চীন-ভুটান সম্পর্কোন্নয়ন ভারতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ by মিসবাহুল হক

ডাক্তার থেকে পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদে পরিণত হওয়া লোটে শেরিং গত নভেম্বরে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন। দায়িত্ব নিয়েই তিনি ভুটানে ভারতের একক কর্তৃত্ব কমাতে উদ্যমী হয়েছেন। ভুটানের অর্থনীতিকে বহুমুখী করে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে তার নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার। আর এই প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে চীনের প্রতি অগ্রসর হয়েছে দেশটি। চীনও ভুটানের প্রতি ইতিবাচকভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এতে প্রতিবেশী দেশটিতে ভারতের তাৎপর্যপূর্ণ বিদেশ নীতি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। চীন ও ভুটানের মধ্যে ৪৭০ কিলোমিটার স্থল সীমান্ত থাকার পরেও দু’দেশের আনুষ্ঠানিক কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। ভারতে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূতই বিভিন্ন সময়ে ভুটান সফর করেন।
এর মধ্য দিয়েই প্রতিবেশী দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে চলেছে। সম্প্রতি দিল্লির চীনা রাষ্ট্রদূত লুও ঝাওহুই দফায় দফায় থিম্পু সফর করেন। এ সপ্তাহেও একদল চীনা সাংস্কৃতিক কর্মী নিয়ে ভুটান সফরে গেছেন। তারা থিম্পুতে চাইনিজ স্প্রিং ফেস্টিভ্যালের অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন। এই স্প্রিং ফেস্টিভ্যাল আধুনিক চীনে নববর্ষ উৎসব হিসেবে অভিহিত হয়। থিম্পুতে চীনা নববর্ষের অনুষ্ঠান আয়োজন ও তাতে চীনা সাংস্কৃতিক কর্মীদের অংশগ্রহণ দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারের ইঙ্গিত দেয়।
পর্বতবেষ্টিত ভুটানের অর্থনীতি বর্তমানে ব্যাপকভাবে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ওপর নির্ভরশীল। এতে অর্থায়ন করেছে প্রতিবেশী ভারত। ভুটানের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে ভারত চড়া সুদে অর্থায়ন করলেও উৎপাদিত বিদ্যুৎ তুলনামূলক কম দামে কিনে নিচ্ছে। লোটে শেরিং প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি এই জলবিদ্যুতের ওপর ভুটানের ব্যাপক নির্ভরশীলতা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। নির্বাচনী ইশতেহারেও শেরিং ভুটানের অর্থনীতিতে ভারতের ব্যাপক কর্তৃত্বের বিষয়টি তুলে ধরেন। ভুটানের বৈদেশিক বাণিজ্যের ৮০ শতাংশই হয় ভারতের সঙ্গে। আর এই বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় উপাদান হলো জলবিদ্যুৎ। লোটে শেরিংয়ের দল দ্রুক নিয়ামরুপ তাশোগপা সংক্ষেপে ডিএনটি’র নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়, ভুটানের অর্থনীতিতে জলবিদ্যুতের মুখ্য ভূমিকার বিষয়টি আমরা স্বীকার করি। কিন্তু এটা জলবায়ু সংক্রান্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। ভবিষ্যতে ভূ-জলবায়ু নিয়ে সংকট সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। এ বিবেচনায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র জলবিদ্যুতের ওপর নির্ভর করে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এ ছাড়া, এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে ভুটানী তরুণরা খুবই সীমিত কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূ-গর্ভস্থ পানির দিক দিয়ে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ হওয়ার পরেও ২০৩০ সাল নাগাদ ভুটানে পানি সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। এর মূল কারণ হলো দেশটিতে মাত্রাতিরিক্ত জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উপস্থিতি। ১৯৬১ সালে ভুটানে প্রথমবারের মতো ভারতের আর্থিক সহায়তায় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হয়। এর পর থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভারতীয় কোম্পানি ভুটানে সক্রিয় রয়েছে। পাশাপাশি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে চড়া সুদে ভারতীয় অর্থ গ্রহণ করায় দেশটির কাছে ভুটানের ঋণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া, ভারতীয় কোম্পানিগুলো জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাইরেও বিভিন্ন কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ভুটানের ভূখণ্ডে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র অবস্থিত হওয়ার পরেও দেশটির তরুণরা এতে পর্যাপ্ত চাকরির সুযোগ পাচ্ছে না। বরং ভুটানের এই প্রকল্পে ভারতীয়রা অবাধ কর্মসংস্থানের সুবিধা ভোগ করছে। সুস্পষ্ট এই বৈষম্য ডিএনটি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে তুলে ধরেছে।
বিষয়টি বুঝতে পেরে চীন ক্রমেই ভুটানের প্রতি অগ্রসর হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে গত বছরের জুলাইতে দিল্লির চীনা রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে থিম্পু সফর করেন চীনের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কং জুয়ানইউ। তারা ভুটানের তৎকালীন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দু’দেশের সীমান্ত সম্পর্কিত বিষয়ে আলোচনা করেন। তারা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য ভুটানকে আমন্ত্রণ জানান। একই সঙ্গে চীনের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশীদার হওয়ার প্রস্তাব দেন। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র ভুটানই বিআরআই প্রকল্পে যোগ দেয়ার লোভনীয় প্রস্তাব উপেক্ষা করতে পেরেছে।
যাই হোক, গত মাসে প্রধানমন্ত্রী শেরিং দিল্লি সফর করেছেন। এটি ছিল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম বিদেশ সফর। এসময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভুটানের দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ৪ হাজার ৫০০ কোটি রুপি সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে ৪০০ কোটি রুপি সহায়তা দেয়ার অঙ্গীকার করেন। সফরে নরেন্দ্র মোদিকে ভুটান সফরের আমন্ত্রণ জানান লোটে শেরিং। তবে এই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে মোদি এখনো থিম্পু সফর করেন নি।
এমন পরিস্থিতিতে ভুটানে চীনের গতিবিধির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে ভারত। যদিও দোকলাম নিয়ে ২০১৭ সালের বিবাদের পর চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। নয়াদিল্লির চীনা রাষ্ট্রদূত নিজেই বলেছেন, ভারত-চীন সম্পর্ক ইতিহাসের অন্যতম ভালো সময় পার করছে।

No comments

Powered by Blogger.