ঘরের বাইরে নারী কেন এত প্রশ্নের মুখে? -বিবিসি বাংলা

শামিমা শামিম প্রতিদিন কর্মস্থলে যান নিজের স্কুটিতে করে। নিজেই চালান। আজ আমি তার সঙ্গী হলাম। খেয়াল করলাম, রাজধানী শহর ঢাকার রাস্তায় একটা মেয়ে স্কুটি চালিয়ে যাচ্ছে এটা যেন কারো নজর এড়াচ্ছে না। আরো খেয়াল করলাম ট্রাফিক সিগন্যাল বা জ্যামে থাকার সময় আশপাশের আরোহীদের বাঁকা চাহনি। কয়েকজন রিক্সাচালকের ব্যঙ্গাত্মক হাসি।
শামিমা শামিম বলছিলেন এটা তার প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতা। যখন রাস্তায় বের হই তখন তারা স্কুটির চেয়ে আমার শরীরের দিকে বেশি চেয়ে থাকে। সব থেকে ভয়ঙ্কর হলো স্কুটি চালানোর সময় পিছন থেকে অনেক ছেলে আছে যারা মোটরবাইক নিয়ে টার্গেট করে, ধাক্কা দেয়ার জন্য।
আমার সাথে এমন ঘটনা অনেকবার হয়েছে। একবার তেজগাঁও লিংক রোডে ২/৩ টা বাইক এবং প্রতিটাকে তিনজন করে ছেলে। আমি দেখলাম আমার আর কোনো জায়গা নেই। তখন আমি থেমে গেলাম। যদি আমি সচেতন না হয়ে একই গতিতে চালাতাম তাহলে ঐদিন নিশ্চিত আমার বড় একটা অ্যাকসিডেন্ট হতো।
ঢাকার রাস্তায় এখন অনেক মেয়েকেই স্কুটি চালাতে দেখা যায়, এমনকি মেয়েদের দ্বারা চালিত অ্যাপ ভিত্তিক রাইডও রয়েছে। শামিমা শামিম স্কুটি চালান আরো আগে থেকে। তখন হাতে গোনা দুই-একজন নারীকে দেখা যেত চালাতে।
তখনকার সঙ্গে এখনকার কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে?
শামিমা শামিম বলছিলেন, ‘কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখন তো আমি চেষ্টা করি ১০টার মধ্যে বাসায় ফিরতে। কারণ বেশি রাত হলে রাস্তায় কী ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে কে জানে। যে বাসায় থাকি সেখানেও অলিখিত একটা সান্ধ্য আইন জারি করা। ১০টার মধ্যেই বাসায় ফিরতে হবে। যেখানে আমার ছেলে বন্ধুরা রাত ১২টা পর্যন্ত শুধুমাত্র আড্ডা দেয়ার জন্য বাইরে থাকে সেখানে আমাকে মাথায় রাখতে হয় সব কাজ ফেলে ১০ টার মধ্যে বাসায় ফেরার তাড়া’। আর এখানেই প্রশ্ন উঠে ‘কিন্তু কেন?’। পুরুষরা যদি বাইক চালিয়ে কর্মস্থলে যেতে পারেন বা কে কত পারদর্শী তার প্রতিযোগিতা হতে পারে তাহলে নারীরা নয় কেন? এত গেল দৈনন্দিন জীবনের রাস্তায় চলার ক্ষেত্রে ছোট একটা উদাহরণ। আরো অনেক গল্প আছে যেগুলো শুনলে অবুঝের মতোই আপনার মনে প্রশ্ন উঠতে পারে কিন্তু কেন। বীণা রহমান। এই মেয়েটি বেসরকারি হাসপাতালে নার্সের কাজ করেন। কাজের প্রয়োজনে তাকে সপ্তাহে কয়েকদিন নাইট শিফট করতে হয়। কিন্তু প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় তাকেও।
তিনি বলছিলেন ‘রাতে বের হয়ে যাই সকালে ফিরি। আমার আশপাশের ফ্ল্যাট থেকে আমার মা’কে জিজ্ঞেস করেছে আপনার মেয়ে এত রাতে কোথায় যায়? আসলেই আমি এই কাজ করি কি না সেটা নিয়েও তাদের সন্দেহ।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হকের সঙ্গে কথা বলে জানার চেষ্টা করছিলাম ঠিক কী কারণে সমাজে যে কাজ পুরুষ করতে পারে, নারী করতে গেলে তাকে কেন শুনতে হয় বিচিত্র, অশালীন কথা।
মি. হক বলছিলেন, ‘নারীদের যে আচরণগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে সেটা একটা সাবলীল আচরণ। কিন্তু পুরুষ সদস্যরা সেটাকে স্বাভাবিকভাবে দেখছে না। মেয়েদেরকে একটা নির্দিষ্ট আচরণিক গণ্ডির মধ্যে দেখতে পছন্দ করে। এর বাইরে যদি কোনো মেয়ে কোনো আচরণ করে তখন সেটা তারা মেনে নিতে পারে না। এমনকি আমাদের দেশে যারা নাগরিক নিরাপত্তায় নিয়োজিত তারাও এটা মেনে নিতে পারে না। কিন্তু মেয়েরা সেই সনাতনী পুরনো ধাঁচে চলতে থাকবে সেটা হতে পারে না।
যে প্রসঙ্গে কথা হচ্ছে এই প্রসঙ্গটি নতুন নয়। কিন্তু প্রতিবার নতুন নতুন পরিস্থিতির মুখে মেয়েদের পড়তে হয়, যেটাকে পরিস্থিতি না বলে বলা উচিত হয়রানি, যৌন হয়রানি, শারীরিক, মানসিক হেনস্তার শিকার। সমপ্রতি একটা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে যেখানে ৬ মিনিটের বেশি সময় ধরে দেখা গেছে, কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে সিএনজি’র মধ্যে থাকা একজন নারীকে নানা ধরনের অশালীন প্রশ্ন করতে। মেয়েটি মধ্যরাতে কোথায় আসছিল....এ ধরনের নানা প্রশ্ন।
আমি ঢাকায় নানা পেশার কয়েকজন নারী এবং পুরুষের সঙ্গে কথা বলেছিলাম পুরুষের জন্য যেটা সাবলীল সেটা মেয়েদের জন্য স্বাভাবিক আচরণ নয় কেন? একজন পুরুষ বলছিলেন ‘যেমন ধরেন আমি অনায়াসে আমার বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে সাজেক চলে যাচ্ছি বেড়াতে। কিন্তু আমার বোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, সে যদি যেতে চায় তাহলে আমি যেতে দিচ্ছি না।’ প্রশ্ন- কেন দিচ্ছেন না? উত্তর: ‘এই সুযোগটা ছোটবেলা থেকে আমাদের পরিবার প্রথম নষ্ট করে দেয়। আমি দেখে এসেছি মেয়েরা সন্ধ্যার পর বাইরে থাকতে পারবে না। আমি খেলা করে রাত ন’টায় এলেও ক্ষতি নেই’। আরেকজন পুরুষ বলছিলেন ‘আমরা একটা সাইকোলজিক্যাল জায়গায় আটকে আছি। আমার বোন বা বাড়ির মেয়েরা যদি রাত ১১টায় বাসায় ফেরে তাহলে আমি মেনে নিতে পারবো না। যদিও আমি বুঝতে পারছি আমার মতো তারো মবিলিটি দরকার’। উত্তর: ‘এক্ষেত্রে আমার মাথায় কাজ করে তার সিকিউরিটির কথা। আমাদের দেশে সেই নিরাপত্তাটা নিশ্চিত করা হয়নি’। তবে কয়েকজন নারী আমাকে বলছিলেন তারা যে শুধু পুরুষদের কাছ থেকেই এই ধরনের প্রতিক্রিয়া পেয়ে থাকেন তাই নয়। অনেক নারীর কাছ থেকে শুনতে হয় একই রকম অপমানসূচক মন্তব্য।
একটি মেয়ে আমাকে বলছিলেন ‘পরিবারের মধ্যেই বয়োজ্যেষ্ঠা যেসব মহিলা থাকেন তারা এগুলো করেন। এমনকি আত্মীয়স্বজন যারা আছেন তারা বলেন মেয়ে মানুষের এই কাজ করার কি দরকার’। (কিছুটা সংক্ষেপিত)

No comments

Powered by Blogger.