কী কথা হলো ফখরুলের সঙ্গে: আমি প্রস্তুত ছিলাম, বলা হচ্ছে ঘুমিয়েছিলাম, শরীর ভালো যাচ্ছে না খুব খারাপ: খালেদা

পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারের অস্থায়ী আদালতে নাইকো মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানিতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘আমার শরীর ভালো যাচ্ছে না। শরীর খুব খারাপ। গত ২০শে ফেব্রুয়ারির শুনানির ধার্য দিনে আদালতে আসার জন্য তৈরি ছিলেন। কারা কর্তৃপক্ষই তাকে আদালতে আনেননি। বরং অপপ্রচার করেছেন আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। এটা কেমন কথা হলো।’ আদালতে হাজির করার পর দুদকের কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল তার কাছে উঠে গিয়ে জানতে চাইলেন শরীর কেমন?
এর জবাবে খালেদা জিয়া এসব কথা বলেন। সেখানে উপস্থিত মির্জা ফখরুল    ইসলাম আলমগীর খালেদা জিয়াকে সালাম দিয়ে কথা বলা শুরু করেন। খালেদা জিয়া তখন মির্জা ফখরুলকে বলতে থাকেন, তার শরীর মোটেও ভালো যাচ্ছে না।
খালেদা জিয়ার কাছে ফখরুল জানতে চান, ‘থেরাপি ঠিকমতো দেয়া হচ্ছে কিনা।’ খালেদা জিয়া তখন মির্জা ফখরুলকে জানান, কারাগারে তাকে দেখতে চিকিৎসক এসেছিলেন। কিন্তু তার শরীর ভালো যাচ্ছে না।’
বেলা ১২টা ৩৭ মিনিটে খালেদা জিয়াকে হুইল চেয়ারে করে কারাগার থেকে পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের অস্থায়ী ঢাকার-৯ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের এজলাসে আনা হয়।
শুনানি শেষে খালেদা জিয়ার সঙ্গে কী আলোচনা হয়েছে জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘ম্যাডামের শারীরিক বিষয় নিয়ে আলাপ হয়েছে। ম্যাডাম ভালো নেই। আমরা উদ্বিগ্ন’।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘চিকিৎসকরা তাকে যথাযথ চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না। মাত্র একবার এসে চিকিৎসকরা তাকে দেখে গেছেন। এরপর তার রক্ত নেয়া হয়নি। ডায়বেটিসের রোগী হিসেবে তার চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না।’
জামিনের বিষয়ে খালেদা জিয়ার পরামর্শ কী জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘খালেদা জিয়ার পরামর্শ হচ্ছে লিগ্যালি আমরা তো মুভ করছি। সরকার ইলিগ্যালি জামিন দিচ্ছে না।’
বর্তমান রাজনৈতিক বিষয়ে কোনো আলাপ হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কোনো আলাপ হয়নি।’
বেলা ১২টা ৪০ মিনিটের দিকে বিচারক শেখ হাফিজুর রহমান এজলাসে উঠলে মামলার কার্যক্রম শুরু হয়।
প্রথমে আসামি সাবেক সচিব খন্দকার শহীদুল ইসলামের পক্ষে আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামান অব্যাহতির আবেদনের শুনানি করেন। তিনি ঘটনা ও আইনি যুক্তি তুলে ধরেন। ১৫ মিনিট শুনানির পর তার মক্কেলের অব্যাহতি প্রার্থনা করে শুনানি শেষ করেন আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামান। এরপর সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেনের আইনজীবী শাহ আলম ১৫ মিনিটে অব্যাহতির আবেদনের ওপর শুনানির পর শেষ করেন।
এরপর আসামি সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ নিজেই তার পক্ষে আইনি যুক্তি তুলে ধরেন। মওদুদ আহমদ বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। কোনো সাক্ষী, দালিলিক প্রমাণ নেই। আমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালে শুধু মতামত দিয়েছি, যা সব সরকারের আমলে দেয়া হয়। খালেদা জিয়াও নিয়ম অনুযায়ী স্বাক্ষর দিয়েছেন। আগের প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি সচিবও এ কাজ করেছেন, যা অভিযোগপত্র দেখে প্রতীয়মান হয়। আপনি (বিচারক) নিজেই বলেছেন, আমি শুধু মতামত দিয়েছি। তাই আমিসহ সকল আসামি অব্যাহতি চাচ্ছি।’
ওই সময় তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে নাইকো দুর্নীতি মামলা বাতিলের, খালেদা জিয়ার পক্ষে এয়ারবাস ক্রয়ে দুর্নীতির মামলা বাতিলের এবং ১৯৬৪ সালে বঙ্গবন্ধুর কয়লা আমদানি নিয়ে দুর্নীতির মামলা বাতিলের বিষয়ে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত তুলে ধরে শুনানি শেষ করেন।
মওদুদ আহমদের শুনানি শেষে বিচারক বলেন, আপনাদের অন্য দরখাস্তের বিষয়ে বলেন। তখন খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, আমরা খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার বিষয়ে একটি আবেদন করেছি। আদালত এ বিষয় কোনো আদেশ এখনো দেননি। গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি পাঁচ সদস্যের একটি মেডিকেল টিম খালেদা জিয়াকে দেখেন। তারপর দিন খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার প্রয়োজন মর্মে একটি প্রতিবেদন দিয়েছেন।
তিনি বলেন, গত ২৭শে ফেব্রুয়ারি গ্যাটকো মামলায় হাজিরা দেয়ার জন্য কারাগার থেকে আলিয়া মাদরাসা মাঠ আদালতে গাড়িতে খালেদা জিয়াকে নেয়া হয়। গাড়ি থেকে নামার সময় খালেদা জিয়া পড়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় দুই পুলিশ কর্মকর্তা তাকে ধরেন। এরপর হুইল চেয়ারে করে আদালতে নেয়া হয় তাকে। তাই খালেদার সুচিকিৎসা প্রয়োজন। আগে চিকিৎসা পরে বিচার।
তিনি বলেন, মামলার অভিযোগ গঠন শুনানির জন্য আমরা প্রয়োজনীয় কাগজ পাইনি। প্রয়োজনীয় কাগজ পেলে শুনানি করতে পারবো।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদারকে উদ্দেশ্য করে বিচারক বলেন, চিকিৎসার বিষয় তো উচ্চ আদালত একটি আদেশ দিয়ে দিয়েছেন। নিম্ন আদালত এ বিষয় কী করতে পারে? এরপর বিচারক দুদকের কৌঁসুলিকে বলেন, এ বিষয় আপনি কিছু বলেন। তখন দুদকের কৌঁসুলি বলেন, চিকিৎসার বিষয়টি কারা বিধি অনুযায়ী হতে পারে। এ ছাড়া খালেদার পক্ষে আজ শুনানি করলে ভালো হতো।
উভয়পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক মামলাটির অভিযোগ গঠন শুনানির জন্য আগামী ১৯শে মার্চ দিন ধার্য করেন। আর খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়ে আজ আদেশ দেবেন বলে জানান।
শুনানি চলাকালে সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, জয়নুল আবেদীন, মাসুদ আহমেদ তালুকদার, ব্যারিস্টার ফারহানা রুমিন ও জিয়াউদ্দিন জিয়ার সঙ্গেও কথা বলেন।
আদালতের কার্যক্রম শেষ হয় ১টা ৪৮ মিনিটে। আদালতের পুরো সময় ধরে খালেদা জিয়া হুইল চেয়ারে বসে ছিলেন। শুনানি শেষে ১টা ৫০ মিনিটে খালেদা জিয়াকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
এক এগারোর জরুরি আমলের সরকারের সময় ২০০৭ সালের ৯ই ডিসেম্বর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর সঙ্গে গ্যাসচুক্তি করায় রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার ক্ষতির অভিযোগে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০০৮ সালের ৫ই মে খালেদা জিয়াসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগপত্র দেয়া হয়।
মামলার অন্য আসামিরা হলেনÑ সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেন, সাবেক মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব খন্দকার শহীদুল ইসলাম, সাবেক সিনিয়র সহকারী সচিব সিএম ইউসুফ হোসাইন, বাপেক্সের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মীর ময়নুল হক, সাবেক সচিব মো. শফিউর রহমান, ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুন, ঢাকা ক্লাবের সাবেক সভাপতি সেলিম ভূঁইয়া ও নাইকোর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট কাশেম শরীফ।

No comments

Powered by Blogger.