ধাপরাধের নানা অভিযোগের তদন্ত ও বিচার শুরু হয়। এরপর আদালতের পক্ষ থেকে জানানো হয় তারা ১১২টি অভিযোগ তদন্ত করেছে। যদিও আমেরিকা আন্তর্জাতিক আদালতের সদস্য নয় কিন্তু তারপরও আদালতের কৌঁসুলি জানিয়েছেন, মার্কিন সেনারা আফগানিস্তানে যে যুদ্ধাপরাধ করেছে সে বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে। তিনি দেশ দখল, মানবতা বিরোধী অপরাধ ও জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের জন্য মার্কিন সেনাদের বিচারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
যাইহোক, ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের যুদ্ধাপরাধ তদন্তের বিষয়টি যাতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যেতে না পারে সেজন্য মার্কিন সরকার চেষ্টা চালিয়েছে এবং আদালতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনজীবী ও কর্মকর্তাদের আমেরিকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।


মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও যুদ্ধাপরাধ তদন্তের সঙ্গে জড়িতদের আমেরিকায় প্রবেশ করতে না দেয়ার কথা জানান। এমনকি মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন হুমকি দিয়েছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত যদি মার্কিন সেনাদের যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত রাখে তাহলে আদালতের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাসহ অন্যান্য কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে।
ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের যুদ্ধাপরাধ তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে মার্কিন কর্মকর্তাদের হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, আমেরিকা এটাকে তাদের জাতীয় সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন ও একাধিপত্যের প্রতি আঘাত বলে মনে করছে। এ কারণে তারা অন্য দেশে অবস্থিত মার্কিন নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য আত্মসমর্পণমূলক ক্যাপিচুলেশন চুক্তি বা আইন চাপিয়ে দেয়। এ চুক্তি  অনুযায়ী বিদেশে অবস্থানরত আমেরিকার নাগরিকরা কোনো অপরাধ করলে এমনকি কাউকে খুন করলেও তাকে ওই দেশের আইনে বিচার করা যাবে না বরং তাকে মার্কিন কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিতে হবে।
বাস্তবতা হচ্ছে, আমেরিকা বিশেষ করে চরম বর্ণবাদী বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অন্য জাতির চেয়ে আমেরিকানদেরকে শ্রেষ্ঠ জাতি বলে মনে করে। এ কারণে তারা অন্য জাতির সঙ্গে যা ইচ্ছা তাই করছে, এমনকি মার্কিন সেনাদের যুদ্ধাপরাধ বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের পদক্ষেপকেও বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। আফগানিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওয়াহিদ মুশদে মনে করেন, "বিভিন্ন দেশে মার্কিন সেনাদের অপরাধ তদন্তে আমেরিকার বাধাদানের ঘটনা থেকে বোঝা যায়, তারা সত্যিই এ ধরণের অপরাধে জড়িত এবং এ কেলেঙ্কারি যাতে ফাঁস না হয় সেজন্য হোয়াইট হাউজ চেষ্টা চালাচ্ছে।"
যাইহোক, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দেশের সেনাদের দায়মুক্তি দেয়ার বা যুদ্ধাপরাধের বিচার না করার যে চেষ্টা করছেন তার অন্যতম  ও প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে আগামী নির্বাচনে জেতা।


২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসলেও আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনো কোনো ক্ষেত্রেই সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। এ কারণে তিনি মার্কিন সেনাদের অপরাধের বিচার না করে উগ্র ডানপন্থীদের সমর্থন লাভের চেষ্টা করছেন।
আফগানিস্তান ও ইরাকের যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে ফিরে আসা সেনা ও সেনা কমান্ডাররা বিভিন্ন ধরনের অপরাধী কর্মকাণ্ডের কারণে মারাত্মক হতাশা ও উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। এ অবস্থায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাদেরকে এ নিশ্চয়তা দিতে চান যে তাদের কোনো ভয় নেই। ট্রাম্প এটাও দেখাতে চান তিনি যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে ফিরে আসা সেনাদেরকে ভুলে যাননি এবং এভাবে তাদের সমর্থন লাভের চেষ্টা করছেন।
এ কারণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার দেশের সেনাদের যুদ্ধাপরাধ তদন্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের পদক্ষেপে বাধা দেয়ার চেষ্টা করছেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এসব কর্মকাণ্ড বেআইনি ও অমানবিক এবং এর পরিণতি ভাল হবে না। কারণ এর মাধ্যমে মার্কিন সেনাদেরকে ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধাপরাধ চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
আফগানিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাইয়্যেদ ইসহাক দেলজু হোসেইনি বলেছেন, মার্কিন সরকার কোনোভাবেই মার্কিন সেনাদের অপরাধযজ্ঞের বিষয়টি স্বীকার করতে রাজি নয়। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০২০ সালে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যেভাবেই হোক জেতার চেষ্টা করছেন।

No comments

Powered by Blogger.