ইয়াবায় সয়লাব উদ্ধারে রেকর্ড by মহিউদ্দিন অদুল

হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবা। দেশের ৭০ লাখ মাদকাসক্তের ৩০ লাখই ইয়াবা আসক্ত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ধারণা, ইয়াবা মহামারি আকার ধারণ করেছে। সংস্থাটিসহ দেশের সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ছড়িয়ে পড়া ইয়াবার ১০ ভাগও উদ্ধার করতে পারছে না। এরই মধ্যে চলতি বছরের প্রথম দু’মাসে উদ্ধার হয়েছে আড়াই কোটির বেশি ইয়াবা ট্যাবলেট। যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশনস ও গোয়েন্দা) সৈয়দ তোফিক উদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, মাদকাসক্তদের মধ্যে একদিকে ইয়াবার চাহিদা বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে চোরাইপথে তা আসছে। অবৈধ উৎপাদনও হচ্ছে। অন্য দিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও পুলিশসহ সবগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতাও বেড়েছে। ফলে ইয়াবা উদ্ধারে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ২ কোটি ৬৬ লাখ ইয়াবা উদ্ধার হয়। এভাবে চলতে থাকলে এ বছরের শেষ নাগাদ গত বছরে দ্বিগুণ ইয়াবা উদ্ধার হতে পারে বলেও আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
মাদকদব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, মেথামফিটামিন ও ক্যাফেইনের মিশ্রণে তৈরি উত্তেজক ট্যাবলেট ইয়াবা দেশে প্রথম উদ্ধার হয় ১৯৯৭ সালে। ২০০০ সাল থেকে মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে এদেশে ইয়াবা আসতে শুরু করে। তারপর থেকে ক্রমেই এর প্রসার বাড়তে থাকে। ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে সারা দেশে। এখন প্রত্যন্ত গ্রাম-গঞ্জ থেকে শুরু করে রাজধানী শহর ঢাকায় ইয়াবার ছড়াছড়ি। বর্তমানে তিন ধরনের ইয়াবা বাজারে বিক্রি হচ্ছে। মিয়ানমারে যে ইয়াবা বাংলাদেশি ৩০ থেকে ৫০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে সীমান্ত পার হলেই সেই ইয়াবা ৮০ থেকে ১০০ টাকা। কক্সবাজার জেলা শহর বা আশপাশে পৌঁছলেই দাম দেড়শ’ থেকে আড়াইশ’ টাকা। এভাবে রাজধানী ঢাকায় আসলে ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে দেড়শ’ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত। অল্পতেই অতি লাভের জন্য ইয়াবা পাচারে মরিয়া চক্রটি। ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে ছিঁচকে চোর থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি পর্যন্ত। ইয়াবাসহ ধরা পড়ছে এমপিপুত্র, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাসহ সমাজের প্রভাবশালীরা। মাদক রাজ্যের রাঘব বোয়ালরা ইয়াবায় মত্ত। এমন কি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত কতিপয় সদস্যও ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। পুলিশ ও কারাপুলিশসহ বিভিন্ন আইনশঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও ধরা পড়ছে ইয়াবাসহ। অসাধু পুলিশ সদস্যদের একটা অংশ ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। অভিনব কায়দায় স্থল, জল ও আকাশপথে দেশে ঢুকছে ইয়াবা। আবার ইয়াবার ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বাংলাদেশ। দেশেও তৈরি হচ্ছে ইয়াবা। সমুদ্রপথে বড় বড় ইয়াবার চালান দেশে ঢুকছে। এজন্য ব্যবহার হচ্ছে মাছের ট্রলার ও পণ্যবাহী নৌকা।
আর ইয়াবা পাচার ও পরিবহন হচ্ছে অভিনব কায়দায়। পায়ুপথে, শরীরের চামড়া কেটে তাতে ঢুকিয়ে, ক্ষতস্থানের ব্যান্ডেজে লুকিয়ে, নারীর গোপনাঙ্গে, গৃহপালিত পশু-পাখির পেটে, মাছের পেটে, ক্রিকেট ব্যাটে, ফুটবলে, আম, কাঁঠাল, কুমড়া, তরমুজ ইত্যাদিতে ঢুকিয়ে ও যানবাবহনে লুকিয়ে নানা কায়দায় বহন করা হচ্ছে ইয়াবা। ইয়াবা ট্যাবলেট ছোট দানার সাইজের এবং ওজনে কম হওয়ায় তাতে পার পেয়ে যাচ্ছে অধিকাংশ পাচারকারী।
এভাবে পরিবহন করে ইয়াবা পৌঁছে যাচ্ছে স্কুল-কলেজে পড়ুয়া কিশোর-কিশোরী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, বিভিন্ন পেশাজীবী তরুণ-তরুণীর হাতে হাতে। তারা ইয়াবায় বুঁদ হয়ে কিছুক্ষণের জন্য মনোদৈহিক শক্তিবর্ধক চাঞ্চল্যে কল্পনার রাজ্যে উড়াল দিচ্ছে। নেশা কেটে গেলেই আবার নেশার জন্য অস্থির হয়ে পড়ছে। অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দা, ঝিমুনি, অস্থিরতা ইত্যাদি নানা উপসর্গে ভুগছে। নানা রোগ-শোকে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আবার নেশার জন্য ইয়াবার টাকা জোগাড়ে জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধে। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, রাহাজানি ইত্যাদিতে জড়াচ্ছে সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণীরা। শুধু তাই নয়। ইয়াবার টাকার জন্য খুন করছে মানুষ। ২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট ঐশী রহমান ইয়াবায় আসক্ত হয়ে তার পিতা পুলিশ পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও মা স্বপ্না রহমানকে খুন করে। ইয়াবায় আসক্তদের এমন খুন ও অপরাধের তালিকা কেবলই দীর্ঘতর হচ্ছে।
দেশে প্রচলনের প্রায় দেড় যুগের ব্যবধানে ইয়াবা এখন অপ্রতিরোধ্য মহামারিতে পরিণত হয়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গত প্রায় এক দশক ধরে অন্যান্য মাদকের সঙ্গে ইয়াবা উদ্ধারেও গতি এসেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পাশাপাশি, পুলিশ, র‌্যাব, কোস্ট গার্ড, নৌ-পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীগুলো সারা দেশের কোথাও না কোথাও প্রতিদিনই উদ্ধার করছে ইয়াবা। ২০১১ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত প্রতি বছরই ইয়াবা উদ্ধারের পরিমাণ বেড়ে চলছে। ওই বছর সারা দেশে ইয়াবা উদ্ধার হয়েছিল ১১ লাখ ৫৩ হাজার ১৫৮টি। এর মধ্যে ৭৫ হাজার ৮৫৭টি মাদকদব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও বাকি ১০ লাখ ৭৭ হাজার ৩০১টি ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করে অন্য সব সংস্থা। পরের বছর উদ্ধার হয় ২২ লাখ ৫৮ হাজার ৭১৫টি ইয়াবা ট্যাবলেট। ২০১৩ সালে ২৯ লাখ ৭৪ হাজার ৬২৪টি ইয়াবা ট্যাবলেটের সঙ্গে উদ্ধার হয় ৫ কেজি এমফিটামিন পাউডার। পরের বছর ২০১৪ সালে উদ্ধার হওয়া ইয়াবার সংখ্যা দাঁড়ায় ৭১ লাখ ৮৯ হাজার ১২টিতে। ২০১৫ সালে উদ্ধার তিনগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ২ কোটি ৩৫ লাখ ৫৭ হাজার ৪৬১টিতে। এর পরের বছর ২০১৬ সালে তা তিন কোটি ছাড়ায়। সর্বশেষ গত বছর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে উদ্ধার হয়েছে ৪ কোটি ১২ লাখ ৩৮ হাজার ২১৩টি ইয়াবা ট্যাবলেট। এর মধ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ১১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৭০ ও অন্য সংস্থাগুলো ৪ কোটি ৭৯ হাজার ৪৪৩টি ইয়াবা উদ্ধার করে। কিন্তু এখানেও তা থামছে না। চলতি বছর আরো ভয়াবহ পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে। ছোট, মাঝারি ও বড় চালানে গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে দু’মাসেই উদ্ধার হয়েছে ২ কোটি ৬০ লাখের বেশি ইয়াবা ট্যাবলেট। এর মধ্যে ওই দু’মাসে সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উদ্ধার করেছে ২ কোটি ৬০ লাখ ১৯ হাজার ৪০৭টি ইয়াবা ট্যাবলেট। অবশ্য মার্চ পর্যন্ত শুধু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর উদ্ধার করে ৬ লাখ ২২ হাজার ৪৩৬টি ইয়াবা ট্যাবলেট। সব মিলিয়ে (মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তিন মাসসহ) উদ্ধার করা হয়েছে ২ কোটি ৬৬ লাখ ৪১ হাজার ৮৪৩টি ইয়াবা ট্যাবলেট, যা ইয়াবা উদ্ধারে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চিফ কেমিক্যাল এক্সামিনার ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা মানবজমিনকে বলেন, ইয়াবা বিস্তার মহামারি আকার ধারণ করেছে। গত বছর লক্ষাধিক মামলার মধ্যে ইয়াবার মামলাই ছিল ৩৫ হাজার মতো। দেশে ৭০ লাখ মাদকাসক্তের মধ্যে অন্তত ৩০ লাখ এখন ইয়াবা আসক্ত। প্রথম দু’মাসে আড়াই কোটি উদ্ধার হলে তো অন্তত ১০ কোটি চালান বাজারে আসক্তদের হাতে পৌঁছে গেছে। এ থেকে যুব সমাজকে বাঁচাতে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি আইন কঠোর করার উপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.