যেসব শিশুর সামনে পিতামাতাকে গুলি করেছে মিয়ানমারের সেনারা

কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শিশুদের মধ্যে ৬ হাজারের বেশি এতিম অথবা তাদের সঙ্গে তাদের পরিবারের কেউ নেই। এসব শিশুর বেশির ভাগের পিতামাতাকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের চোখের সামনে গুলি করে হত্যা করেছে। তাদের একজন রায়হান। তার বয়স ১০ বছর। তাদের গ্রামে যখন সেনাবাহিনী হানা দেয় তখন রায়হান তার বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলছিল। অকস্মাৎ সে দেখতে পায় তাদের এক প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে ধোয়া উঠছে। আস্তে আস্তে আগুনের শিখা আকাশে ছড়িয়ে পড়ে। রায়হান বুঝে নেয় কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। এক বছর আগে এমন ঘটনা ঘটে তার গ্রামে। রায়হান বলে, এমন অবস্থায় আমার পিতামামা ও বোনেরা আমাকে জড়িয়ে ধরে দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করে। কিন্তু আমার পিতামাতাকে ধরে ফেলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তারা আমাদের সামনেই গুলি করে হত্যা করে। এ সময় আমার বোনেরা তাদের দিকে দৌড়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সেনারা তাদেরকেও গুলি করে হত্যা করে। তখন কি করতে হবে আমি বুঝতে পারি নি। ভয়ে আমার হাতপা কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল আমার দেহ থেকে সব রক্ত শেষ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল আমি অচল হয়ে গেছি। বুঝতে পারছিলাম না দৌড়ে পালাতে পারবো কিনা। বুঝতে পারি নি কোথায় যাচ্ছি আমি। মাটিতে পড়ে আছেন আমার পিতামাতা ও বোনদের লাশ। সে দৃশ্য আমাকে হৃদয়ে ঝড় তুলছে। তবু তাদেরকে পিছনে ফেলে আমি ছুটতে থাকি।
দৌড়াতে দৌড়াতে রায়হান পৌঁছে যায় সামনের এক গ্রামে। সেখান থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের একটি গ্রুপ পালাচ্ছিল। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় রায়হান। তারপর তিন দিন ধরে হাঁটতে থাকে। এরপরই নাগাল পায় বাংলাদেশের। রায়হান বলে, আমাকে ওই গ্রুপের কেউই চিনতো না। আমি বুঝতে পারি নি কি করতে হবে। আমি শুধু ওই দলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছুটতে থাকি। ওই দিনগুলোতে আমার আর কিছু খাওয়া হয় নি।
গত বছর আগস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী যে নৃশংসতা চালায় তাতে কমপক্ষে ৭ লাখ মানুষ পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। তার মধ্যে সবচেয়ে বিপন্ন অবস্থায় যারা আছে তারা হলো এতিম, নিঃসঙ্গ শিশুরা। এ সপ্তাহে প্রকাশিত নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, পিতামাতা বা অভিভাবক নেই এমন রোহিঙ্গা শিশুকে আলাদা করা হয়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের জরিপে দেখা গেছে ১৩৯টি রোহিঙ্গা শিশু নিঃসঙ্গ বা তাদের পিতামাতা নেই। এমন শিশুদের আলাদা করে তাদের দূরবর্তী পরিবার বা পালক পিতামাতার কাছে দেয়া হয়েছে ক্যাম্পে। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে জটিলতা। ইউনিসেফের মতে, কক্সবাজারে পুরো শরণার্থী শিবিরের মোট জনসংখ্যার মধ্যে শতকরা ১০ ভাগই অভিভাবক ছাড়া অবস্থান করছে।
রায়হান এখন তার পিতামাতাকে ভীষণ মিস করে। সে আশ্রয়শিবিরে তার এক নিকট আত্মীয়াকে খুঁজে পেয়েছে। এতে রায়হান নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করে। তারপরও তার মধ্যে হতাশা। সে বলে, এখন আমার ওই আন্টি ছাড়া আমি জানি না আর কোথায় আমার জায়গা আছে। আবার আমি আগের মতো ফুটবল খেলা শুরু করেছি।
রায়হানের মতো আরেক শিশু আরেফা। যখন সেনাবাহিনী তার গ্রামে হানা দেয় তখন তার বয়স ১৬ বছর। সে তখন পানি আনতে গিয়েছিল। ফিরতে গিয়ে সে দূর থেকে দেখতে পায় তাদের বাড়ির বাইরে সেনাবাহিনী। তা দেখে সে একটি জঙ্গলের আড়ালে লুকায়। দেখতে থাকে সেনারা গুলি ছুড়ছে। প্রথমে তারা গুলি করছে বয়স্ক মানুষদের দিকে। তারপর শিশুদের দিকে। যখন প্রাপ্ত বয়স্করা তাদেরকে থামার অনুরোধ করে তখন সেনারা তাদের দিকেও গুলি ছোড়ে। এ সময় আরেফার সামনে যাদেরকে হত্যা করা হয় তার মধ্যে ছিল তার পিতা, মাতা, সাত ভাই ও বোন। তাদের লাশ পিছনে ফেলে সে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। এখন একা একা অবস্থান করছে। মাঝে মাঝে কাউন্সিলিং পাচ্ছে। ২৩ বছর বয়সী বাংলাদেশী নৃবিদ্যার ছাত্রী কেয়া তার সঙ্গে সপ্তাহে একবার সাক্ষাত করেন। কেয়া সেভ দ্য চিলড্রেনের হয়ে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেছেন, আরেফার মনের ভিতর এতটাই ক্ষত যে সে পালক পিতামাতার সঙ্গে বসবাস করতে পারবে না। এখন আরেফার বয়স ১৭ বছর। সে একা একা বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে এরই মধ্যে সবাইকে হারিয়েছে। সে অন্য কোন পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতে চায় না।
কেয়া যাদেরকে দেখাশোনা করেন তাদের মধ্যে আরেকজন তাসমিন। তার বয়স ১৫ বছর। মারাত্মক বিকলাঙ্গ সে। তার রয়েছে জন্মগত ত্রুটি। সে তার পা ব্যবহার করতে পারে না। মিয়ানমারে তার পিতা একজন বেকারির ব্যবসায়ী ছিলেন। তার ওপরই পুরোপুরি নির্ভর করতে হতো তাকে। তাসমিনকে দেখাশোনার জন্য পৃথিবীর বুকে একমাত্র তার পিতাই ছিলেন। গত বছর যখন সেনাবাহিনী তাদের বাড়িতে হানা দেয় তখন তাসমিন রান্নাঘরে পালায়। সে দেখতে পায় গ্রামের ২০ থেকে ৫০ বছর বয়সী পুরুষদেরকে সেনারা লাইন দিয়ে দাঁড় করাচ্ছে। এরপর তাদেরকে গুলি করে হত্যা করছে। তাদের মধ্যে ছিলেন তার পিতাও। এ ঘটনার পর হামাগুঁড়ি দিয়ে ১২ দিন ধরে বাংলাদেশের দিকে অগ্রসর হয় সে। নিজের হাতের ওপর ভর করে সামনে এগুতে থাকে শরীরটাকে নিয়ে। কেয়া বলেন, বাংলাদেশে এই আশ্রয়শিবিরে যখন সে আসে তখন তার শরীর ভরা ছিল রক্ত। তার হাতে কেটে গিয়েছিল। সেখানে সংক্রমণ দেখা দিয়েছিল। তাসমিন এখন এক পালক পরিবারের আশ্রয়ে আছে। সহায়তা কর্মীরা তাকে একটি হুইল চেয়ার দিয়েছে। দেয়া হচ্ছে মানসিক কাউন্সিলিং।
এ অবস্থায় সেভ দ্য চিলড্রেন বলছে, এই আশ্রয় শিবিরে এসব এতিম শিশু অপহরণ, যৌনতা ও শ্রমে নিয়োজিত হওয়ার সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশে সেভ দ্য চিলড্রেনের ডিরেক্টর মার্ক পিয়ার্স বলে, ১২ মাস আগে আমাদের টিমের সদস্যরা দেখতে পান এসব শিশু একা একাই বাংলাদেশে আসছে। তখন তারা এতটাই হতাশায়, ক্ষুধার্ত ও নিঃশেষিত অবস্থায় ছিল যে, কথা পর্যন্ত বলতে পারছিল না। (লন্ডনের দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট অবলম্বনে)

No comments

Powered by Blogger.