ক্ষতবিক্ষত শ্রীমঙ্গলের পাহাড় by এম ইদ্রিস আলী

একসময় শ্রীমঙ্গলকে বলা হতো নির্জন প্রকৃৃতির আঁধার। ছিল সারি সারি সবুজ পাহাড়-টিলা। প্রকৃতির সবুজ সৌন্দর্যের দ্যুতি ছড়িয়েছে গোটা দেশে। আর এসব পাহাড়-টিলার সর্বাঙ্গ জুড়ে ছিল জীব-বৈচিত্র্যের সমাহার। কিন্ত গেল কয় বছরে রিসোর্ট ও বাণিজ্যিক স্থাপনা, ঘরবাড়ি এবং চা আর ফল বাগান সৃজনের নামে ছেঁটে ন্যাড়া করে ফেলা হয়েছে এখানকার বেশিরভাগ পাহাড়-টিলা। বর্ষায় প্রবল বৃষ্টিপাতে ক্রমশ ক্ষয়ে ছোট হয়ে আসছে অবয়ব। এতে এখানকার নানা প্রজতির উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য চরম হুমকির মুখে পড়েছে। সরকারি প্রশাসনে পাহাড়ের এই বোবা কান্না শোনার যেন কেউ নেই।
বহুতল ভবন, রিসোর্ট, লজ, গেস্ট হাউস, বাসাবাড়ি, ফল বাগান থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক নানা স্থাপনা নির্মাণে কাটা হচ্ছে সুউচ্চ টিলা-পাহাড়। পরিবেশবিদদের দাবি গত ৩০ বছরের ব্যবধানে মোট ভূমির ৩০ ভাগ পাহাড়ই কেটে ফেলা হয়েছে। কোনো ধরনের নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে অনেকে আবার পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি করছেন। নির্বিচারে পাহাড় কাটায় শ্রীমঙ্গল উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত শতাধিক পরিবার এই মুহূর্তে পাহাড় ধ্বসের আশঙ্কার মধ্যে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস করছেন। প্রায় ৭ বছর আগে শহরতলির ডলুবাড়ী এলাকায় পাঁচতারকা হোটেল গ্রান্ড সুলতান টি রিসোর্ট অ্যান্ড গল্ফ নির্মিত হওয়ার পর পর্যটন এলাকা হিসেবে শ্রীমঙ্গলের পরিচিতি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। সঙ্গে সঙ্গে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে উদ্যেক্তারা পাহাড়ের জমি কিনতে হামলে পড়েন। একের পর এক রিসোর্ট-মোটেল নির্মাণে নির্বিচারে শুরু হয় পাহাড় কাটা। সবুজ পাহাড় ঘেরা প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশে রিসোর্ট গড়ে তোলার মানসিকতার ইচ্ছেমতো কাটাছেঁড়া হচ্ছে পাহাড়-টিলা। উপজেলার মোহাজিরাবাদ এলাকায় সুউচ্চ পাহাড় কেটে নির্মিত হয় বিলাসবহুল ‘নভেম ইকো রিসোর্ট’। সেময় স্থানীয় প্রশাসন পাহাড় কাটায় পরিবেশ আইন লঙ্ঘনের অপরাধে অভিযুক্ত করা হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। অভিযোগ রয়েছে ২০১৫ সালে স্থানীয় প্রশাসন প্রতিষ্ঠানটিকে শুধু জরিমানা আদায় করে পাহাড় কাটার দায় থেকে অব্যাহতি দেন। যদিও পরিবেশ অধিদপ্তর নভেম ইকো রিসোর্টকে পরিবেশছাড়পত্র দিতে এখন পর্যন্ত অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। একই ভাবে পাহাড় ধ্বংস করে রিসোর্ট-মোটেল গেস্ট হাউস গড়ে তোলার অভিযোগ রয়েছে, হেরিটেজ গেস্ট হাউস, এসকেডি রিসোর্ট, হিমাচল গেস্ট হাউস, লেমন গার্ডেন অ্যান্ড রিসোর্ট, জঙ্গলবাড়ি কটেজ, শান্তিবাড়ি ইকো কটেজের বিরুদ্ধে। বর্তমানে এক ডজনেরও বেশি নির্মাণাধীন রিসোর্ট রয়েছে যাদের বিরুদ্ধে পাহাড় ধ্বংস বা পাহাড়ের আকার পরিবর্তনের অভিযোগ রয়েছে। রিসোর্ট তৈরি ছাড়াও পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে নানা স্থাপনা ও বাণিজ্যিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এছাড়া উপজেলার পাহাড়ি জনপথ বিষামনী, মহাজিরাবাদ, রাধারনগর, মির্জাপুর, হোসনাবাদ এলাকাগুলোতে বেশিরভাগ প্রভাবশালী লোকে বাড়ি তৈরি ও মাটি বিক্রির উদ্দ্যেশে পাহাড় কেটে উজাড় করেছে। পাহাড় কাটার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে ব্যবসায়ী আজম জে চৌধুরীর মালিকানধীন ফিনলে চা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। ২০১৫ সালের ৩ ও ৪ঠা অক্টোবর ভাড়াউড়া মৌজার বিশাল আয়তনের একটি পাহাড় ভারি যন্ত্রপাতি দিয়ে কেটে সৌন্দর্যহানিসহ গোটা এলাকার পরিবেশ নষ্ট করে।
সরজমিন রাধানগর এলাক ঘুরে দেখা যেছে, অনেক স্থান ঘেরাও দিয়ে বহুতল ভবন নির্মাণযজ্ঞ চলছে। কোনটা রিসোর্ট কোনটা লজ আবার কোনটা গেস্ট হাউজ। এখানকার এস কেডি নামে নির্মাণাধীন বহুতল রিসোর্ট নির্মাণে প্রাকৃতিক ছড়ার (ছোট খাল) গতিপথ পরিবর্তন করার অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় এক টাইলস মিস্ত্রি আলী আকবর বলেন, ‘শ্রীমঙ্গলের মোট জমির ৮০ ভাগই তো পাহাড়। এখানে গড়ে উঠা সব রিসোর্টের ৯৯ ভাগই তৈরি হচ্ছে পাহাড় কেটে’। উপজেলার আশিদ্রোন ইউনিয়নের পশ্চিম মোহাজিরাবাদ এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয়রা পাহাড়ি খাস জমি লিজ বন্দোবস্ত নিয়ে লেবু-আসারসের বাগান সৃজনে জমি তৈরিতে পাহাড় ছেঁটে ফেলছে। এখানে উঁচু একটি পাহাড় নির্দয়ভাবে কেটে স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। মোহাজিরাবাদ এলাকায় বেশ কয়েকটি পরিবার পাহাড়ের নিচে ঘরবাড়ি তৈরি করেছেন। সুউচ্চ কাটা পাহাড়ের গাঁ ঘেঁষে বাড়িঘর তৈরি করে ১০-১২টি পরিবার বিপজ্জনক অবস্থায় বসবাস করছেন। এসব পরিবারের এক সদস্য ফারুক মিয়া বলেন, ‘বৃষ্টিপাতে পাহাড় ধ্বসে আশঙ্কায় আমরা পরিবার নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় আছি’। বয়োজ্যেষ্ঠ ছানু মিয়া বললেন, ‘গত বছর বর্ষা মওসুমে ইউএনও অফিস থেকে মাইকিং করে ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু বাড়িঘর ছেড়ে পরিবার নিয়ে কোথায় দাঁড়াবো?’। এমনিভাবে উপজেলার বিষামণি, রাধানগর, দিলবরনগর, ডলুছড়া এলাকায় এরকম প্রায় শতাধিক পরিবার পাহাড় ধ্বসের আশঙ্কার মধ্যে বসবাস করছেন।
স্থানীয় পাহাড় রক্ষা ও উন্নয়ন সোসাইটির সিলেট বিভাগীয় চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘পাহাড়ের বোবা কান্না কে শোনে? চোখের সামনেই তো পাহাড় কেটে আমাদের সবুজ প্রকৃতি ধ্বংস করা হচ্ছে। আমরা প্রতিবাদ করছি। অফিসে-দপ্তরে চিঠি দিচ্ছি, কিন্তু পাহাড় রক্ষায় কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবশে অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় সহকারী পরিচালক আলতাফ হোসেন বলেন, ‘এখানে জনসচেতনার অভাব রয়েছে। পাহাড় কাটার ঘটনায় আমরা সব সময় সক্রিয় আছি। নিয়মিত মোবাইল কোর্ট ও আদালতে মামলা, ঢাকাস্থ এনফোর্সমেন্ট শাখার মাধ্যমে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, অধিদপ্তরের জনবলের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, চাইলে সবসময় সব কিছু করা যায় না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও নাগরিক সমাজ সচেতন হলে পাহাড় কেটে পরিবেশ ধ্বংস করা অনেকাংশে রোধ করা সম্ভবপর হবে’। জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সিলেট বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহিম বলেন, নগরায়নের ফলে গত ৩ দশকের ব্যবধানে এ অঞ্চলের ৩০ ভাগ এবং বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে ৫০ ভাগ পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। বাগান সৃজনে পাহাড়ী জমির রূপ পরিবর্তন করা হয়েছে। এছাড়া লাউয়াছড়াসহ আশপাশের পাহাড়ের গাছপালা ও মাটি কেটে উজার হচ্ছে। এর সঙ্গে বৃষ্টিপাত প্রবণ শ্রীমঙ্গলে প্রবল বৃষ্টিতেও মারাত্মক ভূমি ক্ষয় হচ্ছে। এতে করে ছড়া বেয়ে নেমে যাওয়া পাহাড়ি ঢলে হাওর-বিল ভরাট হচ্ছে।
প্রাকৃতিক প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। তিনি বলেন, পাহাড় কাটার ফলে পরিবেশ আজ বিপর্যস্ত। সরকার পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রেখেছে। কিন্তু সেই আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ না হওয়ায় পাহাড় খেকোরা ইচ্ছেমতো পাহাড় কেটে সাবাড় করছে।

No comments

Powered by Blogger.