জর্ডানে জেসমিনের ওপর বর্বরতা by রিপন আনসারী

‘মদ খেয়ে প্রতিরাতে বাসার মালিক ও তার ছেলে যৌনক্ষুধা মিটাতো। মারধর, গরম খুন্তি দিয়ে পিঠে ছেঁকা আর  সারাদিন পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে আটকে রাখতো। এভাবে ওই বাসায় কয়েক মাস নির্যাতনের পর তুলে দেয়া হয় সোনিয়া নামের এক বাংলাদেশির কাছে। জর্ডানের দাম্মাম শহরের সোনিয়ার বাসাটি ছিল মিনি পতিতালয় তা জানা ছিল না।  ভেবেছিলেন বাঙালির কাছে আশ্রয় পেয়েছি ভালো থাকবো। তা আর হলো না।
আমার মতো আরো ২০ নারীকে দিয়ে ওই নারী যৌনকাজে বাধ্য করতো। একবার  পালিয়ে গিয়েও রক্ষা পাইনি। আবার ধরে নিয়ে  আমাকে তার বাসার নিচতলায় ভারতের নাগরিক নির্মাণ শ্রমিক গরজিদের কাছে তুলে দেয়।  কোনোভাবেই নিজেকে আর রক্ষা করতে পারলাম না। এক পর্যায়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ি। পরে সোনিয়া  টের পেয়ে আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়। দুই মাস জেল খাটার পর পেটে সন্তান বহন করে ১৮ই এপ্রিল ওই দেশের সরকারের সহায়তায় দেশে ফিরে আসি।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে লোমহর্ষক নির্যাতনের এই কাহিনী তুলে ধরেন জর্ডান ফেরত এক নারী।  মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার বাস্তা গ্রামের দরিদ্র এক রিকশাচালক তারা মিয়ার মেয়ে এখন কন্যা সন্তানের জননী। এ দায় কার, এনিয়ে দিশাহারা পরিবারটি। তাছাড়া, সমাজ এই পরিবারের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। গেল বৃহস্পতিবার সিংগাইরের একটি ক্লিনিকে পিতার নাম অন্য পরিচয়ে কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। তার দাবি এই সন্তানের পিতা ভারতীয় নাগরিক গরজিদ।
ওই নারী জানান, ১০ মাস তাকে বাসায় আটকে রেখে যৌনকাজে বাধ্য করা হলেও একটি টাকাও তুলে দেয়া হয়নি তার হাতে। শূন্য হাতেই তিনি বাড়ি ফিরেছেন। তিনি তার জীবনটা নষ্ট করার জন্য সোনিয়া আক্তারের উপযুক্ত শাস্তি দাবি করেন। সেই সঙ্গে এই কন্যা সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়েও দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। সামাজিক ভাবে কি পরিচয় দেবেন এই সন্তানের। প্রতিবেশীরা নানা ধরনের কথা  শোনাচ্ছেন তাকে ও তার পরিবারকে। তিনি জানান, শেষমেশ কোনো উপায় না পেয়ে মঙ্গলবার সিংগাইর থানায় মামলা করতে বাধ্য হয়েছি।
কথা হয় তার পিতা তারা মিয়ার  সঙ্গে। তিনি পেশায় একজন রিকশাচালক। নিজের জমি নেই। শ্বশুরবাড়িতে ছোট একটি টিনের দোচালা ঘরে বসবাস করেন। তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে এই মেয়ে সবার বড়। অভাবের সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে ১৫ বছরের মেয়েকে ২৫ বছর দেখিয়ে পাসপোর্ট করে দেয় স্থানীয় আদম ব্যবসায়ী কাশেম আলী। এরপর ১০ হাজার টাকা ঋণ করে ২০১৬ সালের ২৩শে অক্টোবর জর্ডানে পাঠানো হয়। কথা ছিল তার মেয়েকে নিয়ে বাসাবাড়িতে কাজ দেবেন। কিন্তু জর্ডানে যাওয়ার পর মেয়ের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। দালাল কাশেমের কাছে মেয়ের খোঁজ নিলে সে জানিয়ে দেয় জর্ডানে পাঠানো হয়েছিল কিন্তু সেখান থেকে সে  পালিয়ে গেছে। এর দায়িত্ব সে নিতে পারবে না। মেয়ের সন্ধান চেয়ে কাসেমের বিরুদ্ধে একটি  মামলাও করা হয়েছিল। দেড় বছর পর জানা যায় সিংগাইর উপজেলার চান্দহুর ইউনিয়নের চরচামটা গ্রামের নিহাজ উদ্দিনের মেয়ে সোনিয়ার কাছে জর্ডানে আছে। সোনিয়ার সঙ্গে মোবাইলফোনে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত হই।  
তারা মিয়া জানান, অবিবাহিত মেয়ে বিদেশ থেকে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে ফিরেছে। এলাকায় কানাঘোষা হচ্ছে। লজ্জায় বাড়ির বাইরে বের হতে  পারি না। নানাজনে নানা কথা বলে। সমাজের মাতবর আলেক উদ্দিন কোরবানি ঈদের আগে জানিয়ে দেন সমাজ থেকে তাদের বাদ দেয়া হয়েছে। সমাজের মানুষ তাদের পাশে নেই। কিন্তু যাদের জন্য আজ তার মেয়ের এই অবস্থা তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চান তিনি। এছাড়া বাধ্য হয়ে জর্ডান প্রবাসী সোনিয়াসহ আরো ৫ জনের বিরুদ্ধে মঙ্গলবার  সিংগাইর থানায় মামলা করা হয়েছে।
তিনি জানান, বড় আশা করে মেয়েকে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু মেয়ে নানা নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরেছেন। মেয়ের কন্যা সন্তান কার পরিচয়ে বড় হবে তা নিয়েই বেশি দুশ্চিন্তায় তিনি।
স্থানীয় দালাল আবুল কাশেমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, অনেক নারী শ্রমিককে তিনি বিদেশে পাঠিয়েছেন। এমন ঘটনা কারো সঙ্গে হয়নি। এর জন্য তিনি দায়ী নন, সোনিয়া নামের নারী তাকে দিয়ে খারাপ কাজ করিয়েছে। তারা মিয়া মামলা করেছিল, পরে বিদেশ থেকে ফেরার পর স্থানীয়ভাবে বসে মামলাটি আপোষ করা হয়েছে।
সিংগাইর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) খন্দকার ইমাম হোসেন জানান, অন্তঃসত্ত্বা হয়ে নারী শ্রমিক দেশে এসে সন্তান প্রসবের ঘটনার খবর শোনার পর  মেয়েটির পরিবারকে আইনগত সহায়তার আশ্বাস দিয়েছি। মঙ্গলবার  ভুক্তভোগী ওই নারী থানায় ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করলে এদের মধ্যে দুই আসামিকে আটক করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.