কৌতূহল থেকে পর্নো আসক্তি by মোহাম্মদ ওমর ফারুক

শুরুটা কৌতূহল থেকে। ধীরে ধীরে তা পরিণত হয় আসক্তিতে। একসঙ্গে বন্ধু-বান্ধব মিলে বা বাসায় নিজের ঘরে নিরিবিলি পর্নো দেখছে কিশোর যুবকরা। প্রত্যেকের রয়েছে স্মার্টফোন-কম্পিউটার-ল্যাপটপ। স্বল্প খরচে ইন্টারনেটও পাচ্ছে তারা। হাজার হাজার পর্নোসাইটে প্রতি মিনিটে আপলোড হচ্ছে পর্নোগ্রাফি। শুধু ভিডিও পর্নোগ্রাফি নয়, অডিও পর্নোগ্রাফিও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে তাদের কাছে। কানে হেডফোন দিয়ে শুনতে পারছে রগরগে বয়ান।
এ অবস্থায় কিশোর ও যুবকরা বেড়ে উঠছে বিকৃত মানসিকতা নিয়ে। যার প্রভাব পড়ছে সমাজে। বাড়ছে ইভটিজিং ও ধর্ষণের মতো ঘটনা। এ নিয়ে কথা হয় আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম এবং অষ্টম শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই জানান,  বন্ধুদের কাছ থেকেই প্রথম পর্নো দেখার অভিজ্ঞতা হয় তাদের। এর মধ্যে কেউ কেউ জানান, স্মার্টফোন ব্যবহার করার সময় পর্নোসাইটের বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেখে তারা জীবনে প্রথম পর্নো দেখে। আবার কেউ ইউটিউবে বিদেশি ছবির বিভিন্ন দৃশ্য দেখে শুরু হয় পর্নোসাইটে ঢুঁ-মারার  আকাঙ্ক্ষা। 
সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, বাংলাদেশে নানা কারণে যৌনতা সম্পর্কিত ব্যাপারগুলোকে ট্যাবু হিসেবে দেখা হয়।  যৌনতা যে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার তা বাচ্চাদের শেখানো হয় না। যেহেতু তারা সঠিক যৌন শিক্ষা পায় না ও যৌনতাকে নিষিদ্ধ হিসেবে জানে তাই তারা নিষিদ্ধ পর্নোর দিকে ঝুঁকে পড়ে। আবার এসব শিশু যখন একবার আসক্তিতে পরিণত হচ্ছে তারা আর এ জায়গা থেকে বের হতে পারছে না। ফলে বিকৃত যৌন শিক্ষার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা এসব শিক্ষার্থীর পরিবার ও রাষ্ট্রের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতনতার পাশাপাশি সরকারকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও সমাজ এবং অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, আগেও কিশোর ও যুবকদের পর্নো ছবির প্রতি আসক্ত ছিল, এখনো আছে। তবে আগে ছিল খুব ব্যয়বহুল আর এখন আগের তুলনায় অনেক সহজলভ্য হয়েছে। যার ফলে আসক্তির সংখ্যাটা দিনে দিনে বাড়ছে। তিনি বলেন, আসক্তদের কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় পরিবার সদস্যরা এ ব্যাপারে জানতে পারলেও লোকলজ্জায় তাদের সন্তানদের কাউন্সেলিংয়ে দেয় না, সেটা একটি বড় সমস্যা। পর্নো আসক্ত বোঝার উপায় কি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আসক্ত কিশোর বা যুবক একা থাকার চেষ্টা করবে। কাউকে দেখলে মোবাইল লুকিয়ে ফেলবে। স্বাস্থ্যহানি হবে। তার বিপরীত জেন্ডারের প্রতি সহনশীল আচরণ থেকে বিরত থাকবে। এসব বিষয়গুলো যদি পরিবারের কোনো কনিষ্ঠ সদস্যদের মধ্যে দেখা যায় তাহলে বুঝতে হবে সে পর্নো আসক্তিতে ভুগছে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় দেখা গেছে,পর্নোগ্রাফি দেখার কারণে কিশোররা পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারে না। যৌন সহিংসতার প্রতি আকৃষ্ট হয়, অশ্লীলতার চর্চা বেড়ে যায়। সামাজিক মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে যায়, মনে ধর্ষণের ইচ্ছা জাগিয়ে তোলে। তাদের গবেষণায় দেখা যায়, রাজধানীতে স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের প্রায় ৭৭ ভাগ কোনো না কোনোভাবে পর্নোগ্রাফি দেখছে। ২০০৯ সালে শিশুদের পর্নো আগ্রহ নিয়ে এই ফাউন্ডেশনটি সর্বশেষ গবেষণা চালালেও এরপর আর এই বিষয়ে গ্রহণযোগ্য কোনো গবেষণা বা পরিসংখ্যান দেখা যায়নি।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা জানান, পর্নো আসক্তি ড্রাগের নেশা থেকে কোনো অংশে কম নয়, তা স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে তাদের জীবনে। পর্নো দেখলে মস্তিষ্কের একটা ‘ফিল গুড’ রাসায়নিক তৈরি হয়। এর নাম ডোপামিন। একটানা পর্নো  দেখলে মস্তিষ্কে ডোপামিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। তখন সামান্য ডোপামিনের ক্ষরণে উত্তেজনা তৈরি হয় না। আরো বেশি  ডোপামিনের জন্য মস্তিষ্কের আরো বেশি পর্নোর রসদ খোঁজে এবং আসক্তি বাড়িয়ে  তোলে। তাছাড়া, এসব দেখার কারণে কিশোর যুবকরা অলীক ফ্যান্টাসির জগতে চলে যায়। তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পর্নো  দেখে একা একা, সমাজের চোখ এড়িয়ে। এর ফলে ধীরে ধীরে একটা অপরাধবোধ জন্ম নেয়। যা থেকে ভবিষ্যতে মানসিক  রোগও হতে পারে। আর এসব নানান কারণে মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. ঝুনু শামসুন নাহার বলেন, মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব অন্যতম কারণ পর্নোসাইটগুলোর প্রতি আসক্তি বাড়া। স্কুলের শিক্ষক এবং মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই পারে এই আসক্তি থেকে তাদের বের করে আনতে। এই আসক্তি থেকে সন্তানদের বের করে না আনতে পারলে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঢেকে যাবে।
এই বিষয়ে সেভ দ্য চিলড্রেন-এর চাইল্ড প্রটেকশন অ্যান্ড চাইল্ড রাইটস গর্ভনেন্সের ডিরেক্টর আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, মূলত বিকল্প কোনো সুযোগ না থাকার কারণে পর্নে দেখার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। তারা যখন মোবাইল ফোনে বিভিন্ন সাইটে প্রবেশ করে ঠিক তখনই বিভিন্ন পর্নোসাইটের বিজ্ঞাপন সামনে আসে। যার কারণে অনেক সময় এসব দেখেও পর্নোসাইটগুলোতে তারা প্রবেশ করে। গতবছর পর্নোগ্রাফিক সব ধরনের ওয়েবসাইট বন্ধ রাখতে বাংলাদেশ  টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসিকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এমন নির্দেশ দেয়ার পরও সহজে প্রবেশ করা যাচ্ছে নানান পর্নোসাইটগুলোতে। এই বিষয়ে বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান জহুরুল হক বলেন, সবগুলো পর্নোসাইট বন্ধ করা কখনো সম্ভব না। আমরা বিভিন্ন সময় এসব বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেছি। এটা পুরোপুরি সম্ভব না।

No comments

Powered by Blogger.