ব্যাংকপাড়ায় চাপা অস্থিরতা

গত এক দশকে সাড়ে বাইশ হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির জালে আটকা পড়া ব্যাংকপাড়ায় চাপা অস্থিরতা। অস্বস্তি। সংশয়, দ্বিধা। এসবের কিছুই ঠিক কাটছে না। সদিচ্ছার কারণে যেভাবে ক্যাসিনোতে অভিযান চলছে সেভাবে অনেকে আশা করছেন, ব্যাংকখাতেও অনুরূপ অভিযান দরকার। তবে সদিচ্ছা দরকার। খেলাপি ঋণের সুরাহা ছাড়া ব্যাংক গতি পাবে না। গত জুলাইয়ে দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সুদে ১০ বছরে খেলাপি ঋণ পরিশোধের যে সুযোগ বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়েছিল, সেটা আদালত ঘুরে এলেও তা বাস্তবে কী ফল দেবে, সে বিষয়ে কারো কাছে সংশয়মুক্ত খবর নেই। অ্যাটর্নি জেনারেল যদিও বলেছিলেন, শিল্পের স্বার্থেই এটা করা হয়েছে। কিন্তু নিরপেক্ষ দূরে থাক, দলীয় অর্থনীতিবিদরাও বলছেন না যে, সার্কুলারটা কার্যকর হলেই ব্যাংকখাত সচল হবে। হাইকোর্ট ছয় মাস আগে ব্যাংক পরিচালনায় সৎ লোকের নিয়োগে জোর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বেসিকের মতো আর ব্যাংক ধসবে না, সেই নিশ্চয়তা কে দেবে? সেটা কে কখন দেবে কারো জানা নেই। তবে সরকারি খাতে যখন ‘ঋনং ঘৃতং পিবেৎ’’ (ঋণ করে ঘি খাওয়া) চলছে, তখন অনেকেই ২০২৪ সালের দিকে নজর দিচ্ছেন।

কারণ সরকার মেগা প্রকল্পে যতো ঋণ নিয়েছে, এই সময়ে তার কিস্তি দেয়া শুরু হবে। উল্লেখ্য, ২০১৭-২০১৮ সালে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ৫ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা ঋণ করেছিল। গত জুনে বাজেট ঘোষণার সময় অর্থনীতিবিদরা হুঁশিয়ার করে দেন যে, তারল্য সংকটে ভুগতে থাকা ব্যাংকখাত থেকে ঋণের বড় টার্গেট ব্যাংককে আরো দুর্বল করতে পারে। বাজেটে (২০১৯-২০২০) ৭৭,৩৬৩ কোটি টাকা ঋণ টার্গেটের মধ্যে ব্যাংক খাত থেকেই ৪৭,৩৬৩ কোটি টাকা উসুলের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ক্যাসিনোকেন্দ্রিক কালো টাকার সঙ্গে ব্যাংকখাতে অনিয়মের নিবিড় সম্পর্ক। কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি ব্যাংকখাত ধরে টান দিলে ক্যাসিনো আপনা-আপনি মুখ থুবড়ে পড়বে। কারণ কালো টাকার প্রবাহ সৃষ্টির মূলমন্ত্র হলো ব্যাংক থেকে নিজের মনে করে জনগণের টাকা তুলে নেয়া। এবং এরপর সেটা আর ফেরত না দেয়া। সেই হিসাবে ব্যাংকপাড়ায় কিছুক্ষেত্রে যা ঘটেছে বলে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা সময়ে সময়ে দাবি করেছেন, তাতে এটা বলা অতিরঞ্জিত হবে না যে, ‘অনেক ব্যাংক আসলে ইয়ংম্যানস ক্লাব থেকে বহুগুণে বেশি টাকা উড়িয়েছে।

একরাতে ক্যাসিনোতে সোয়া শ’ কোটি টাকা উড়েছে। কিন্তু একটি ব্যাংক থেকে ২৪ ঘণ্টার কম সময়ে হয়তো হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে গেছে। একে কি বলা হবে, ’ ক্যাসিনো ব্যাংক?’ ব্যাংকের কেসিনো সিনড্রোমের সব থেকে বড় শিকার সরকারি ব্যাংক। কেউ কেউ রসিকতা করে বলছেন, তাহলে দেখা যায়, ক্যাসিনো নিয়ে চারদিকে যেভাবে হুলুস্থুল পড়ে গেছে, তাতে মনে হচ্ছে, ব্যাংকিং খাতের চেয়ে ক্যাসিনো বেশি ভয়ঙ্কর। এখানকার ক্যাসিনো এটা দেশের আড়াল করে রাখা জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয়গুলো, যার প্রতিকারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবি রাখে। একজন বিশেষজ্ঞের কাছে জানতে চাইলে তিনি রসিকতা করলেন জবর। বললেন, দেখা যাচ্ছে, ইয়ংম্যানস ক্লাবের মতো নানা ক্লাবের নাম উঠছে। কিন্তু ক্যাসিনো ব্যাংক যাদের সিন্দুক/লকার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে গেছে, তাদের কি হবে। নতুন প্রজন্মের এনআরবি কমার্শিয়াল ও ফারমার্স ব্যাংক খেয়েছে এক হাজার ২০১ কোটি টাকা, সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক কেলেঙ্কারিতে আত্মসাৎ হয়েছে তিন হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা, বিসমিল্লাহ গ্রুপ নিয়েছে এক হাজার ১৭৪ কোটি টাকা, অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট ও থারমেক্স গ্রুপ মিলে ১১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। বেসিক ব্যাংকের জুয়ার অঙ্কটা সর্বোচ্চ সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা।

দেশে ৫৯টি ব্যাংক কার্যক্রম চালাচ্ছে। আরো নতুন নতুন ব্যাংক আসছে। তিনটি পাইপ লাইনে। পেশাদার ব্যাংকাররা হতভম্ব। ওই ৫৯টির মধ্যে ৪১টিই বেসরকারি খাতের। কোনো কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি, সংসদ সদস্য বাবা-মায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যেও ব্যাংক খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকই জানাচ্ছে, ২০০৯ সালে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। পরের দশকটি সকলের নাকের ডগার ওপরে তা প্রায় এক লাখ কোটি টাকায় পৌঁছে যায়। এভাবে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে সাড়ে চার গুণ।
এর বাইরে ব্যাংকগুলোর রাইট অফ বা অবলোপন করা ঋণ ৪৯ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। পুনঃতফসিলকরণ অনেক দেশেই থাকতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে কি ঘটছে? গত বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকই প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার পুনঃতফসিলকরণ করেছে। ২০১২ সালে অনুমোদন পাওয়া ৯টি নতুন বেসরকারি ব্যাংক আসর জমাতে না জমাতে তুরুপের তাস পেটালো ঝটপট। ভাবা যায়? তারা গড়ে প্রত্যেকে প্রায় পৌনে পাঁচশ কোটি টাকার ঋণ ‘খেলাপির’ রেকর্ড গড়তে সক্ষম হলো। কিন্তু তাদের কোনো জবাবদিহি নেই। কেউ অবশ্য ফোড়ন কাটতেই পারেন। বলতেই পারেন, কিছুই হচ্ছে না, তা ঠিক নয়। যিনি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, তার ব্যাংকটিই ফারমার্স ব্যাংক হয়ে গেল পদ্মা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, যার নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন মারফত মানুষ জানতে পেরেছে, কি করে ‘সন্দেহভাজনদের’ যোগসাজশে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হলো, আটশ কোটি টাকার বেশি বেরিয়ে গেল, তিনি কিছুদিন আগেই মন্তব্য করেছিলেন, ‘খেলাপি ঋণ পরিশোধের নিয়মাবলি একেবারেই মানা হচ্ছে না। সাধারণত দুবারের বেশি ঋণ পুনঃতফসিল হয় না। পুনঃতফসিল করলে ঋণের ১০ শতাংশ অবশ্যই নগদে আদায় করতে হবে। কিস্তি থেকে কেটে রাখলে তা হবে না, নগদে আদায় করতে হবে। যদি কেউ পুনঃতফসিলের শর্ত ভঙ্গ করে তবে তা বাতিল হয়ে যাবে।’ তাহলে কি দাঁড়ালো, বাংলাদেশি মিডিয়া এখন ক্যাসিনো গিলছে। মাদকযুদ্ধে চারশর বেশি মানুষ প্রাণ হারানোর পরে ক্যাসিনো ও মদের বোতলের খোঁজ পড়ল। কেউ কেউ রসিকতা করে বলছেন, নৈতিক শুদ্ধিকরণ আগে!

ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের মতে, ঋণ খেলাপিদের বড় ধরনের শাস্তি দিতে হবে। সামাজিকভাবে তাদের একঘরে করে ফেলতে হবে। বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তার কথায়, খেলাপি ঋণ ক্যানসারের মতো। সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেছিলেন, ‘ব্যাংকের টাকা মানেই আমানতের টাকা। এতে ব্যাংক মালিকদের অংশ মাত্র ১০ শতাংশ। ৯০ শতাংশ আমানতের সুরক্ষা দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অথচ ১০ শতাংশের মালিকেরাই এখন সব করছে।’ বিশেষজ্ঞরা যে যা বলেন, তাতে কর্ণপাত নেই কারো।

নিয়ম না মেনে ঋণ বিতরণ, বেনামি ঋণ, সংসদে আংশিক ও অসম্পূর্ণ তালিকা ঘোষণার পরেও টাকা তুলতে নীরব থাকা, সুশাসনের অভাব, রাতারাতি বেসরকারি ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তন করার মন্দ উদাহরণ তৈরি, পরিচালনা পর্ষদে এক পরিবার থেকে দুজন পরিচালক থাকার বিধান শিথিল করে চারজনে উন্নীত করা, ব্যাংকিং খাতে পরিবারতন্ত্র চালুর উদ্যোগের প্রেক্ষাপটে হলমার্কের সঙ্গে নয়া বনিবনার চেষ্টাকে অনেকেই সৎ উদ্যোগ হিসেবে দেখতে নারাজ। বরং একে তারা একটা পরম্পরা হিসেবে দেখছে। কারণ হলমার্কের হলাহল উপাখ্যানের পরে মুহিত সাহেব বলেছিলেন, ও কিছু না। ভালো ব্যাংক হিসেবে সুনাম থাকা বেসিক ব্যাংক হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়ল। আবদুল হাই বাচ্চুর কিছু হলো না। ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে রাঘব বোয়ালরা ধরা পড়ছে। দুদক নতুন নতুন নোটিশ ঠুকছে। কিন্তু দুদক বেসিকের চার্জশিট দেয় না। প্রবল চাপের মুখে দুদক বেসিক বসকে শুধু চা চক্রে ডেকেছিল। ব্যাস এরপর আর কোনো অগ্রগতি নেই।

No comments

Powered by Blogger.