রোহিঙ্গা ইস্যু: জাতিসংঘে আলাপ হলো, উদ্যোগ নেই

রোহিঙ্গা ইস্যুতে জোরালো বিতর্ক হয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে। সেখানে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নৃশংস নির্যাতনের বিচার  দাবি করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরাঁ। পাশাপাশি মঙ্গলবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি মিয়ানমারের এ অপরাধকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে নেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছে সুইডেন ও নেদারল্যান্ডস।
কিন্তু মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠবন্ধু রাষ্ট্র চীন মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক মহলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলেছে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্ভাব্য সব উপায় অবলম্বন করে মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবর্তনে কাজ করতে দেয়া উচিত। ওদিকে অস্কার বিজয়ী অভিনেত্রী ও জাতিসংঘের শুভেচ্ছাদূত কেট ব্লানচেট বলেছেন, আমরা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছি। তিনি মঙ্গলবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমার পরিস্থিতি ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বক্তব্য দেন।
ব্লানচেট বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ওপর যে ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়েছে তার বীভৎস চিত্র তার মনের ভেতর। এমন অভিজ্ঞতার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবিরে তাদের ভয়াবহ দুর্ভোগ নিজের চোখে দেখেছেন তিনি। কেট ব্লানচেট নিজে একজন মা। তাই শরণার্থীদের প্রতিটি শিশুকে দেখে তার মনে নিজের সন্তান যেন জেগে উঠেছিল। আবেগতাড়িত কেট ব্লানচেট নিরাপত্তা পরিষদের কাছে প্রশ্ন রাখেন, নিজের শিশুকে আগুনে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে এই দৃশ্য কোনো মা সহ্য করতে পারেন? আমাদের সামনে কোনো বিকল্প নেই। আমরা রোহিঙ্গা ইস্যুতে ব্যর্থ হয়েছি। আমরা যেন আবার ব্যর্থ না হই। বার্তা সংস্থা এপির খবরে এ কথা বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংস নির্যাতনের বছরপূর্তিতে মঙ্গলবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক বসে। সেখানে জাতিসংঘ মহাসচিব ওই আহ্বান জানান।
বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদেরকে দেখা হয় বহিরাগত হিসেবে, যদিও প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা সেখানে বসবাস করছে। ১৯৮২ সাল থেকে সেখানে প্রায় সব রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান করা হয়। এর ফলে তারা হয়ে পড়ে রাষ্ট্রহীন। তাদের চলাফেরা ও মৌলিক অধিকার প্রত্যাখ্যান করা হয়। গত বছর ২৫শে আগস্ট আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা) হামলা চালায় নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের ওপর। এতে তাদের কয়েকজন নিহত হয়। এর প্রতিশোধ নিতে সেনারা নিরস্ত্র সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর চালাতে থাকে নৃশংস নির্যাতন। ধর্ষণ, হত্যা, নির্যাতন, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
বিষয়টিকে জাতিসংঘ মহাসচিব জাতি নিধন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি মঙ্গলবার নিরাপত্তা পরিষদের কাছে জাতিসংঘের তদন্ত ও সুপারিশের বিষয়ে কথা বলেন। বলেন, এসব তদন্ত ও সুপারিশ জাতিসংঘের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পরিষদ বা সংগঠনের গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনার দাবি রাখে। তিনি বলেন, জবাবদিহি বা বিচারের মেকানিজম বিশ্বাসযোগ্য, স্বচ্ছ, পক্ষপাতহীন, নিরপেক্ষ এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি মিয়ানমারের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে তা নিশ্চিত করতে কার্যকর আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জাতিসংঘে নিযুক্ত সুইডেনের উপ রাষ্ট্রদূত কার্ল স্কাউ আরো একটু এগিয়ে বলেছেন, মিয়ানমারের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী যে ভয়াবহ মাত্রায় নৃশংসতা চালিয়েছে তাতে তার দেশ রোহিঙ্গা সংকটকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে পাঠানোর আহ্বান জানায়। তিনি বলেন, আমরা বিশ্বাস করি সামনে এগিয়ে যাওয়ার এখনই সময়। এ বিষয়ে পরিষদের সদস্যদের মধ্যে একটি প্রস্তাবের বিষয়ে আমাদের উচিত পরামর্শ করা।
নিরাপত্তা পরিষদের ওই অধিবেশনে বক্তব্য দেন মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত ইউ হাউ ডো সুয়ান। জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সঙ্গে তার সরকার কেন সহযোগিতা করেনি সে বিষয়ে তিনি বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, তারা পক্ষপাতিত্বহীন হবে কি না এ নিয়ে উদ্বেগ ছিল বলে তার সরকার ওই মিশনকে সহযোগিতা করেনি। তিনি বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের এই বৈঠকের আগে প্রকাশ করা হয়েছে ওই রিপোর্ট। ফলে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের উদ্দেশ্য, পক্ষপাতিত্বহীনতা ও আন্তরিকতা নিয়ে গুরুত্বর প্রশ্ন রয়েছে।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় উগ্রপন্থি একটি গ্রুপ যে হামলা চালিয়েছিল তার প্রেক্ষিতে প্রতিটি নাগরিকের জান ও মালের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য মিয়ানমারের নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা অভিযান চালিয়েছে। এর ফলে অনেক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তে মিয়ানমার সরকার একটি ইন্ডিপেন্ডেন্ট কমিশন অব ইনকুয়ারি গঠন করেছে।
তারা এক বছরের মধ্যে রিপোর্ট দেবে। এতে নেতৃত্বে রয়েছেন ফিলিপাইনের সাবেক উপ পরারাষ্ট্রমন্ত্রী রোজারিও মানালো। তার সঙ্গে আছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত জাপানের সাবেক রাষ্ট্রদূত কেনজো ওশিমা ও মিয়ানমারের দুজন সদস্য। নিরাপত্তা পরিষদে বক্তব্য দেন চীনের জাতিসংঘে নিযুক্ত উপ রাষ্ট্রদূত উউ হাইতাও।
তিনি বলেন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশকে রাখাইন ইস্যুটি দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান করা উচিত। এখন যে বিষয়ে জোর দেয়া উচিত তা হলো যত তাড়াতাড়ি পারা যায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন শুরু করা। এক্ষেত্রে কোনো পূর্বশর্ত দেয়া উচিত নয়। প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া চলাকালে অবাধে চলাফেরা ও নাগরিকত্বের মতো বিষয়গুলো আস্তে আস্তে সমাধান করা উচিত। এক্ষেত্রে রাখাইনে যে দারিদ্র কমে আসছে সেদিকে দৃষ্টি দেয়া উচিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের।
তাই ধৈর্য ধরা উচিত এবং মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনাকে প্রমোট করা উচিত। এক্ষেত্রে একটি ভারসাম্য ও সংঘাতহীন একটি পদক্ষেপের আহ্বান জানান জাতিসংঘে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভাসিলি নেবেনজিয়া। তিনি বলেন, রাখাইনের গভীর সমস্যাকে শান্তিপূর্ণ ও কূটনৈতিক উপায়ে সমাধান করা উচিত। তিনি আশা করেন, এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই ধৈর্যের পরিচয় দেবেন।
পরিষদে বক্তব্য দেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। তিনি বলেন, প্রতি সপ্তাহেই রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের নতুন নতুন প্রমাণ মিলছে। তাদের বিরুদ্ধে যে নৃশংস অপরাধের প্রমাণ বেরিয়ে আসছে তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানান। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ। তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, কিন্তু তা এখন পর্যন্ত ন্যূনতমভাবে শুরুও করা যায়নি। যতক্ষণ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের তাদের নিরাপরাত্তা, নিজেদের বাড়ি ফেরা, চলাফেরার স্বাধীনতা, কাজ করার সুযোগ, মিয়ানমারে তাদের নাগরিকত্বের দাবি মেটানো হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া শুরু করা যাচ্ছে না।
নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বৃটিশ মন্ত্রী লর্ড তারিক আহমাদ। তিনি বলেন, অনেক দেশই এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করছে। বাংলাদেশকে সহায়তা করার নতুন করে প্রতিশ্রুতি রয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধানের একটি চুক্তি রয়েছে। তবে যা করার তার মধ্যে জবাবদিহির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যারা এসব অপরাধ করেছে তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। ২০১৭ সালের আগস্টের পর জাতিসংঘের এজেন্সি ও মিয়ানমার সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এটা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।

No comments

Powered by Blogger.