মায়ের কাছে ফেরা হলো না by জিয়া চৌধুরী

‘মা তুমি নাস্তা করে নাও। আমি তাড়াতাড়ি চলে আসবো।’ গত শুক্রবার সকালে শুধু এটুকু বলেই মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেন ইবনে তাহছিন ইরাম (১৯)। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে পছন্দের বাইসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ডেমরার বাসা থেকে। ক্রিকেট খেলতে চলে যান ডেমরার কলাবাগানের মাঠে। শারীরিক গড়ন আর আগ্রহের কারণে ইরামকে পেছনে ফেলার সাধ্য ছিল না বন্ধুদের। মাকে বলেছিলেন খেলা শেষে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবেন। দুপুর বারোটা নাগাদ খেলা শেষে বাইসাইকেলের প্যাডেল চেপে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন ইরাম। প্রতিদিনের মতো ফিরে যান মায়ের কাছে, তবে উচ্ছল-দুরন্ত ইরামের বদলে সেদিন স্থানীয় জনতা বয়ে নিয়ে যায় প্রাণহীন এক নিথর দেহ।
এক অচেনা ইরাম।
ফেরার পথে রামপুরা-ডেমরা মোস্তফা মাঝির মোড় এলাকায় রমজান পরিবহনের একটি বাসের চাপায় প্রাণ হারান ইরাম। ডেমরার গোলাম মোস্তফা স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাণিজ্য বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন ইরাম। চার ভাইয়ের মধ্যে ইরাম ছিলেন তৃতীয়। বাবা দেলোয়ার হোসেন জামদানি শাড়ির ব্যবসা করেন, মা শাহনাজ বেগম গৃহিনী। লিকন, রায়হান, ইরাম ও জুবায়েরকে নিয়ে ছিল তাদের পরিবার। থাকতেন ডেমরার আমুলিয়া এলাকার পূর্ব পাড়ায়। অথচ বাড়িটি এখন নিস্তব্ধ। গোয়ালবাড়ি এলাকার পারিবারিক কবরস্থানে মরদেহ দাফনের পর থেকে যেন বাকরুদ্ধ মা শাহনাজ বেগম। চোখের ফ্যাল ফ্যাল চাহনিতে স্নেহের সন্তানকে খুঁজছেন। আর ক্ষণে ক্ষণে ঢুকরে কেঁদে উঠছেন। চার ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয় হওয়ায় ছোটবেলা থেকে আদরে আহ্লাদে বড় হয়েছে ইরাম। বাসায় এখনো তার খেলার সরঞ্জাম আর পোষাকগুলো ভাইদের কাছে স্মৃতি হয়ে রয়েছে। নিহত ইরামের বড় ভাই লিকন গতকাল বিকালে মানবজমিনকে জানান, ছোটবেলা থেকেই শারীরিক গড়ন বেশ ভাল ছিল ইরামের। ছিল খেলাধুলার অসম্ভব ঝোঁক। তিনি জানান, উচ্চ মাধ্যমিক শেষে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার ইচ্ছে ছিল তার।
বেপরোয়া বাস ইরামের স্বপ্নকে আর পূরণ হতে দিলো না। ভাইদের সবার ছোট কোরআনে হাফেজ জুবায়ের(১৫) তার সেজো ভাই ইরামের জানাযা পড়ায়। ভাই হয়ে ভাইয়ের জানাযা পড়ানো যে কতটা কষ্টের তার আঁচ পাওয়া যায় লিকনের কান্নায়। ক্রিকেট ছাড়াও সেনাবাহিনী নিয়ে ভীষণ আগ্রহ ছিল ইরামের। মাধ্যমিকে ইরামের সঙ্গে পড়াশেনা করেছেন মুহাম্মদ জুনাইদ। তিনি মানবজমিনকে বলেন, এসএসসির পর থেকে দেশ সেবার অতন্দ্র প্রহরী হতে সেনাবহিনীতে যোগ দেয়ার ইচ্ছে জাগে আমাদের দু’জনের। আইএসএসবি পরীক্ষাসহ সেনাবাহিনীর নানা বিষয়ে আমরা আলোচনা করতাম। খেলার মাঠ, কলেজ সবখানে বিষয়টা নিয়ে কথা হতো। কিন্তু ইরাম এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে ভাবতেও পারছি না। কলাবাগানের মাঠ বলে পরিচিত খেলার মাঠে প্রতি শুক্রবারে খেলতে যেতেন ইরাম। গত ২৯ মার্চ শুক্রবারও ইরামের সাথে খেলতে গিয়েছিলেন তার ফুফাতো ভাই সারওয়ার হোসেন। তিনি মানবজমিনকে বলেন, দুর্ঘটনার আগের শুক্রবারও আমরা দুজন কলাবাগানের মাঠে খেলতে গিয়েছিলাম। খেলা শেষে বাড়ি ফেরার পথে ডেমরা-রামপুরা সড়ক নিয়ে কথা হয়।
এর আগে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিল সে। ওখানকার ব্রিজের পাশের স্পিডব্রেকারটি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ইরাম। সড়কের গতিরোধকটি দেবে মাত্র দেড় ইঞ্চি হয়ে গেছে। যে কোন গাড়ি স্পিডব্রেকার দিয়ে সহজেই ৫০-৬০ কিলোমিটার গতিতে চলে যেতে পারে। অথচ পরের শুক্রবারে ইরাম ওই সড়কেই বাসের চাপায় প্রাণ হারালো। এদিকে, ঘাতক রমজান পরিবহনের বিরুদ্ধে ডেমরা থানায় বাদী হয়ে মামলা করেছে নিহত ইরামের চাচা শফিউদ্দিন ব্যাপারী। ছেলেকে হারানোর পর তারা এখন শুধু একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান। ঢাকা মহানগর পুলিশের ওয়ারী বিভাগের ডেমরা জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মো. রবিউল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনার পর রমজান পরিবহনের বাসটির চালক মো. শামীম ও হেলপার মুন্না মিয়াকে আটক করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। ডেমরা এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন গত কয়েক বছরে কমপক্ষে ছয়জন মানুষের প্রাণহানি হয়েছে ওই সড়কে। অনিয়ন্ত্রিত গতি ও বেপরোয়া চালনার কারণে প্রতিনিয়ত মৃত্যুফাঁদ হয়ে উঠছে সড়কটি।
তুহিন ও নোমানের বাড়িতে শোকের মাতম: শুক্রবার খিলগাঁও ফ্লাইওভারে বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে নিহত দুই শিক্ষার্থী তাজ হোসেন তুহিন ও মো. আব্দুলাহ আল নোমান শেখের বাড়িতে শোকের মাতম চলছে।
সবুজবাগ থানা এলাকার ওয়াব কলোনীতে তুহিনদের বাসায় গিয়ে দেখা যায় তার বাবা তোফাজ্জল হোসেন ও মা শাফিয়া বেগমের আহাজারি। একমাত্র সন্তান হারিয়ে তারা কিছুতেই মনকে বোঝাতে পারছেন না। তুহিনের মা শাফিয়া বেগম বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। তুহিনের খালা রাবেয়া বেগম বলেন, আমরা তিন বোন ও দুই ভাইয়ের কোন ছেলে সন্তান নাই। তাই তুহিনকে আমরা সবাই আমাদের ছেলের মত দেখতাম। শুক্রবার শাওমির মোবাইলের শো-রুমে নতুন মডেলের কোন মোবাইল আসছে কিনা এজন্য সে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। যাওয়ার আগে বাসার ছাদে সে তার মা-বাবার সঙ্গে দেখা করে যায়। ভাড়া বাবদ তার মা তাকে তিনশ টাকাও দেন। কথা ছিল রিকশা করে সে দোকানে যাবে। কিন্তু বন্ধুর মোটরসাইকেলে করে গিয়ে আজ সে না ফেরার দেশে। তিনি বলেন, পড়ালেখায় বেশ ভালো ছিল তুহিন। কারো সঙ্গে আড্ডাবাজি করত না।
অনেকবার বায়না ধরেছিল মোটরসাইকেল কিনে দেবার জন্য। কিন্তু আমরা তাকে মোটরসাইকেল কিনে দেইনি। অথচ সে মোটরসাইকেলই কেড়ে নিয়েছে তুহিনকে। আব্দুলাহ আল নোমান শেখের বাসায় তার মা ময়না বেগমের আহাজারিতে প্রতিবেশীরাও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। নোমানের মা বলেন, জুম্মার নামাজ পড়ে আমাকে ফোন দিয়ে বলে তুমি কই। আমি তখন বলি আমি তোর নানীর বাসায়। এই কথা শুনেই ফোন কেটে দেয়। তারপর নানীর বাসায় এসে বাসায় চাবি নিয়ে যায়। পরে বাসায় গিয়ে মোটরসাইকেলের চাবি নিয়ে তার ছোট ভাই চাঁদকে নিয়ে বের হয়।
কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরির পর তার ভাইকে ১০ টাকা দিয়ে আবার সে বের হয়ে যায়। এর কয়েক মিনিট পরে একজন লোক এসে বলে আপনার ছেলে এক্সিডেন্ট করেছে। এ কথা শুনে তড়িঘড়ি করে আমি ফ্লাইওভারের দিকে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি একটা ছেলে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। কিন্তু ওই ছেলেটা আমার নোমান ছিল না। এলাকার একটি ছেলে বলে আরেক ছেলেকে খিদমাহ হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। আামি তখন হাসপাতালে গিয়ে আমার ছেলেকে দেখতে পাই।

No comments

Powered by Blogger.