ভোটের রাতে ধর্ষণ: গ্রেপ্তার ৭, ঢাকায় প্রতিবাদ নোয়াখালীতে বাম জোটের নেতারা

সুবর্ণচরে গৃহবধূ ধর্ষণের ঘটনার মূল নির্দেশদাতাসহ মোট ৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- শীর্ষ সন্ত্রাসী উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও সাবেক ইউপি সদস্য রুহুল আমিন, মামলার প্রধান আসামি সোহেল, বাদশা আলম, স্বপন ও বেচু। চরজব্বার থানার ওসি নিজাম উদ্দিন জানান, চরজব্বার থানা পুলিশ ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে চট্টগ্রাম থেকে জসিম উদ্দিনকে   গ্রেপ্তার করে। তবে সে এজাহারভুক্ত আসামি না হলেও তদন্তে তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তার গ্রামের বাড়ি একই ইউনিয়নের মধ্য চরবাগ্যায়। তিনি জানান, গ্রেপ্তার ৫ জনের মধ্যে প্রথম তিনজনের সাত দিন করে রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। বাকি দু’জনের সাত দিন করে রিমান্ড চাওয়ার কাগজপত্র আজ আদালতে জমা দেয়া হবে।
এদিকে ঘটনার মূল নির্দেশদাতা স্থানীয় উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও সাবেক ইউপি সদস্য রুহুল আমিনকে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক জানান, রুহুল আমিনকে দল থেকে বহিষ্কারের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ভোটের রাতে স্বামী-সন্তানকে বেঁধে এক গৃহবধূকে দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়। যা নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। চট্টগ্রাম থেকে জসিমসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অপরজন হলো হাসান আলী বুলু (৪৫)। সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক রুহুল আমিনের ‘প্রধান সহযোগী’ হিসেবে এলাকায় পরিচিত। আর জসিম উদ্দিন (৩০) সুবর্ণচরের চরজুবলী ইউনিয়নের মধ্যম বাগ্যা গ্রামের মোতাহের হোসেনের ছেলে। জসিম পেশায় একজন কলা বিক্রেতা। নোয়াখালীর পুলিশ সুপার মো. ইলিয়াছ শরীফ বলেন, মামলার এজাহারে বুলু বা জসিমের নাম ছিল না।
তবে পুলিশ তদন্তে নেমে ঘটনার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা পায়। দুজনের মধ্যে জসিমকে শুক্রবার ভোর সাড়ে ৬টার দিকে চট্টগ্রামের নাজিরহাট এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করে চরজব্বার থানা পুলিশের একটি দল। পরে চট্টগ্রামের ডাবলমুরিং থানার পশ্চিম মাদারবাড়ি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় হাসান আলী বুলুকে। গত ৩০শে ডিসেম্বর ভোটের রাতে সুবর্ণচরের মধ্যবাগ্যা গ্রামে ওই ধর্ষণের ঘটনার পর এ পর্যন্ত মোট সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে একজন সাবেক ইউপি সদস্য ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, চারজন ইটভাটা শ্রমিক। মামলার অপর আসামিদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে চরজব্বার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইব্রাহিম খলিল জানিয়েছেন। ধর্ষণের শিকার ওই চল্লিশোর্ধ নারীর অভিযোগ, ভোটের সময় নৌকার সমর্থকদের সঙ্গে তার কথাকাটাকাটি হয়েছিল।
এরপর রাতে সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক রুহুল আমিনের ‘সাঙ্গোপাঙ্গরা’ বাড়িতে গিয়ে তাকে ধর্ষণ করে। পুলিশ সুপার মো. ইলিয়াছ শরীফ বলেন, ‘হাসান আলী বুলু ওই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী। ভোটকেন্দ্রে তার সঙ্গেই ওই নারীর ঝামেলা হয়েছিল। পরে সে দশ হাজার টাকায় কয়েকজন ইটভাটা শ্রমিককে ভাড়া করে।’ চরজব্বার থানায় ওই নারীর স্বামীর দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিরা তার বসতঘর ভাঙচুর করে ঘরে ঢুকে বাদীকে পিটিয়ে আহত করে এবং সন্তানসহ তাকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে দলবেঁধে ধর্ষণ করে। মামলার এজাহারে মোট নয়জনকে আসামি করা হলেও সেখানে চরজুবলী ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার রুহুল আমিনের নাম না থাকায় বুধবার রাতে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুকের কাছে হতাশা প্রকাশ করেন ওই নারী। এরপর সেই রাতেই জেলা সদরের একটি হাঁস-মুরগির খামার থেকে রুহুল আমিনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা রুহুল আমিন গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাকে দল থেকে বহিষ্কারের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানিয়েছেন। নির্যাতনের শিকার ওই নারী এখন নোয়াখালী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ডাক্তারি পরীক্ষায় তাকে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে জানিয়ে ইতিমধ্যে প্রতিবেদন দিয়েছে মেডিকেল বোর্ড। এদিকে নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চরজুবলীতে গণধর্ষণের শিকার সেই নারীর (৪০) খোঁজখবর নিতে বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরামের (বোয়াফ) একটি তদন্ত টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। বৃহস্পতিবার রাতে বোয়াফের সভাপতি কবীর চৌধুরী তন্ময়ের নেতৃত্বে তদন্ত টিমের সদস্যরা চরজুবলী গ্রামে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন। এর আগে বেলা ১১টার দিকে নোয়াখালী ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে গিয়ে নির্যাতিতা ওই নারীর মুখে ঘটনার বিস্তারিত শোনেন তদন্ত টিমের সদস্যরা। এ সময় তাদের সঙ্গে ছিলেন জাতীয় মহিলা সংস্থার পরিচালনা কমিটির সদস্য ইরাদিয়া জামান।
বোয়াফের সভাপতি কবীর চৌধুরী তন্ময় জানান, তারা পুরো ঘটনাটি তদন্ত করতে এসেছেন। ঘটনাটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এ বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ঘটনাটি বিস্তারিত জেনে ঢাকায় একটি প্রেস কনফারেন্স আমাদের সুপারিশ সরকারকে অবহিত করবো। এ সময় তার সঙ্গে থাকা জাতীয় মহিলা সংস্থার পরিচালনা কমিটির সদস্য ইরাদিয়া জামান জানান, তারা ভিকটিম নারীর সঙ্গে কথা বলেছেন। তার দেয়া তথ্য মতে ঘটনার সময় থাকা অনেক আসামি এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে। তারা বিষয়টি ভালোভাবে তদন্ত করে কীভাবে নির্যাতিতা নারীসহ তার পরিবারকে আইনগত সহযোগিতা দেয়া যায় সে বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
তিনি আশা করেন অপরাধীদের কঠিন শাস্তি হবে। অপরদিকে, নোয়াখালীর সুবর্ণচরে গণধর্ষণের শিকার নারীর সঙ্গে বাম গণতান্ত্রিক জোটের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সাক্ষাতে ঘটনায় মূল ইন্ধনকারীর নাম এজাহারে অন্তর্ভুক্তিসহ জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করা হয়। গতকাল দুপুর ১টায় বাম গণতান্ত্রিক জোটের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ নোয়াখালী সদর হাসপাতালে গণধর্ষণের শিকার নারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দেন। পরিদর্শন দলে ছিলেন সিপিবির কেন্দ্রীয় সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাসদ (মার্কসবাদী)’র কেন্দ্রীয় সদস্য শুভ্রাংশ চক্রবর্তী, বাসদের কেন্দ্রীয় সদস্য বজলুর রশিদ ফিরোজ, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের পলিটব্যুরোর সদস্য অধ্যাপক আবদুর সাত্তার, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য আকবর খান, সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য লক্ষ্মী চক্রবর্তী, বাসদ (মাহবুব) এর কেন্দ্রীয় নেতা মহিন উদ্দিন লিটন ও জোটভুক্ত জেলা নেতৃবৃন্দ প্রমুখ।
পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত মতবিনিময়কালে নেতৃবৃন্দ ঘটনায় জড়িত মূল ইন্ধনদাতাদের নাম মামলার এজাহারে অন্তর্ভুক্ত করতে পুলিশের গড়িমসির তীব্র নিন্দা জানান এবং অবিলম্বে ইন্ধনদাতাদের নাম এজাহারে অন্তর্ভুক্ত করা, জড়িতদের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান, ভুক্তভোগী পরিবারের নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করার দাবি জানান। আজ শনিবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা গণধর্ষণের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করবেন। সকালে তারা সুবর্ণচর যাবেন। বিএনপির চেয়ারপারসনের প্রেস উইং সদস্য শায়রুল কবির খান এ তথ্য জানান। এ সফরে মির্জা ফখরুলের সঙ্গে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক ও সাবেক ডাকসুর ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না, জেএসডি সভাপতি ও স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলক আ.স.ম আবদুর রব, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ও বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান থাকবেন।
গণধর্ষণের ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি
সুবর্ণচরে গৃহবধূ গণধর্ষণের ঘটনায় প্রতিবাদ ও ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে বেশ কয়েকটি সংগঠন। গতকাল বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য ও জাতীয় জাদুঘরের সামনে দুটি পৃথক মানববন্ধনে এমন দাবি জানানো হয়। জাতীয় জাদুঘরের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে ‘যৌন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থী জোট’ নামের একটি সংগঠন। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামালসহ বেশ কয়েকজন বক্তব্য রাখেন।
এ সময় ‘ধর্ষণমুক্ত বাংলাদেশ চাই, কথায় নয় কাজে’ ‘ধর্ষক তুমি মানুষ নও’ প্ল্যাকার্ড নিয়ে মানববন্ধনে অংশ নেন শিক্ষার্থীরা। এর আগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য এলাকায় নোয়াখালীর সুবর্ণচরের গণধর্ষণের প্রতিবাদে অবস্থান নেয় ‘স্ট্যান্ড অ্যাগনেইস্ট রেইপ: হোক প্রতিবাদ’ ব্যানারের একটি সংগঠন। ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবার আগে ধর্ষণের বিচার করুন’ ‘রাষ্ট্র তুমি অন্ধ বলে, ধর্ষক আজো মুক্ত চলে’ ‘কাউকে তো দাঁড়াতে হবে’ এরকম লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে প্রতিবাদ জানান শিক্ষার্থীরা। দুটি মানববন্ধনেই সুবর্ণচরের গণধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের আহ্বান জানানো হয়।

No comments

Powered by Blogger.