বাংলাদেশকে কেন মলিন দেখাচ্ছে? ইকোনমিক টাইমসের নিবন্ধ by মিহির শর্মা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল-বিশ্বের একটি সফলতার কাহিনী বলে। গত বছর এখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শতকরা প্রায় আট ভাগের কাছাকাছি ছিল, যা প্রতিবেশী ভারতের চেয়ে দ্রুত বর্ধিষ্ণু। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন যেমনটা বলেছেন, আয়ের দিক থেকে যে সূচক, তার চেয়ে মানব উন্নয়ন সূচক এখানে ভালো। বিশ্বে হাতেগোনা যেসব উন্নয়নশীল দেশ সফলতার সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয় পেয়েছে তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। প্রকৃতপক্ষেই একটি ব্যতিক্রমী কর্মকাণ্ড, যা অনেক বৃহৎ ও ধনী দেশকে লজ্জায় ফেলতে পারে, তা হলো, জনবহুল এই দেশটি মিয়ানমারের কমপক্ষে ৭ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে।
তাই গত সপ্তাহে বাংলাদেশের নির্বাচনে শেখ হাসিনার দল বিজয়ী হয়েছে, এটা বড় বিস্ময়ের কিছু নয়। কিন্তু তিনি যে মাত্রায় জিতেছেন তা আক্ষরিক অর্থেই অবিশ্বাস্য। বাংলাদেশে নির্বাচন হওয়া ২৯৮টি আসনের মধ্যে ১০টি বাদে সব আসনে বিজয়ী হয়েছেন তারা।
সবিনয়ে সরকারি জোটকে নির্বাচনে ‘ওভার ম্যানেজিং’-এর জন্য দায়ী করা হয়। এটাও বিস্ময়ের নয়। সর্বোপরি, নির্বাচনটা এগিয়ে এসেছে দীর্ঘ সময় নিয়ে, যখন বিরোধী রাজনীতিকদের ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে, জেলে দেয়া হয়েছে অথবা নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া জেলে। তার ছেলে ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী এখন বৃটেনে। তিনি দেশে ফিরলেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মুখে পড়তে হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতা হলো একটি দীর্ঘদিনের ধারা, যেমনটা হয় সীমান্তের ওপাড়ে, পশ্চিমবঙ্গে। খারাপ দিক হলো, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে তারা হলো নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী। ভয়াবহভাবে গণতন্ত্র ধ্বংসের এই ব্যবস্থাকে চেক দিতে পারে এমন নিরপেক্ষ কোনো প্রতিষ্ঠান দেশে খুব সামান্যই রয়েছে।
নির্বাচন নিয়ে সরকারি ভাষ্যের বিষয়ে যেসব সাংবাদিক প্রশ্ন তুলেছেন তাদেরকে সরকার নতুন বিতর্কিত আইন ব্যবহার করে গ্রেপ্তার করেছে। উপরন্তু, ভোটকেন্দ্রগুলোতে যেসব মানুষকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভীতি প্রদর্শন করেছিলেন অথবা যারা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখেছেন তাদের ভোট দেয়া হয়ে গেছে, সেইসব মানুষের ক্ষোভের কাহিনী ফেসবুকে উতলে উঠছে।
ভারত থেকে দেখে, এই নির্বাচন যেভাবে হয়েছে তা ভীষণভাবে হতাশাজনক। কারো কাছে, এখানে (ভারতে) বাংলাদেশকে একটি সুশাসনের মডেল হিসেবে দেখা হয়। এটি সেই দেশ, যেখানে ভারতের মতো না হয়ে রপ্তানিখাতে ব্যাপক উন্নতি করেছে। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যার সম্পদ হলো দারিদ্র্য, সেখানে জনগণকে, বিশেষ করে নারীদের ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। যখন তৃণমূল পর্যায়ে উন্নয়ন সমাধান নিয়ে চেষ্টা করে এবং পরীক্ষা করে তখন সরকারযন্ত্র একটি নম্র ও বাস্তবতা প্রদর্শন করে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনৈতিক ইসলামীকরণের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কোনো আপস করেন না। তিনি বাঙালি মূল্যবোধের পরিচয়ের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ অঙ্গীকারের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ গড়ে উঠেছিল। তার এমন অবস্থানকে ভারত পছন্দ করে থাকতে পারে। সুনির্দিষ্টভাবে ২০০০-এর দশকে নয়া দিল্লি খালেদা জিয়ার শাসনকে স্মরণ করে আতঙ্ক নিয়ে। দৃশ্যত ওই সময়টা বাংলাদেশ উগ্রবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। এতে পাকিস্তানিদের সুবিধা হয়েছিল এবং তারা প্রতিবেশী দেশটিতে সন্ত্রাস রপ্তানি করেছিল।
কিন্তু নির্বাচনে সরকারের ‘ম্যানেজমেন্টে’র মাধ্যমে যে ক্ষতি হয়েছে তা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের চেয়েও বেশি কিছু। এই মেয়াদে শেখ হাসিনা পুনঃনির্বাচিত হওয়ায় হয়তো খুব কম সরকারই শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাবে। দীর্ঘ মেয়াদে একটি অনুদার গণতন্ত্র কম বিপজ্জনক নয়, কারণ, এটা হওয়া উচিত গণতান্ত্রিক।
খুব সিম্পল সত্য কথা হলো, শেখ হাসিনা চিরদিন শাসন করবেন না।
কেউই তা পারেন না। তার কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা যদি বাংলাদেশীদের মানসিকতায় দাগ ফেলে, আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ ও অংশগ্রহণমূলক মূলনীতিতে দাগ ফেলে তাহলে অবশ্যই প্রতিক্রিয়া হবে ভয়াবহ। আর তাতে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থিতিশীলতায় তা হবে আরো খারাপ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই পাঁচ বছর মেয়াদকে তার শেষ মেয়াদ হিসেবে ভাবা উচিত এবং পরিকল্পনা শুরু করা উচিত তিনি বিরোধীদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে কী ঘটতে পারে, যেমনটা সব গণতান্ত্রিক নেতাকে এক সময় করতেই হয়। তার প্রশাসন যেসব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে তা পুনর্গঠন করা উচিত।
(ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য ইকোনমিক টাইমসে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ। কিছুটা সংক্ষেপিত)

No comments

Powered by Blogger.