ইয়াবায় আসক্ত হয়ে ভয়ঙ্কর অপরাধে by রুদ্র মিজান

ব্ল্যাকমেইল, চুরি, দেহবিক্রি থেকে শুরু করে নানা অপকর্মে জড়িত তারা। চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই। তারাই এমন অপকর্মে জড়িত থাকতে পারে। তারা প্রত্যেকেই প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন পরিবারের সন্তান। কেউ কেউ বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। পারিবারিকভাবে আর্থিক কোনো টানাপোড়েন নেই তাদের। তারা চুরি, ব্ল্যাকমেইল, দেহ বিক্রি করে মূলত ইয়াবার জন্য। মরণনেশা ইয়াবায় আসক্তদের দিয়ে সহজেই নানা অপকর্ম করাচ্ছে একটি চক্র।
ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবার বিনিময়ে গাড়ি চুরি করাচ্ছে একটি চক্র। সম্প্রতি উত্তরায় এরকম একটি চক্রকে সনাক্ত করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই চক্রের হয়ে উত্তরা, গুলশান ও বারিধারা এলাকার অন্তত অর্ধশতাধিক তরুণ গাড়ি চুরিসহ বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত রয়েছে। একইভাবে অর্থের জন্য দেহবিক্রি করেছে অনেক তরুণী এরকম তথ্যও রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ইয়াবা আসক্তির কারণে অনেকেই আর্থিক সঙ্কটে ভুগে। টাকার অভাবে ইয়াবা কিনতে পারে না। আবার ইয়াবা ছাড়া তাদের চলেও না। এরকম তরুণদের টার্গেট করে চক্রের সদস্যরা। ইয়াবার বিনিময়ে গাড়ি চুরির কাজে ব্যবহার করা হয় তাদের। কয়েক দিন আগে উত্তরা আজমপুর এলাকায় একটি বাসার পার্কিং থেকে প্রাইভেট কার চুরি হয়। বাসার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে চোরকে সনাক্ত করা হয়। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে, চোর হিসেবে যে তরুণকে দেখা গেছে সে মাদকাসক্ত।
সামাজিক-আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত একটি পরিবারের সন্তান। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ণরত। দীর্ঘদিন থেকে মাদকাসক্ত। একাধিকবার মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছেন এই তরুণ। কিছুদিন মাদক থেকে দুরে থাকলেও আবার জড়িয়ে যান। মা-বাবা টাকা না দিলে বাসায় ভাংচুর করেন। কখনও কখনও বাসা থেকে চুরি করে মাদকের টাকা সংগ্রহ করেন এই তরুণ। এভাবে ইয়াবা সেবন করতে গিয়ে পরিচয় হয় উত্তরা এলাকার গাড়ি চোর চক্রের হোতা কবিরের সঙ্গে।
ওই তরুণকে ৫০টি ইয়াবার বিনিময়ে পার্কিংয়ে থাকা গাড়ি চুরির টার্গেট দেয়া হয়। তাকে দেয়া হয় একটি মাস্টার কিউ। টার্গেট অনুসারেই ওই তরুণ নকল চাবি ব্যবহার করে গাড়িটি চুরি করে। একইভাবে উত্তরা এলাকাতেই আরেকটি গাড়ি চুরির টার্গেট দেয়া হয় আরেক তরুণকে। ইয়াবার বিনিময়ে ওই গাড়ি চুরি করতে গেলে ধরা পড়ে যায় সেই তরুণ। বিষয়টি সামাজিকভাবে শেষ হলেও খবর পৌঁছে যায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। এই চক্রটি মূলত মাদক ব্যবসায়ী। নানা কৌশলে গাড়ি চুরি করে ওই গাড়িগুলো মাদক পরিবহনের কাজে ব্যবহার করে চক্রটি।
সূত্রমতে, চক্রটি চট্রগ্রাম থেকে মাদক এনে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এজেন্টদের কাছে সরবরাহ করে। মিরপুর, ভাষানটেক, মোহাম্মদপুর, কাওরানবাজারে রয়েছে এরকম আরও একাধিক চক্র। এসব চক্রের সদস্যরা কিশোরদের দিয়ে ইয়াবার বিনিময়ে ইয়াবা বিক্রি করায়। জানা গেছে, মিরপুর-১১ এলাকায় রুবেল, রশিদ, মামুনসহ বেশ কয়েক কিশোরকে দিয়ে ইয়াবার বিনিময়ে ইয়াবা বিক্রি করানো হয়। এই চক্রের হোতা হিজরা বাবর, কাল্লু। জানা গেছে, এই কিশোরদের প্রথমে ফ্রিতে ইয়াবা সেবন করিয়ে মাদকাসক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ১০ পিস ইয়াবা বিক্রি করলে একটা ফ্রি’র বিনিময়ে তাদের দিয়ে ওই এলাকায় ইয়াবা বিক্রি করানো হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর বেশিরভাগ মাদকাসক্ত কিশোর মাদক কেনার টাকা সংগ্রহের জন্য টানা পার্টির সদস্য হিসেবে চুরি-ছিনতাই করে। এই কিশোরদের একটি গ্রুপ রয়েছে আড়ং সংলগ্ন মানিক মিয়া এভিনিউ, আসাদ গেট, কাওরানবাজার এলাকায়। যানজটে গাড়ি থামলেই টার্গেট করে ব্যাগ ও মোবাইলফোন টেনে নেয় এই কিশোররা।
প্রথমে শখে, কৌতূহল ও ভ্রান্ত ধারণায় ইয়াবায় আসক্ত হন তরুণীরা। আসক্তি যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন একদিনও ইয়াবা ছাড়া চলে না। ঢাকার কয়েক মাদসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন ১১ তরুণীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। রাজশাহীর এক তরুণী জানান, মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তিনি। ঢাকার আজিমপুরে থেকে লেখাপড়া করতেন ইডেন কলেজে। ক্রমশ্য ওজন বাড়ছিলো। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন তিনি। স্লিম হওয়ার জন্য বান্ধবীর পরামর্শে ইয়াবা সেবন শুরু করেন। এক বন্ধুর বাসায় কয়েক জন মিলে প্রায়ই আড্ডা দিতেন। ইয়াবা সেবন করতেন। এক পর্যায়ে আসক্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছে। ইয়াবা ছাড়া একদিনও চলে না। বাড়িতে পাঠানো টাকা খরচ হয়ে যেতো ইয়াবার পেছনে। প্রায়ই ধার-দেনা করতো হতো। এক পর্যায়ে বিভিন্ন তারকা হোটেলের পার্টিতে যাওয়া শুরু করেন। নাচ-গান আর ইয়াবায় বুঁদ হয়ে থাকেন। রাত্রি যাপন করেন অচেনা পুরুষদের সঙ্গে। একইভাবে ইয়াবার জন্য দেহ বিক্রি করে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন আরেক তরুণী। কুড়িল এলাকার ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি। বয়ফ্রেন্ডের পাল্লায় পড়ে ইয়াবা সেবন করেন। একপর্যায়ে টাকার জন্য বাসা থেকে দামি জিনিসপত্র বাইরে বিক্রি করে দিতেন।
মা-বাবা মারধর করতেন। একপর্যায়ে বাসা থেকে বের হয়ে যান। লেখাপড়া ছেলে কুড়িলে আলাদা বাসা নিয়ে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে থাকতেন। দুজনেই আসক্ত। টাকার জন্য মরিয়া। একপর্যায়ে নামতে হয় দেহ ব্যবসায়। শেষ পর্যন্ত ওই তরুণী অসুস্থ হলে বয়ফ্রেন্ড তাকে ছেড়ে চলে যায়। খবর পেয়ে মেয়েকে উদ্ধার করেন মা-বাবা। এই দুই তরুণীই এখন মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন।
এসব বিষয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, মাদকে বুঁদ হয়ে গেলে মাদকের জন্য আসক্ত ব্যক্তি নানা অপরাধ করতে পারে। সেই ব্যক্তি তখন মানসিকভাবে সুস্থ না। তাই তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিতে হবে। পরিবার, স্বজনকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। মাদকাসক্ত বন্ধুদের থেকে দুরে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, হতাশা, সঙ্গদোষ, কৌতূহল ও ভুল ধারণা থেকেই তরুণ-তরুনীরা মাদকাসক্ত হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.