বিচার পেতে ধর্ষিতাদের যন্ত্রণাদায়ক লড়াই by মরিয়ম চম্পা

এ এক দীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক লড়াই। বিচার চাওয়াও যেন ধর্ষিতাদের অপরাধ। পদে পদে ভোগান্তি আর হয়রানি। কখনো সইতে হয় উল্টো অপবাদ। যথাযথ মেডিক্যাল পরীক্ষা না হওয়ায় ন্যায় বিচারও নিশ্চিত করা যায় না বহুক্ষেত্রে। আদালতের পরিবেশও থাকে না নারীর প্রতি সহায়ক। ধর্ষণের শিকার হওয়াদের জীবনটাই যেন  এক নরকযন্ত্রণা।
মানবাধিকার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে ধর্ষণের ঘটনা যতটা শুনি বা প্রচার হয় শাস্তির ঘটনা ততটা শুনি না। একজন ধর্ষিতা নারীকে থানা পুলিশ থেকে শুরু করে কোর্ট প্রতিটা স্তওে হেনস্থার শিকার হতে হয়। তাকে খারাপ মেয়ে হিসেবে দেখা হয়। থানায় মামলা করতে বা আসামি পক্ষের আইনজীবী যেভাবে প্রশ্ন করে তখন কিন্তু তার মনোজগত ভেঙে যায়। তাকে বারবার একই হয়রানির শিকার হতে হয়। যেন ধর্ষিতা হওয়াই তার অপরাধ। ফলে ভুক্তভোগী নারীরা মামলা করতে চায় না। সম্প্রতি বাংলাদেশে টু ফিঙ্গার টেস্ট পদ্ধতিটা বাতিল করা হয়েছে যেটা নিঃসন্দেহে ভালো সিদ্ধান্ত। এ ছাড়া হাইকোর্টে একটি নতুন রুল জারি হয়েছে যেটা বাস্তবায়ন হলে কোর্টে আসামির উকিল নির্যাতিতাকে আজে বাজে প্রশ্ন করে হয়রানি করতে পারবে না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের কো-অর্ডিনেটর ডাক্তার বিলকিস বেগম বলেন, শারীরিক পরীক্ষা যথাসময়ে না হলে ধর্ষণ প্রমাণ ও বিচার পাওয়া কঠিন। আইনি লড়াইয়ের জন্য এই সার্টিফিকেটটা খুবই দরকার। এই সার্টিফিকেট না হলে কোনো বিচারই হবে না। নিপীড়নের শিকার নারীরা বেশিরভাগ সময়ই আসতে দেরি করে ফেলে। ফলে আমরা ঠিকমতো ফাইন্ডিংস পাই না। এ ছাড়া স্থানীয়ভাবে এসব ঘটনা ওরা ম্যানেজ করার চেষ্টা করে, গুরুত্বপূর্ণ সময়টা কিল করে ফেলে।
একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের কাছে এক নারী বর্ণনা করেছেন ধর্ষণের বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে তাকে কী কী ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। মাদরাসার একজন শিক্ষকের দ্বারা ধর্ষিত হয়ে তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিলেন। ওই নারী বলেন, তিনি আমার টিচার ছিল। ঘটনার পরপরই আমরা পুলিশের কাছে যাই নাই। অনেক পরে জানাজানি হইছে। আমার ফ্যামিলিও জানতো না। আমারে ভয় দেখানো হইছিল। আর আমি তখন কিছুই বুঝতাম না। জানার পরে আমার আব্বু কোর্টে মামলা করে। মেডিক্যাল রিপোর্টে আসছিল আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছিলাম। এই ঘটনা জানাজানির পরই নিরাপত্তার জন্য আমি মহিলা আইনজীবী সমিতির শেল্টারে ছিলাম। এ ভিকটিম তার নিজস্ব অভিজ্ঞতায় জানায়, সমাজে ধর্ষণের শিকার নারীকেই দোষী করার একটা প্রবণতা আছে। আমার এলাকার মানুষও সবসময় আমার বিরুদ্ধে ছিল। তারা চাইছিল আমাদের এলাকা থেকে বের করে দিতে। ধর্ষণের শিকার নারীকে বার বার ঘটনার বিবরণ দেয়া এবং নানান প্রশ্নের মুখে বিব্রত হতে হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি কোর্টে দুই বার গেছি। আমি মিথ্যা বলছি এমন প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে। কোর্টের মাঝখানে এত মানুষের সামনে কথা বলতে আমার খুব আনইজি লাগছিল। এতগুলা মানুষের সামনে এত পারসোনাল বিষয়ে এতকথা বলা! তারপর এক একজন এক এক কথা বলে একেকটা মন্তব্য করে। যেমন এটা মিথ্যা হইতে পারে বা আমি খারাপ। চার বছর মামলা চলার পর ধর্ষকের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে।’
গত বছর যে ঘটনাটি খুব বেশি সমালোচিত হয়েছে, সেটি ঢাকায় দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে হোটেলে জন্মদিনের পার্টিতে ডেকে এনে ধর্ষণের ঘটনাটি। সন্দেহভাজন ধর্ষকরা বিত্তবান পরিবারের সন্তান। অভিযোগ রয়েছে, প্রায় দেড় মাস পর ওই ছাত্রীরা ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে থানায় গেলে, পুলিশ প্রথমে অভিযোগ নিতেই চাইনি। ময়মনসিংহের গৌরীপুর থানার ব্যারাকে নিজ কক্ষে শরীরে আগুন দেন কনস্টেবল হালিমা। ওইদিনই সন্ধ্যায় হাসপাতালে নেয়ার পথে মৃত্যু হয় তার। আত্মহত্যা করার আগে হালিমা তার ব্যক্তিগত ডায়েরিতে লিখে রাখেন যে তার আত্মহত্যার একমাত্র কারণ তারই একজন সহকর্মী পুলিশ অফিসার। যিনি হালিমাকে ধর্ষণ করেন মার্চ মাসের ১৭ তারিখে রাত ২টায়। হালিমা আরো লেখেন, তার অভিযোগ গ্রহণ করেনি অফিসার ইন-চার্জ (ওসি) । হালিমার বাবা অভিযোগ করেন, একে তো হালিমা নিজ ব্যারাকে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তারপর সহকর্মীরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছে। এভাবেই কনস্টেবল হালিমা, হযরত আলী এবং আয়েশারা বিচার না পেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
ধর্ষণের শিকার মেয়েদের সারা দেশে ৮টি ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের মাধ্যমে কাউন্সেলিং, পুলিশি ও আইনি সহায়তা দেয়া হয়। ২০০১ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে প্রতিষ্ঠিত এসব কেন্দ্র থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চার হাজার ৩৪১টি যৌন নির্যাতনের মামলা হয়েছে। যার মধ্যে ৫৭৮টি বিচার হয়েছে এবং সাজা হয়েছে মাত্র ৬৪টির।
ধর্ষিতা নারীদের বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে নানা বাধা। সম্প্রতি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে হাইকোর্টের বিচারক বিচারপতি জিনাত আরা বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। ‘যৌন সন্ত্রাসবিরোধী গণকনভেশনের’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জিনাত আরা বলেন, ‘ভিকটিমদের মধ্যে দেখা যায়, ধর্ষণের পরপর তারা মনে করে অপবিত্র হয়ে গেছে। যে কারণে সঙ্গে সঙ্গে বার বার গোসল করতে থাকে তারা। এর জন্য অনেক ক্ষেত্রে ডিএনএ টেস্টের সঠিক ফলাফল পাওয়া যায় না। ‘আমাদের এখানে ডিএনএ টেস্ট সব জায়গায়তে সঠিকভাবে করাও হয় না। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারি পরীক্ষাও করা হয় না। গেলেও অনেক সময় দেখা যায় ইনফ্লুয়েন্সিয়াল ব্যক্তিদের চাপে সঠিক রিপোর্ট অনেক ক্ষেত্রে আসে না। ধর্ষণের মামলা আদালতে যাওয়ার আগে আরো বেশ কিছু বাধা ও সমস্যার চিত্র তুলে ধরেন এই বিচারপতি।
তিনি বলেন, ‘দেখা যায় প্রথমে গ্রামের লোকজন বাধা দেয় যাতে মামলা করা না হয়। আর যদি ইনফ্লুয়েন্সিয়াল হয় তাহলে মামলা দায়েরের পূর্বে অথবা পরে টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে ফেলে। তারপরও যেটা হয় নিপীড়িতার পক্ষে কোর্টে এসে সাক্ষ্য দেন না। তখন সাক্ষী না থাকায় বিচারকরা অনুমানের ওপর শাস্তি দিতে পারেন না। বিচারকালে আমাদের এসব প্রচুর সমস্যা ফেস করতে হয় বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী ও মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, পরিস্থিতির বদল করতে চাইলে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার কার্যক্রম শেষ করতে হবে। ১৫ দিনের মধ্যে মামলার চার্জশিট দিতে হবে। এ ছাড়া ভিক্টিমের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে আইনের সঠিক চর্চা করতে হবে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, সমাজ থেকে ধর্ষণ কমাতে হলে মানসিক পরিবর্তন দরকার। কারণ একজন নারী ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর আমাদের সমাজ ওই নারী কি ধরনের কাপড় পরে, কি খায়, কার সঙ্গে চলে, তার জীবন যাপন কেমন ১৪ পুরুষ তুলে ধরে যেটা অন্য মামলার ক্ষেত্রে দেখা যায় না। একজন খুনির কথাই ধরা যাক, খুন করার পর তার জীবন বৃত্তান্ত একজন ধর্ষিতার জীবন বৃত্তান্তের মতো তুলে ধরা হয় না। তাই ধর্ষণ বন্ধে শুধুমাত্র সামাজিকভাবে বা বিভিন্ন সংগঠন পর্যায়ে নয় রাষ্ট্রিয়ভাবে এর জোরালো প্রতিবাদ দরকার।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট ব্লাস্টে কর্মরত আইনজীবী শারমিন আক্তার বলেন, সামাজিকভাবে ধর্ষণ কমাতে হলে মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। ধর্ষণের জন্য আমরা অধিকাংশ সময়ই ধর্ষিতার পোশাককে দোষ দিয়ে থাকি। বলা হয় সে ওয়েস্টার্ন পোশাক পড়েছে তাই ধর্ষিত হয়েছে। অথচ একজন বোরকা পড়া মেয়েও কিন্তু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কাজেই পোশাকের দোষ নয় মানসিক পরিবর্তনটা এক্ষেত্রে বেশি জরুরি। একজন ধর্ষিতা আদালত পর্যন্ত অনেকগুলো ধাপের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে একসময় ধৈর্য হারিয়ে ফেলে এবং প্রত্যেক পর্যায়ে হয়রানি ও হাসির পাত্র হয়। এক্ষেত্রে বিচার সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত পুলিশ, ডাক্তার, উকিল, বিচারক সবাইকে বন্ধুত্বপূর্ণ হতে হবে। যাতে করে ধর্ষিতা সাহস নিয়ে বিচার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে পারে।
এ ব্যাপাওে সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেন, ধর্ষণ কথাটি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। যদিও আমাদের দেশে ধর্ষণ মামলায় পুলিশ কেইস, তদন্ত এবং মেডিকেল পরীক্ষা পদ্ধতি অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ একজন নারীর ধর্ষণের বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর হওয়ায় মামলা, ডাক্তারি পরীক্ষা, আদালত সবক্ষেত্রেই তাদের প্রতি আমাদের মানবিক হতে হবে। এক্ষেত্রে ডাক্তারের মেডিকেল সার্টিফিকেটর ওপর নিপীড়িতার মামলার ভালো মন্দ নির্ভর করে। একই সঙ্গে আইনের প্রয়োগের চেয়ে, আইন মেনে চলার বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
২০১৬ সাল এবং ২০১৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় চার হাজার ৮শ’র বেশি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। ২০১৬ সালে সারা দেশে ৩ হাজার ৬৪৮ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। ২০১২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৭০০, ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৮৯১, ২০১৪ সালে ৩ হাজার ৬৪৭ ও ২০১৫ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৬২২। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঘটনার তুলনায় মামলা কম হয় আর মামলা হলেও নিষ্পত্তি হয় অনেক কম।

No comments

Powered by Blogger.