একই অবস্থানে রাশিয়া-ভারত-চীন by পেপে এসকোবার

জাপানের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নানন্দিক স্থাপনার কাছে ম্লান এমন এক বাজে পরিবেশে ওসাকার জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ত্রিপক্ষীয় বৈঠকটি হয়েছে।
নিখুঁত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে জাপানের নামডাক রয়েছে। ফলে এই ব্যবস্থাকে দুর্ভাগ্যজনক একটি ‘ঘটনা’ হিসেবে মেনে নেয়া কঠিন। জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে অনুষ্ঠিত রাশিয়া-ভারত-চীন অনানুষ্ঠানিক বৈঠকটি কোনো ইন্টেরিয়র ডেকোরেটরের হারিকিরি করার মতো ভাগ্য বরণের ঊর্ধ্বে থাকা কোনো স্থানে হওয়া দরকার ছিল।
এই তিন দেশের নেতারা কার্যত গোপনীয়তা বজায় রেখেই বৈঠকে বসেছিলেন। জীর্ণ কক্ষে গুটিকতেক যে মিডিয়া প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন, তাদেরকে অল্প সময়ের মধ্যেই চলে যেতে বলা হয়। প্রেসিডেন্ট পুতিন, শি ও মোদির সাথে নিজ নিজ দল ছিল। তারা বসার জায়গা পর্যন্ত পাচ্ছিল না। কিছুই ফাঁস হয়নি। হতাশাবাদীরা কৌতুক করে বলতে পারেন, কক্ষটিতে হয়তো আড়িপাতার যন্ত্র ছিল। যাই হোক, গুরুত্বপূর্ণ কোনো কিছু নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে শি যেকোনো সময় পুতিন ও মোদিকে বেইজিংয়ে ডাকতে পারেন।
নয়া দিল্লি আড়ালে-আবডালে বলছে যে মোদিই ওসাকার বৈঠকের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। ঘটনাটি আসলে ঠিক তেমন নয়। শি ও পুতিন দীর্ঘ দিন ধরেই গুরুত্বপূর্ণ ইউরেশিয়া একীভূত ত্রিভূজ রোডম্যাপের জন্য মোদিকে রাজি করার যে চেষ্টা করেছিলেন, ওসাকায় সেটিই চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে। আর গত মাসে বিশকেকে অনুষ্ঠিত সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার শীর্ষ সম্মেলনে এ কাজটি অনেক দূর এগিয়েছিল।
এখন রাশিয়া-ভারত-চীন (আরআইসি) পুরোদমে সক্রিয় হয়ে ওঠেছে, সেপেম্বরে ভ্লাদিভস্টোকে ইস্টার্ন ইকোনমিক ফোরামে পরবর্তী বৈঠক হবে বলে স্থির হয়েছে।
সূচনা মন্তব্যে পুতিন, শি ও মোদি পরিষ্কার করেন যে আরআইসি হলো ইউরেশিয়ার জন্য সুদৃঢ় নিরাপত্তা কাঠামো গঠনের বিষয়।
মোদি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বহুপক্ষীয় প্রয়াসের ওপর জোর দেন, আর অভিযোগ করেন যে বৈশ্বিক অর্থনীতি ‘এক পক্ষীয়’ নির্দেশনায় চলছে। তিনি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
পুতিন এক ধাপ এগিয়ে জোর দিয়ে বলেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বর্তমান ব্যবস্থা রক্ষা করার অনুকূলে আমাদের দেশগুলো। কারণ এগুলো জাতিসংঘ সনদ ও আইনের শাসনভিত্তিক। আমরা সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও অভ্যন্তরীণ বিষয়াদিতে হস্তক্ষেপ না করার মতো মূলনীতিগুলো সমুন্নত রাখতে চাই।
পুতিন স্পষ্টভাবে ইউএন, ব্রিকস, এসসিও ও জি২০-এর ভূরাজনৈতিক আন্তঃসংযোগ ও আধুনিক ও বহুমেরু বিশ্বের আলোকে ডব্লিউটিও ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কর্তৃত্ব জোরদার করার ওপর জোর দেন।
বিপুল সম্পদ
বর্তমানে মনে হচ্ছে ব্রিকস মৃত। আরআইসি বৈঠকের আগে ব্রিকস সম্মেলনও হয়েছে। কিন্তু পুতিন ও শি উভয়েই এখন খোলামেলাভাবেই ব্রাজিলের জাইর বলসোনারোর প্রতি অস্বস্তি প্রকাশ করছেন, তাকে ট্রাম্পের নব্য-উপনিবেশবাদী সম্পদ মনে করছেন।
ট্রাম্পের সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের আগে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট দেশটির খনিজ সম্পদ নিয়ে গর্ব করেন। কিন্তু এর মধ্যেই ঝামেলা সৃষ্টি করেছেন ব্রাজিলের এক সামরিক কর্মকর্তা। তিনি প্রেসিডেন্টের বিমান করে ৩৬ কেজি কোকেন পাচার করতে গিয়ে স্পেনে ধরা পড়েছেন।
কিন্তু এসবের মধ্যেই ব্রাজিলের প্রশংসা করতে ছাড়েননি ট্রাম্প। তিনি ব্রাজিলের ‘বিপুল সম্পদরাজির’ প্রশংসা করে বলেন, এগুলো এখন মার্কিন কোম্পানির জন্য লাভজনক করতে বেসরকারি করা হয়েছে।
ব্রিকস সম্মেলনে বক্তৃতাকালে শি সংরক্ষণবাদের সমালোচনা করে ডব্লিউটিওকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানান।
পুতিন সংরক্ষণবাদের সমালোচনার পাশাপশি মার্কিন ডলার এড়িয়ে জাতীয় মুদ্রায় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য করার আহ্বান জানান।
উল্লেখ্য, এ ব্যাপারে চীন ও রাশিয়া এক ধাপ অগ্রগতি হাসিল করেছে। আগামী কয়েক বছর ধরে তারা তাদের বাণিজ্যের ৫০ ভাগ করবে নিজ নিজ দেশের মুদ্রায়।
রাশিয়া ও চীন মনে করে, আগে হোক আর পরে হোক, ভারত তাদের সাথে যোগ দেবে। বেইজিং ও দিল্লি উভয়ের সাথেই চমৎকার সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে মস্কো। তারা সুবিধাপ্রাপ্ত বার্তাবাহকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
ভারতের বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা বাতিল ও রাশিয়ার এস-৪০০ কেনায় শাস্তি প্রদান করতে ট্রাম্প প্রশাসনের দিল্লির বিরুদ্ধে মিনি বাণিজ্য যুদ্ধ এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে। ভারত এস-৪০০ কেনার অর্থ পরিশোধ করবে ইউরোতে।
ইরান নিয়ে রাশিয়া-ভারত-চীনের কাছ থেকে কোনো তথ্য ফাঁস হয়নি। তবে কূটনীতিকরা বলছেন, তাদের মধ্যে আলোচনার প্রধান বিষয়ই ছিল এটি। রাশিয়া ইতোমধ্যেই গোপনে বিপুলভাবে ইরানকে সহায়তা করছে। ভারতকে দুটি বিকল্পের একটি বেছে নিতেই হবে: ইরানি তেল কেনা অব্যাহত রাখা কিংবা ইরানি কৌশলগত সহায়তাকে বিদায় জানানো (চাহাবার বন্দরের মাধ্যমে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ায় যাওয়ার জন্য ভারতের মিনি সিল্ক রোডের ব্যবস্থা করা)।
ইরানকে নতুন সিল্ক রোড বা বেল্ট অ্যান্ড রোড উদোগের প্রধান ভরকেন্দ্র মনে করে চীন। রাশিয়া তার দক্ষিণপশ্চিম এশিয়ায় কৌশলগত স্থিতিশীলতার জন্য ইরানকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে।
আরআইসি না বেল্ট অ্যান্ড রোড?
ট্রাম্প যে কৌশলই গ্রহণ করুন না কেন, রাশিয়া-ভারত-চীনও স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনায় অগ্রসর হবে। তবে বৃহৎ ছবিটি পাল্টাচ্ছে না। ট্রাম্প প্রশাসন চীনকে দূরে রাখতে চায়, আর চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের গতি বাড়াতে চায়।
চীন জানে, অল্প সময়ের মধ্যেই পুরো ইউরোপ তার বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে সামিল হবে। ইতোমধ্যেই ৬০টি দেশ এতে যোগ দিয়ে দিয়েছে।
তবে ভারত হঠাৎ করে এতে যোগ দেবে, এমন কোনো ইঙ্গিত নেই। বরং চীনকে সংযত রাখার ইন্দো-প্যাসিফিক ধারণাটি আরো বড় আকার ধারণ করেছে। যদিও ভারত বলে আসছে যে ইন্দো-প্যাসিফিক ধারণাটি কোনো নির্দিষ্ট দেশের বিরুদ্ধে নয়।
তবে মোদি ঠিক কোন দিকে যাবেন, তা নির্ধারণ করার সময় এসেছে।

No comments

Powered by Blogger.