এক ধর্ষকের অনুশোচনা by পিয়াস সরকার

কিছু দাগ কাপড়ে লেপে যায় আজীবনের জন্য। ঠিক তেমনি মানুষের মনে কিছু অনুশোচনা থেকে যায় আজীবন। ১২ বছর আগের করা এক ভুল কুরে কুরে খাচ্ছে ইদ্রিস আলীকে (ছদ্মনাম)। বাড়ি তার ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল উপজেলায়।
জাতীয় পরিচয়পত্রের হিসাব অনুযায়ী বয়স তার ৫৮ বছর। রাজধানীতে এসেছেন একযুগ আগে। দিয়ে যাচ্ছেন ভুলের খেসারত। অনুশোচনায় কুকড়ে মরছেন প্রতিনিয়ত। তখন থাকতেন বাড়িতে।
করতেন কৃষিকাজ। চার সন্তানের জনক। এখন বিয়ে হয়েছে সবার। স্ত্রী পরলোকগমন করেছেন। এমনকি নিজের ছেলে মেয়ের বিয়েতেও যেতে পারেন নি। আর তিনি পরিবার হারিয়ে রাজধানীতে অনুশোচনায় পার করছেন নিজের জীবন।
১২ বছর আগের কথা। ধান কাটার মৌসুমে গিয়েছিলেন পাবনার চলনবিলে। সঙ্গে ছিল তার এক ছেলে ও প্রতিবেশী অনেকেই। থাকতেন গৃহস্থের বাড়িতে। কাজের ফাঁকে একদিন দুপুর বেলা শরীর খারাপ করে তার। বিশ্রাম নেয়ার উদ্দেশ্যে আসেন থাকার স্থানে। গৃহস্থের দেয়া গোয়াল ঘরের পাশে অস্থায়ী ঘরে শুয়ে পড়েন। লক্ষ্য করেন পুরো বাড়ি ফাঁকা। শুধু সেসময় ছিল তাদের বাড়ির কাজের মেয়ে। বয়স আনুমানিক ১৫। ইদ্রিসের ভাষ্য অনুযায়ী, নিজের বিবেক-বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেন সে সময়।
ইদ্রিস আলী ও সেই মেয়ের জীবনে শুরু হয় এক ভয়াবহ অধ্যায়। মেয়ের চিৎকারে টের পেয়ে যায় প্রতিবেশীরা। মেয়েটিকে উদ্ধারের পর মেরে রক্তাক্ত করে ফেলেন। ইদ্রিস আলীর ছেলে এই অবস্থায় দেখে খুব কান্নাকাটি করে। তিনি বলেন, ঘটনা জানার পর ছেলে ব্যাগ নিয়ে সেই বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে যায়। অনেক মারধর করার পর নির্যাতিতা মেয়েটির সঙ্গেই বিয়ে দেয় বাড়ির লোকজন। মেয়ের সমবয়সী দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে সেখানেই কাটে আরো চার মাস।
‘বাড়িত বাচ্চা বউ থুয়া কোনো শান্তিই পাইতাম না। মোবাইল করলেও কেউ কতা কয় না। প্রতম বৌও কতা কয় না, পরের বৌ সারাদিন কান্দে।’
এই কথাবলার পর চেহারায় এক অসহায়ত্বের রেখা ফুটে ওঠে। কথা বলতে বলতে জড়িয়ে আসে গলা। একটার পর একটা সিগারেট ধরাতে থাকেন। সেই গৃহস্থের বাড়িতে স্বামী-স্ত্রী কাজ করতে থাকেন। সেখানে শুরু হয় নানা কটূক্তি। সেই সঙ্গে তার দ্বিতীয় স্ত্রীর বাড়ি থেকে বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।
চার মাস পার করে সেই বাড়ি থেকে পালিয়ে আসেন একদিন। বাড়ি ফেরার টাকা ছিল না পকেটে। ট্রেনে কোনো রকমে চলে আসেন বাড়িতে। সেখানে শুরু হয় আরেক যুদ্ধ। পরিবারের লোকজন তাকে বাড়িতেও ঢুকতে দেয়নি। তার স্ত্রী ঘর থেকে বের হয়েও দেখা করেনি। বাড়ির উঠানে চিৎকার করে ক্ষমা চেয়েছেন। এরপর শরণাপন্ন হন স্থানীয় ইউপি সদস্যের কাছে। তার কথায় ঠাঁই মেলে নিজ বাড়িতে। সেখানে আপন ঘরে পরবাসী হয়ে কাটান মাসখানেক। কটূক্তির ভয়ে যেতে পারতেন না বাড়ির বাইরে। বাড়িতেও শান্তি নেই তার। স্ত্রী পুত্র কন্যারা ফিরেও তাকাতেন না।
ফের পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা। একদিন শেষ রাতে কাউকে না জানিয়ে বাড়ি ছাড়া হন তিনি। এবার তার ঢাকা যাত্রা। রাজধানীতে এসে শুরু হয় তার নতুন জীবন। তবে, পুরনো জীবনের কালো অধ্যায় তাড়িয়ে বেরাচ্ছে আজীবন। প্রথম স্ত্রী গত হয়েছে তিন বছর আগে। সেবারই শেষবারের মতো বাড়িতে যাওয়া। বাড়িতে নিজ ঘরে ঢুকতে দেয়নি ছেলে মেয়ে আত্মীয় স্বজনরা। বাধা দেয়া হয়েছিল কবরে মাটি দেয়া নিয়েও। তবে, শেষ পর্যন্ত কবরে মাটি দিতে পেরেছিলেন তিনি। আর তার দ্বিতীয় স্ত্রী কেমন আছে তিনি জানেন না। এমনকি সে জীবিত না মৃত সেই তথ্যও নেই তার কাছে।
জীবনের সব হারিয়ে এখন ধানমণ্ডি লেকে খুঁজে ফেরেন নিজের আহার। চা বিক্রি করে চলে আহার। থাকেন রায়ের বাজার বস্তিতে। শেষ জীবনে কাটছে একাকী জীবন। আগে চালাতেন রিকশা। এখন বয়সের কারণে রিকশা ছেড়েছেন।
শেষ বয়সটা এভাবেই কাটিয়ে দিতে চান নিভৃতে। এখন শুধুই দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করে দিন কাটে তার। দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা শুধুই তার পরিবার ও দ্বিতীয় স্ত্রীর জন্য।

No comments

Powered by Blogger.