বিদেশি বাচ্চা বলে প্রতিবেশীরা জুতা ফিক্যা মারে by মরিয়ম চম্পা

এটা শুধু একদল নারীর স্বপ্নভঙ্গের গল্প নয়। তাদের নিয়তি আর জীবন কীভাবে তছনছ হয়ে গেছে সে গল্প। অসহ্য আর দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে ফিরছে ওরা। বিমানবন্দরে নেমেই ভেঙে পড়ছে কান্নায়। কেউবা লজ্জায় মুখ ঢাকছে। বিদেশ ফেরত নারীদের জীবনের অবর্ণনীয় পরিস্থিতি নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন মানবজমিনের স্টাফ রিপোর্টার মরিয়ম চম্পা
তার বয়স মাত্র ১৯ বছর। বাড়ি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের বাস্তায়। বর্তমানে বাবা-মায়ের সঙ্গে নানা বাড়িতে থাকেন।
১৫ বছর বয়সে একই এলাকা চাষীনগরের রাজমিস্ত্রি আবুলের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। স্বামী মাদকাসক্ত হওয়ায় বিয়ের পরপরই তাকে ডিভোর্স করিয়ে নিয়ে আসেন রিকশাচালক বাবা। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। জন্মের পর থেকেই অভাব-অনটন দেখে বড় হয়েছেন। একবেলা খেয়ে থাকেন তো দুই বেলা না খেয়ে। বৃদ্ধ বাবা অনেক কষ্ট করে রিকশা চালিয়ে সংসারের হাল বাইতে বাইতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়েন। বাবার কষ্ট সইতে না পেরে একসময় সিদ্ধান্ত নেন বিদেশ গিয়ে অনেক টাকা কামাই করে পরিবারের দুঃখ কষ্ট দূর করবেন। স্থানীয় দালাল কাশেমের সহায়তায় ২০১৪ সালের শুরুর দিকে জর্ডান যান। কিন্তু সেখানে একটি চক্রের হাতে পড়ে দীর্ঘদিন ধরে যৌন-নিপীড়নের শিকার হন। যার ফলে জন্ম নেয় তার গর্ভের এই সন্তান।
কথা প্রসঙ্গে মানবজমিনকে বলেন, প্রথমে যে বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতাম সেখানে বেতন ধরা হয় ১৫ হাজার টাকা। এরই মাঝে দেখা হয় পূর্বপরিচিত মানিকগঞ্জেরই আরেক মেয়ে সোনিয়ার সঙ্গে। সে জানতে চায় বেতন কত। মাত্র ১৫ হাজার টাকা বেতন শুনে নাক সিটকে বলে আমার কাছে চলে আয় অনেক বেশি টাকা বেতনে তোকে কাজ জুটিয়ে দিবো। সে তাকে কাজ দেয়ার কথা বলে নিয়ে যায় তার বাড়িতে। সেখানে গিয়ে দেখেন পাঁচ তলা বাড়ির পুরোটাই ভাড়া নিয়েছে সোনিয়া। সেখানে তার মতো আরও ২০ জন মেয়ে আছে। এতগুলো মেয়ে একসঙ্গে থাকার কারণ জানতে চাইলে সোনিয়া জানায়, তারা যে কাজ করে, তাকেও একই কাজ করতে হবে। কী কাজ। জবাবে সোনিয়া বলেন পতিতাবৃত্তির কাজ। এ কথা জানার পরে চলে আসতে চাইলে সোনিয়া তাকে আটকে রাখে।
এরপর অন্য মেয়েদের মতো তাকে দিয়ে চলতে থাকে অসামাজিক কাজ করানোর চেষ্টা। রাজি না হওয়ায় চলে শারীরিক নির্যাতন। একের পর এক পুরুষ মানুষকে সঙ্গ দেয়ার কাজ। প্রতিদিনই ৪-৫ জন করে পুরুষ মানুষ আসতো। এরা বিভিন্ন দেশের নাগরিক ছিল। ইন্ডিয়ান, বাংলাদেশি, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কান। টাকাতো দূরের কথা ঠিকমতো খাবার দেয়া হতো না তাকে। সোনিয়া প্রায়ই তাকে ইনজেকশন দিতো। কেন দিতো জানতো না। হঠাৎ তার শরীর খারাপ লাগতে থাকে। ভয়ে কাউকে কিছু জানায় না সে। এক সময় অসুস্থ হয়ে পড়লে সোনিয়া তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এরপর দু’মাস জেলখানায় থাকেন। পরে তাকে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
গত ১৭ই এপ্রিল বাংলাদেশে আসেন তিনি। কিছুদিন বাদে তার হাত পায়ে পানি চলে আসে। এসময় তার মা তাকে প্রথমে কবিরাজের কাছে পরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। ডাক্তার আল্ট্রাসোনোগ্রাম করে জানান তার মেয়ে ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মা ডাক্তারকে বলেন বাচ্চাটা নষ্ট করা যাবে কি না। তখন ডাক্তার জানায়, ৬ মাসের বাচ্চা নষ্ট করতে অনেক টাকা লাগবে। আর সে সিদ্ধান্ত নেয় বাচ্চা নষ্ট করবেন না। পরবর্তীকালে ঈদের পর সিঙ্গাইরের একটি হাসপাতালে কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। মেয়ের বয়স এখন দেড় মাস। মেয়ে দেখতে বিদেশিদের মতো সুন্দর। বাচ্চার বাবা সম্পর্কে বলেন, ওর বাবাতো ইন্ডিয়ান। সে হিন্দিতে কথা বলতেন। তবে জর্ডানে থাকেন। তার নাম গর্জিত।
তিনি বলেন, বাচ্চা জন্মের আগে মানুষের অনেক অপমান বাজে কথা সহ্য করতে হয়েছে। এখন নতুন আরেক অশান্তি শুরু হয়েছে। সম্প্রতি প্রতিবেশীদের সঙ্গে পারিবারিক কলহের জেরের একপর্যায়ে বাচ্চার গায়ে জুতা ছুড়ে মারে। অল্পের জন্য বাচ্চার কপালে লাগেনি। তারা প্রায়ই গালি দিয়ে বলে বিদেশি বাচ্চা নিয়ে দেশে আসছে। বাপ ছাড়া বাচ্চা। আবার বড় বড় কথা কয়। লজ্জা শরমের মাথা খাইছে। বাবা-মা বলেন, তোর বাচ্চা যে বাঁচিয়ে রাখছি এটাতো অনেক বড় ভাগ্য। তবে স্থানীয় পুলিশ সুপার ও ওসি মিলে বাচ্চার খাওয়া খরচ বাবদ টাকা দিয়ে সাহায্য করছেন। বড় হয়ে বাচ্চা তার বাবার পরিচয় জানতে চাইলে কি বলবেন জবাবে বলেন, বলবো তোর বাবা এক্সিডেন্ট করে মারা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.