মাটি খুঁড়ে প্রিয়জনদের খুঁজছেন যে নারীরা

মেক্সিকোয় একযুগে ৩৭ হাজারেরও বেশি মানুষ নিখোঁজ হয়েছে। তাদের স্বজনরা জানেনা আদৌ তারা বেঁচে আছে কিনা? তেমনই এক মা তার সন্তানের খোঁজে নিজেই নেমেছেন কোদাল হাতে। পরে যোগ দেন আরও অনেক নারী। ফটো সাংবাদিক আলেজান্দ্রো সিগারা ছবিতে তুলে এনেছেন তাদের কথা।

১। মেক্সিকোর সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশটিতে ২০০৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩৭ হাজার মানুষ গুম হয়েছে। যাদের সঙ্গে কি হয়েছে কিছুই জানা যায়নি।

২। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা মিরনা নেরেয়দা মেদিনা একটি দলের খোঁজ পান যাদের নাম "সার্চার্স অব এল ফুয়ের্তে"। তারা মূলত নিখোঁজদের সন্ধানে কাজ করে।
চার বছর মিসেস মেদিনার ছেলে রবার্তো নিখোঁজ হন। রবার্তো এল ফুয়ের্তের একটি পেট্রোল স্টেশনে সিডি বিক্রির কাজ করতেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে গত ২০১৪ সালের ১৪ জুলাই একটি কালো পিক আপ পেট্রোল স্টেশনে থামে এবং রবার্তোকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।

৩। শুধুমাত্র সিনালোয়া রাজ্যে এ পর্যন্ত দুই হাজার ৭শ জনের নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ দায়ের হয়েছে। তবে প্রকৃত নিখোঁজের সংখ্যা এর চেয়ে আরও বেশি বলে জানা গিয়েছে। নিখোঁজদের বেশিরভাগ আর বেঁচে নেই বলে ধারণা করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত হতেই এই অনুসন্ধানী দলটি দিনের পর দিন প্রিয়জনের খোঁজে কবর খুঁড়ে চলছে।

৪। মিরিয়াম রেয়েস খুঁজছেন তার স্বামীকে যিনি ২০১৫ সাল থেকে নিখোঁজ। তিনি চান তাদের ছেলে জানুক যে বাবার সঙ্গে কি হয়েছে। অন্তত তার লাশটাকে যেন তারা কবর দিতে পারেন।

৫।এই অনুসন্ধানী অভিযানের যন্ত্রপাতি খুবই সাধারণ- মাটি খোড়ার কোদাল আর শক্ত মাটি আলাদা করতে হাতুড়ির মতো পিকেইক্স।

৬। স্থানীয়রা এই নারীদের বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন, যেন তারা দ্রুত তাদের স্বজনদের বিষয়ে জানতে পারেন।

৭। কোথাও গোপন কবরের সন্ধান পেলেই সেই অনুসন্ধানী দলটি খোড়াখুড়ি শুরু করে। ৪১ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রাও তাদের পিছু হটাতে পারেনা। ছবির বামপাশের নারী জুয়ানা এস্কালান্তে তার ২৮ বছর বয়সী ছেলে আদ্রিয়ানের খোঁজে মাটি খুড়ছেন। মিসেস এস্তালান্তের ধারণা তার সন্তানকে কেউ অপহরণ করেছে।

৮। সিনালোয়া রাজ্যে অপহরণ খুব স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাউকে মুক্তিপনের জন্য, কাউকে পাচার করার জন্য আবার কাউকে জোরপূর্বক অপরাধ চক্রে সামিল হওয়ার জন্য অপহরণ করা হয়। উদ্দেশ্য হাসিল না হলে অনেককেই মেরে ফেলে লাশ গুম করে দেয় অপহরণকারীরা। তার সেই নিখোঁজদের স্বজনরা কখনো জানতেই পারেন না, তাদের প্রিয়জনের সঙ্গে কি হয়েছে।

৯। ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন গোপন কবর খুঁড়ে দুই শতাধিক লাশ বের করেছেন এই নারী অনুসন্ধানীরা। এর মধ্যে যেসব দেহাবশেষ পাওয়া গিয়েছে তাদের পরিচয় সনাক্তের জন্য ডিএনএ পরীক্ষা করতে দেয়া হয়। পরীক্ষায় পরিচয় পাওয়া গেলে সেই খবর স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেন এই নারীরা। এ পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া অর্ধেকেরও বেশি লাশের পরিচয় তারা বের করতে পেরেছেন। মিনরা তার মতো আরেক মা'কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। এই নারী চার মাস আগে নিখোঁজ হওয়া ছেলের সন্ধান পেয়েছেন।
১০/ লুই আলফ্রেদো শ্যাভেজ ২০১৮ সালের ৩১শে জানুয়ারি নিখোঁজ হন। পরে ৩০শে মার্চ তার লাশ সনাক্ত হয়। লস মটিস শহরে লুইয়ের শেষকৃত্যে যোগ দেন তা র স্বজনরা।

১১। মেক্সিকোর সিনালোয়া রাজ্যের এক মা তাঁর নিখোঁজ সন্তানকে খুজে বের করতে নিজেই কোদাল হাতে মাঠে নেমেছেন। যেখানে কোন গোপন কবর দেখেন সেখানেই খোড়াখুড়ি করেন তিনি। কিছুদূর খোড়ার পর কোদালটি নাকের কাছে নিয়ে বোঝার চেষ্টা করেন যে সেখানে পঁচা লাশের গন্ধ আছে কিনা।

১২। ছেলে রবার্তোর খোঁজ পেতে মা মিরনার প্রায় তিন বছর লেগে যায়। ২০১৭ সালের ১৪ জুলাই রবার্তো নিখোঁজ হওয়ার তৃতীয় বার্ষিকী ছিল। সে বছর এক গোপন সূত্রে খবর পেয়ে অনুসন্ধানী দলটিকে নিয়ে দুর্গম পাহাড়ে যান মিসেস মিরনা। সেখানকার একটি কবর থেকে একটি দেহাবশেষের সন্ধান পান তারা। পড়ে সেই হাড়ের ডিএনএ পরীক্ষায় জানা যায় এটি রবার্তোরই লাশ।

১৩। মিরনা নিজের ছেলের সন্ধান পেলেও এখন তিনি অন্য নারীদের সহায়তা করে চলছেন তাদের স্বজনদের খুঁজে বের করার জন্য। ছবির ক্রন্দনরত এই নারী তার ছেলের নিখোঁজের খবর পুলিশকে জানাতে এসেছেন। ছয় বছর আগে তার ছেলে নিখোঁজ হলেও তিনি এরমধ্যে পুলিশের কাছে আসেননি। কারণ তিনি আশা করছেন, একদিন তার ছেলে জীবিত অবস্থায় নিশ্চয়ই ফিরে আসবে।

১৪। এই অনুসন্ধানী দলটির বেশিরভাগ সদস্য নারী। যাদের অধিকাংশের ছেলে নিখোঁজ হয়েছে। তবে পুরুষ সদস্যরাও এই দলের ভেতরে আছেন। তাদেরই একজন ডন পাঞ্চো। তিনি গত চার বছর ধরে তার ছেলে খুঁজছেন।

১৫। শুধু মা- বাবাদেরই নয় বরং শিশুদেরও এই নিখোঁজের ঘটনায় অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বিশেষ করে নিখোঁজের সন্তানরা বেড়ে হচ্ছে একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে। তারা জানতেও পারেনা যে তাদের বাবা বা মায়ের সঙ্গে কি হয়েছে। ছবির নারী লুসিয়া গুয়াদালুপের ছেলে ২০১৬ সালে নিখোঁজ হন। তার নাতনিও হয়ে পড়ে বাবাহারা।

No comments

Powered by Blogger.