সড়ক দুর্ঘটনা: ক্ষতিপূরণ আর মেলে না by মরিয়ম চম্পা

মামলার রায় হয়, আপিল হয়। কিন্তু শেষ হয় না। পায় না ক্ষতিপূরণ। সড়ক দুর্ঘটনায় হওয়া বেশ কিছু মামলা পর্যবেক্ষণ করে মিলেছে এমন তথ্য। এমনিতেই বেশির ভাগ মানুষ মামলায় যায় না। যারা যায় তাদের বছরের পর বছর ঘুরতে হয় আদালতের বারান্দায়।
১৯৮৯ সালে দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টু মতিঝিলে বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন। তার স্ত্রী রওশন আরা আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়ে বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে মামলা করেন। নিম্ন আদালত আর্থিক ক্ষতিপূরণের রায় দেন। ২৫ বছর পর ২০১৪ সালের ২০শে জুলাই সাংবাদিক মন্টুর পরিবারকে ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখে আপিল বিভাগ। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত কাউকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা দেশে এটাই প্রথম যদিও দুর্ঘটনার দীর্ঘ ২৭ বছরেও ক্ষতিপূরণ পায়নি এই পরিবার। বাদী রওশান আরা বলেন, ‘দুর্ঘটনার সময় আমাদের বড় ছেলের বয়স ৯ বছর আর ছোট ছেলে ছিল ৫ বছরের। তখনই আমি মামলা করেছিলাম। এই ২৭ বছরেও আমরা ক্ষতিপূরণ পাইনি। উল্টো ১৯৯১ সালে নিম্ন আদালতের রায় দেয়া ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ কমতে কমতে ১ কোটি ৬৯ লাখে এসে ঠেকেছে। গত ২৭ বছরে এই মামলা চালাতে গিয়ে সব হারিয়েছি। কিছুই পাইনি। এখনও মামলা চলছে।’
২০১১ সালের ১৩ই আগস্ট মানিকগঞ্জের জোঁকা এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও চিত্রগ্রাহক-সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ কয়েকজন। নতুন চলচ্চিত্র কাগজের ফুল-এর শুটিংয়ের স্থান দেখতে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর সহকর্মীদের নিয়ে মানিকগঞ্জে যান। ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তারা। ২০১৪ সালের ২৯শে নভেম্বর কাওরান বাজার এলাকায় বাস থেকে নামতে গিয়ে পেছনের চাকায় পিষ্ট হয়ে নিহত হন বার্তা সংস্থা বাসসের সাবেক প্রধান সম্পাদক জগলুল আহমেদ চৌধুরী। সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবারকে ৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। তিন মাসের মধ্যে বাস মালিক, চালক ও সংশ্লিষ্ট বীমা প্রতিষ্ঠানকে এই টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে বাসচালক ৩০ লাখ, বাস মালিক ৪ কোটি ৩০ লাখ ৯৫ হাজার ৪৫২ ও রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সকে ৮০ হাজার টাকা দিতে হবে। এই রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা লিভ টু আপিল বর্তমানে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
আইনে বলা আছে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বা আহত হওয়ার ঘটনায় দায়ীদের শাস্তি চাওয়ার পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ চেয়েও আদালতে মামলা করতে পারেন পরিবার ও স্বজনরা। তবে বিভিন্ন আইনের সীমাবদ্ধতা ও অতিরিক্ত কোর্ট-ফির কারণে ক্ষতিপূরণ মামলার সংখ্যা কম। এ বিষয়ে দেশের আইনজীবীরাও তেমন আগ্রহ দেখান না বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা। তবে সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণের মামলা হচ্ছে এবং নিজেদের পক্ষে রায়ও পাচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
রওশন আরার আইনজীবী খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশে ক্ষতিপূরণ মামলা করার প্রচলন তেমন নেই। কারণ ক্ষতিপূরণ মামলা মূলত টর্ট আইনেই করতে হয়। এই আইনের মাধ্যমে মামলা দায়ের করে সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ আদায় করা সম্ভব, তবে আইনজীবীদের অনীহার কারণে তা ফলপ্রসূ হয় না।’ সাধারণ অর্থে টর্ট বলতে বোঝায় কোনো ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদান। তাই টর্ট আইনেই সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণের মামলা করা আইনের সবচেয়ে ভালো দিক। টর্ট আইনে ক্ষতিপূরণ মামলা করার নিয়ম, ‘যদি কোনো ব্যক্তি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন, তার পরিবার বা স্বজনরা এক্ষেত্রে দুটি মামলা করতে পারে না, একটি নিহতের ঘটনায় বিচারের আর্জি। অন্যটি ক্ষতিপূরণ মামলা।’ মামলা করার ক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তির পেশা, আয় ও আয়ু বিবেচনা করা হয়। তবে টাকার অঙ্ক বেশি হলে কোর্ট ফি বেশি হয়। টাকার অঙ্কের ওপর এই ফি নির্ধারণ করা হয়। এর ক্যাটাগরি করা আছে। এই ফি এতই বেশি যে অসচ্ছলদের পক্ষে ক্ষতিপূরণ মামলা করা অসম্ভব। এ কারণেই অনেকে ক্ষতিপূরণ মামলা করতে যায় না। তাছাড়া সময়ক্ষেপণও হয়।’ মামলার পর কবে নাগাদ ক্ষতিপূরণ পাবেন, তা আসলে নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারবে না।
এ কারণেই মানুষের মধ্যে এই মামলা করার ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহ দেখা যায় না।’ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির ক্ষেত্রে অপরাধীর শাস্তি হওয়ার নজির কম। আবার কখনও কখনও ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে সালিশ বৈঠকের মাধ্যমেও মীমাংসা হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এর আগে সড়ক পরিবহন ও চলাচল আইন ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৫-এর খসড়ায় মোটরযান চালিয়ে অপর ব্যক্তির মৃত্যু ঘটালে তিন থেকে সাত বছর পর্যন্ত শাস্তির বিধান ছিল। এ ছাড়া নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীকে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ এবং চালকের দোষসূচক পয়েন্ট কাটার প্রস্তাবও করা হয়েছিল। আর কেউ আহত করলে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল এবং আহত ব্যক্তিকে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের বিধান ছিল। তবে নতুন আইনে এগুলো নেই। অভিযোগ উঠেছে, গাড়ির মালিক ও চালকদের চাপে এগুলো বাদ পড়েছে। এর আগে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গাড়িচালকদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় মামলা না করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ৩০২ ধারায় সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হলে মামলা হবে ৩০৪(খ) ধারায়। এই ধারায় সর্বোচ্চ সাজা তিন বছরের কারাদণ্ড।
যাত্রীদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী একটি সংগঠন জানায়, বাংলাদেশে ৮০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা মামলা করেন না। সংগঠনটি বলছে, পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের ভয়ে এবং মামলার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের আইনের আশ্রয় নেয়ার প্রবণতা কম। ঢাকার রাস্তায় যাত্রীবাহী বাসের বিশৃঙ্খল প্রতিযোগিতায় একের পর এক মৃত্যুর ঘটনায় আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, রাস্তার নৈরাজ্য নিয়ে সরকারের কোন প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব নিচ্ছে না, সেটাও অত্যন্ত উদ্বেগের। সম্প্রতি বাসের ধাক্কায় আহত কমিউনিটি পুলিশ সদস্য আলাউদ্দিন সুমনের মৃত্যু হয়। নগরীর একটি ফ্লাইওভারে বাসের ধাক্কায় পা থেঁতলে যাওয়ার পর আলাউদ্দিন সুমন হাসপাতালে পাঁচদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। একই ফ্লাইওভারে কয়েকদিনের মাথায় দু’টি বাসের প্রতিযোগিতায় বাসের ধাক্কায় একটি ইংরেজি দৈনিকের বিজ্ঞাপন বিভাগের কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিনের মৃত্যু হয়।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের কোনো ঘটনা আলোচিত হলেও দীর্ঘ সময় পর দু’একটির বিচার হতে দেখা গেছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্তরা আইনের আশ্রয় নেন না। প্রতিদিন আমাদের সড়ক-মহাসড়কে গড়ে ৬৪ জন মানুষ মারা যাচ্ছে। একদিকে ট্রাফিক আইনের দুর্বল ব্যবস্থা এবং আইন প্রয়োগের শিথিলতা। অন্যদিকে, পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো প্রভাবশালী হওয়ায় সাধারণ যাত্রীরা তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে সাহস করেন না। অথবা কেউ যদি মামলা করেন, তার দীর্ঘসূত্রিতার কারণেও অনেকে বিচার চাইতেও আগ্রহী হন না। সড়ক দুর্ঘটনার ৮০ শতাংশই কিন্তু আপস নিষ্পত্তি হয়ে যায়। যে ২০ শতাংশ মামলা পর্যন্ত গড়ায়, তারও ৯৯ ভাগ ক্ষেত্রে আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। যার কারণে কেউ মামলা করতে আগ্রহী হন না।
সাবেক আইনমন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, এই জাতীয় মামলার ক্ষেত্রে আইনজীবীদের অনেক বেশি আন্তরিক ও উজ্জীবিত হতে হবে। তাদের আন্তরিকতার কোন বিকল্প নেই। তাদের চেষ্টা করতে হবে যাতে করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মামলা শেষ করা বা ফয়সালা করা যায়। এবং ক্ষতিপূরণ আদায় করা। অর্থাৎ এই পুরো প্রক্রিয়াই নির্ভর করছে আইনজীবীদের সদিচ্ছার ওপর।
সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার ও সাবেক জেলা জজ ইকতেদার আহমেদ বলেন, দুর্ঘটনা মামলা পরবর্তী সময়ে সাক্ষী যদি কোর্টে না আসে তাহলে তো বিচার কার্যক্রম ব্যাহত হবেই। এই মামলার বিচার পেতে বাদীপক্ষকে তার সাক্ষীসহ অন্য প্রমাণাদি নিয়ে যথাসময়ে আদালতে উপস্থিত থাকতে হবে। এছাড়া বাদী বিবাদী অনেক সময় কোর্টের বাইরে নিজেরাই আপস-মীমাংসা করে ফেলে এটাও দুর্ঘটনা মামলার বিচার না হওয়ার একটি কারণ। মামলার ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। মামলার বিষয়বস্তু, কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং বিমা বা ইন্স্যুরেন্সের ওপর ভিত্তি করে আদালত ক্ষতিপূরণের টাকার অঙ্ক বা পরিমাণ নির্ধারণ করে। তাছাড়া ক্ষতিপূরণের অর্থ যত বেশি হবে মামলার ফিও তত বেশি হবে। ফলে অনেক ভুক্তভোগী শুরুতে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করলেও তা শেষ পর্যন্ত চালাতে পারেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অপরাধ বিজ্ঞানী তৌহিদুল হক বলেন, দেশের অন্য মামলাগুলোর সাক্ষী এবং বাদী এত বেশি তৎপর সেই তুলনায় দুর্ঘটনার মামলার বাদী বিবাদী খুব একটা তৎপর নয়। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে মামলা শুরুর কিছুদিন পরেই বাদী বিবাদী নিজেরা মিউচ্যুয়াল করে। এবং ভিক্টিম বা তার পরিবারকে কনভিন্স করে ফেলে। কাজেই মামলা হওয়ার পরপরই যদি মিউচ্যুয়াল হয়ে যায় তখন কিন্তু সেটি বেশিদূর আর যাওয়ার সুযোগ থাকে না।

No comments

Powered by Blogger.