হেফাজতের গন্তব্য কোথায়?

অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে হেফাজতের উত্থান অনেকটা নাটকীয়। গণজাগরণ মঞ্চের কাউন্টার হিসেবেই আবির্ভাব ঘটেছিল কওমি মাদরাসাভিত্তিক এই সংগঠনটির। পাঁচ বছর আগে রাজধানীর শাপলা চত্বরে বড় শোডাউন করে আলোচনার শীর্ষে পৌঁছায় হেফাজত। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে বিতাড়িত হয় শাপলা চত্বর থেকে। সে সময় সংগঠনটি দাবি করেছিল, তাদের বহু কর্মী এ অভিযানে নিহত হয়েছেন। শাপলা অধ্যায়ের পর স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে হেফাজতের অনেক নেতাকর্মীকেই প্রকাশ্যে বিএনপি জোটের প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করতে দেখা যায়। আওয়ামী লীগ ও হেফাজতের অবস্থান ছিল তখন পুরোই বিপরীতমুখী।
কিন্তু ধীরে ধীরে সে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতাই হাটহাজারীতে হেফাজত হেডকোয়ার্টারে যাতায়াত বাড়াতে থাকেন।
হেফাজত আমীর আল্লামা আহমদ শফী ও তার ছেলে আনাস মাদানীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে ওঠে ক্ষমতাসীন মহলের। হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোর কার্যক্রমও থেমে যায়। সংগঠনটির দাবি অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনা হয়। সর্বশেষ হেফাজতের সবচেয়ে বড় দাবি, কওমি সনদের স্বীকৃতিও দেয়া হয়।
এতকিছুর পরও হেফাজতের রাজনৈতিক অবস্থান পুরোপুরি পরিষ্কার হওয়া যাচ্ছিলো না। তবে চলতি সপ্তাহে তা মোটামুটি খোলাসা হয়ে গেছে। সোমবার হাটহাজারীতে এক অনুষ্ঠানে হেফাজত আমীর আল্লামা আহমদ শফীর দেয়া বক্তব্য এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিপুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তিনি বলেছেন, কেউ কেউ বলেন, আমি আওয়ামী লীগ হয়ে গেছি। তারা কমবখত (নির্বোধ), তারা মিথ্যা কথা বলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে এমনি মহব্বত করে কওমি সনদের স্বীকৃতি দিয়েছেন। আমি আওয়ামী লীগ হই নাই। সেটা আপনাদের ভুল ধারণা। কী করে বলতেছেন, আমি আওয়ামী লীগ হয়ে গেছি? আমি আওয়ামী লীগ হয়ে গেলেও কোনো আপত্তি নাই।
কারণ, আওয়ামী লীগের মধ্যে এমন এমন মানুষ আছেন, যারা দ্বীনকে ভালোবাসেন। তারা আমাদেরকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে মাদরাসায় সাহায্য করেন। আল্লামা শফী আরো বলেন, আমাদের বিরাট উপকার করেছেন শেখ হাসিনা। তিনি কথা দিয়েছিলেন কওমি স্বীকৃতি দেবেন। কত জনে কত কথা বলেছেন, সেদিকে লক্ষ্য করেননি; স্বীকৃতি দিয়েছেন। আমি শেখ হাসিনার শুকরিয়া আদায় করছি। এ সময় তিনি সবাইকে শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করারও আহ্বান জানান। এর আগে শনিবার ঢাকায় হেফাজতপন্থিদের এক সমাবেশে সরকারদলীয় দুইজন এমপি উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন। সমাবেশে ঢাকা-১৫ আসনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীকেও পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। মূলত তাবলীগ ইস্যুতে এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। তাবলীগের একটি অংশের নেতারা বলছেন, এটি ছিল মূলত হেফাজতের নির্বাচনী সমাবেশ।
হেফাজত অবশ্য সবসময়ই রাজনৈতিক সংশ্রব অস্বীকার করে আসছে। সংগঠনটির নেতারা বলে আসছেন, তাদের কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই। যদিও হেফাজতের অনেক নেতাই বিভিন্ন ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এসব সংগঠন অবশ্য সময়ে সময়ে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে হেফাজতের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে সরকারের ভেতরে-বাইরে সমালোচনা রয়েছে। অনেক প্রগতিশীল ব্যক্তি এ নিয়ে প্রকাশ্যেই সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। তবে ভোটের রাজনীতিতে গুরুত্ব থাকার কারণে দুই জোটের পক্ষ থেকেই হেফাজতের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার চেষ্টা চলছে অনেকদিন ধরে। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ছাড়াও বিএনপি’র নেতাদেরও হাটহাজারীতে যেতে দেখা গেছে। বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের প্রতিনিধিরাও হেফাজতের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, গত কয়েক বছরে হেফাজতে দুটি ধারা গড়ে ওঠেছে। একটি ধারা সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার পক্ষপাতী। হেফাজত আমীরের পুত্র এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রেখে আসছেন। পিতাকেও তিনি এ ব্যাপাারে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছেন। আনাস মাদানীর প্রভাবেই গত কয়েক বছরে হাটহাজারীতে বেশকিছু পরিবর্তন এসেছে।  অন্যদিকে, হেফাজতেরই আরেকটি অংশ শাপলা চত্বরের ঘটনার জন্য সরকারকে দায়ী মনে করে। এ অংশটি বিএনপি’র সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষায় বরাবরই আগ্রহী। এ অংশে হেফাজতের অনেক শীর্ষ স্থানীয় নেতাই রয়েছেন। তবে এ অংশটি এখন অনেকটাই কোনঠাসা। ঘরে-বাইরে নানা চাপ রয়েছে তাদের ওপর।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যেভাবেই দেখা হোক না কেন ভোটের রাজনীতিতে হেফাজতের এক ধরনের প্রভাব রয়েছে। আগামী নির্বাচনে সংগঠনটির ভূমিকা এখন অনেকটাই খোলাসা হয়ে গেছে। তবে নেতাদের ভূমিকা আর তৃণমূলের ভূমিকা এক হয় কি-না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.