লাদেন যোদ্ধা ছিলেন না, যুদ্ধে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন: সাবেক সৌদি গোয়েন্দা প্রধান

সাবেক আল-কায়েদা প্রধান নিহত ওসামা বিন লাদেন বিভিন্ন ভিডিও বার্তায় অস্ত্র হাতে হাজির হতেন। তার হাতে থাকতো অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। ২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন সিল বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার প্রায় সাত বছর পর সৌদি আরবের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান প্রিন্স তুর্কি আল-ফয়সাল জানান, ওসামা যোদ্ধা ছিলেন না, আফগানিস্তানে একবার যুদ্ধের সময় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি একথা জানিয়েছেন।
১৯৭৭ সাল থেকে ২০০১ সালের ১ সেপ্টেম্বর (৯/১১ হামলার মাত্র দশদিন আগে) পর্যন্ত সৌদি আরবের গোয়েন্দা প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন প্রিন্স ফয়সাল। সম্প্রতি দ্য গার্ডিয়ানের সঙ্গে জেদ্দাতে নিজের ভিলায় কথা বলেন।
ওসামা বিন লাদেন সম্পর্কে প্রিন্স ফয়সাল বলেন, দুজন ওসামা বিন লাদেন রয়েছেন। একজন আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখল শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত। আরেকজন এরপরের। প্রথমজন ছিলেন আদর্শবাদী মুজাহিদ। তিনি যোদ্ধা ছিলেন না। নিজেই (ওসামা) স্বীকার করেছেন, একবার যুদ্ধে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। যখন তিনি জ্ঞান ফিরে পান ততক্ষণে তাদের অবস্থানে সোভিয়েত হামলা পরাজিত হয়েছে।
ওসামা যখন আফগানিস্তান থেকে সুদানে যান তখন সৌদি আরবের সঙ্গে তার সংযোগের কথা আলোচিত হতে থাকে। তখন প্রিন্স ফয়সাল সৌদি আরবের হয়ে ওসামার সঙ্গে কথা বলেন। ৯/১১ হামলার পর ওসামার সঙ্গে প্রিন্সের এই সরাসরি যোগাযোগ গভীরভাবে খতিয়ে দেখা হয়। হামলার প্রায় ১৭ বছর পর নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে নিহত ২,৯৭৬ জন ও আহত ছয় সহস্রাধিক মানুষ বিশ্বাস করেন না যে দেশ রক্ষণশীল চিন্তা-ভাবনার জন্ম দিয়েছে, এই হামলায় তাদের কোনও দায় নেই।
নিশ্চিতভাবেই ওসামা আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন সৌদি আরবের সমর্থন নিয়েই। কারণ আফগানিস্তানে সৌভিয়েত দখলের বিরোধিতা করে আসছিল সৌদি আরব। সোভিয়েত দখলের বিরুদ্ধে যারা লড়াই করছিল যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় সৌদি আরব তাদের সমর্থন ও অস্ত্র সরবরাহ করছিল। তরুণ মুজাহিদ ওসামা নিজের সম্পদের সামান্য অংশ সঙ্গে নিয়ে আফগানিস্তানে পাড়ি দেন। প্রভাব বিস্তারে তিনি এই সম্পদ ব্যবহার করেন। কিন্তু যখন তিনি আফগানিস্তান থেকে পুনরায় জেদ্দায় ফিরেন সোভিয়েতকে পরাজিত করে তখন তিনি অন্য মানুষের পরিবর্তিত হয়েছেন।
প্রিন্স ফয়সাল বলেন, ‘১৯৯০ সাল থেকে অনেক বেশি রাজনৈতিক আচরণ গড়ে উঠে ওসামার মধ্যে। তিনি কমিউনিস্টদের উৎখাত করতে চাইছিলেন। ইয়েমেন থেকে দক্ষিণ ইয়েমেনি মার্কসবাদীদের উৎখাত করতে চেয়েছিলেন। আমি তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলাম। বলেছিলাম এসবের সঙ্গে জড়িয়ে না পড়ার জন্য। ওই সময় জেদ্দার মসজিদগুলো আফগান উদাহরণ তুলে ধরছিল।’ এর মধ্য দিয়ে সৌদি আরবে তালেবানদের আদর্শ ছড়িয়ে পড়ার ইঙ্গিত দেন এই গোয়েন্দা প্রধান। তিনি আরও বলেন, ‘ওসামা সৌদি আরবের মুসল্লিদের উসকানি দিচ্ছিলেন। তাকে এসব থামানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।’
সাবেক সৌদি গোয়েন্দা প্রধান বলেন, ‘ওসামার নির্বিকার মুখ ছিল। তিনি কখনও মুখ বিকৃত করতেন না বা হাসতেন না। ১৯৯২, ১৯৯৩ সালে পাকিস্তানের পেশাওয়ারে নওয়াজ শরিফের সরকার অনেকগুলো বড় বড় বৈঠক আয়োজন করে।’ ওই সময় ওসামাকে আফগান উপজাতি নেতারা শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দিয়েছেন। প্রিন্স ফয়সাল বলে চলেন, বিশ্বের মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান ছিল ওই বৈঠকগুলোতে। একে অপরের গলাকাটা থেকে মুসলিম বিশ্বের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এক বৈঠকে আমি ওসামাকে দেখতে পাই। আমাদের চোখে চোখে দেখা হয়, কিন্তু কথা হয়নি। এরপর তিনি সৌদি আরব যাননি। সুদান চলে যান। সেখানে তিনি মধুর ব্যবসা শুরু করেন এবং একটি সড়ক নির্মাণে অর্থায়ন করেন।
বিদেশে থাকা অবস্থায় ওসামার ধর্মীয় নির্দেশনা বাড়তে থাকে। প্রিন্স ফয়সালের ভাষায়, তিনি সবাইকে ফ্যাক্স করে বিবৃতি পাঠাতেন। খুবই সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তার। পরিবার থেকে তাকে বোঝানোর নিরন্তর চেষ্টা করা হয়েছিল, অনেক প্রতিনিধি পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সবকিছুই ব্যর্থ হয়। সম্ভবত তিনি ভাবছিলেন সরকার তাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছিল না।’
১৯৯৬ সালে লাদেনকে আফগানিস্তানে ফিরিয়ে আনা হয়। প্রিন্স জানান, সৌদি আরব জানত ওসামা একটি বড় সমস্যা এবং তাকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল। তিনি আফগানিস্তানের কান্দাহার যান এবং তৎকালীন তালেবান প্রধান মোল্লা ওমরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। “তিনি (ওমর) বলেন, ‘আমি তাকে (ওসামা) হস্তান্তরের কেউ নই, কিন্তু তিনি আফগান মানুষের জন্য অনেক উপকার করেছেন।’ তিনি বলেন যে ওসামাকে ইসলামি আইনে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।”
দুই বছর পর ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রিন্স ফয়সাল আবার আফগানিস্তান যান। এবার তাকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়। ওমরের সঙ্গে ওই বৈঠকের কথা জানিয়ে প্রিন্স ফয়সাল বলেন, “তখনকার বৈঠকে ওমর ছিলেন একেবারে বদলে যাওয়া এক মানুষ। অনেক বেশি রক্ষণশীল, ঘামছিলেন সারাক্ষণ, যৌক্তিক কারণ না শুনে তিনি (ওমর) বলেন, ‘মুসলিমদের সাহায্যের জন্য যে ব্যক্তি নিজের জীব ন উৎসর্গ করেছেন তাকে আপনারা কিভাবে বিচারের মুখোমুখি করতে চান?’”
আফগানিস্তানের জনগণের ক্ষতি করছেন বলে মোল্লা ওমরকে সতর্ক করে প্রিন্স ফয়সাল চলে যান।
পরের বছর যখন ওসামার পরিবার কান্দাহারে গিয়ে সাক্ষাৎ করে তার কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র একটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ওই হামলা চালানো হয়েছিল ওসামার অবস্থানকে টার্গেট করে। তাঞ্জানিয়া ও কেনিয়ায় মার্কিন দূতাবাসে আল-কয়েদার হামলার ঘটনায় পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে এই হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। ওই সময় পরিবার ওসামার অবস্থান ও খোঁজ তাৎক্ষণিকভাবে পেলেও সৌদি আরব ও পশ্চিমা গোয়েন্দাগুলো পায়নি।
ওয়াশিংটন, লন্ডন ও রিয়াদের কর্মকর্তাদের কাছে বিশ্বের সন্ত্রাসদমনের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন ওসামা। যে ওসামা সৌদি নাগরিকদের হামলায় ব্যবহার করে পশ্চিমা ও পূর্বের সভ্যতার মধ্যে ফাটল ধরান।
এক ব্রিটিশ গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ওসামা ইচ্ছাকৃতভাবেই যে ৯/১১ হামলার জন্য সৌদি নাগরিকদের নির্বাচন করেছেন, এতে কোনও সন্দেহ নেই। তিনি মনে করেছিলেন, এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমাদের তার দেশের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো যাবে। ওসামা একটি যুদ্ধের উস্কানি দিতে পেরেছিলেন, কিন্তু ঠিক তিনি যে যুদ্ধ চেয়েছিলেন তা নয়।
সাবেক সৌদি গোয়েন্দা প্রধান দাবি করেন, ৯/১১-এর কয়েক মাসে তার সংস্থার সংগৃহীত তথ্যের মাধ্যমে তারা জানতে পেয়েছিলেন ভয়ংকর কিছুর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ২০০১ সালের গ্রীষ্মে আমি মার্কিন, ব্রিটিশ, ফরাসি ও আরবদের একটি সতর্ক বার্তা পাঠাই। আমরা জানতাম কোথায় ঘটবে কিন্তু জানতাম যে কিছু একটা ঘটতে চলেছে।
সৌদি আরবের কিছু অংশে এখনও জনপ্রিয় ওসামা। তার কাজের প্রশংসা করেন অনেকে। তবে তাদের এই সমর্থনের গভীরতা কতটুকু পরিমাপ কার মুশকিল। ওসামার নিজের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দুই স্ত্রীকে সৌদি আরবে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এদের একজন অ্যাবোটাবাদে নিহতের সময় তার সঙ্গে ছিলেন। দুই স্ত্রী ও তাদের সন্তানরা এখন জেদ্দাতে বাস করছেন।

No comments

Powered by Blogger.