ইরান চুক্তি থেকে ট্রাম্পের বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণায় বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া

বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে যেভাবে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানীর স্বীকৃতি দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প, ঠিক একইভাবে ইউরোপের আহ্বানকে উপেক্ষা করে তিনি ইরানের সঙ্গে করা আন্তর্জাতিক পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিলেন। এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ফ্রান্স, জার্মানি ও বৃটেন হুঁশিয়ারি দিয়েছিল। কিন্তু তার তোয়াক্কা করেন নি তিনি। হোয়াইট হাউস থেকে মঙ্গলবার দেয়া এক ভাষণে তিনি আরো হুঁশিয়ারি দেন। বলেন, একপক্ষীয় ওই চুক্তিকে খর্ব করতে ইরানের ওপর নতুন করে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করবে যুক্তরাষ্ট্র। ওই চুক্তি কখনোই করা উচিত হয়নি। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। এতে বলা হয়, ট্রাম্পের এমন সিদ্ধান্তে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টির ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ববাজারে তেলের সরবরাহ অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। এ নিয়ে হতাশ যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলো। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ক্ষমতার মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বের অন্য পাঁচটি শক্তিধর দেশ ও ইরানের মধ্যে একটি চুক্তি হয় ২০১৫ সালে। এতে বলা হয়, ইরানকে তার পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করতে হবে। বিনিময়ে তার ওপর আরোপিত অবরোধ শিথিল করা হবে। এই চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল ইরানকে পারমাণবিক বোমা তৈরির সক্ষমতা থেকে দূরে রাখা বা তারা যাতে পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে না পারে তা প্রতিরোধ করা। কিন্তু পূর্বসূরি বারাক ওবামার করা ওই চুক্তির কড়া সমালোচনা করেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, বারাক ওবামার ওই চুক্তি ইরানের ব্যাপক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির কিছুই করতে পারেনি। এ ছাড়া ইয়েমেন ও সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে ইরানের সংঘাতময় ভূমিকা আছে। ট্রাম্প ১৬ মাস আগে যখন ক্ষমতায় আসেন তখনই এই চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন। সেই থেকে আটলান্টিকপাড়ের মিত্রদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়তে থাকে। একের পর এক ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা ওয়াশিংটন দৌড়াতে থাকেন। তারা ট্রাম্পকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। তারা তাকে এই চুক্তিটি অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান। কিন্তু গত সপ্তাহে কিছু কূটনীতিকের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ট্রাম্প তার অবস্থান থেকে সরবেন না। তিনি এ চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নেয়ার আগে মঙ্গলবার শান্তিপূর্ণভাবে মন্তব্য করেছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। তিনি বলেছেন, ওয়াশিংটন যদি চুক্তি থেকে বেরিয়েও যায় তবু চুক্তিতে অটল থাকবে ইরান।
ইরানের প্রতিক্রিয়া: পারমাণবিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে অগ্রহণযোগ্য আখ্যা দিয়েছে ইরান। দেশটির প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেন, এই চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র দাপ্তরিকভাবে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তির প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছে। এই পদক্ষেপ নিয়ে দেশটি বড় ভুল করেছে। মঙ্গলবার প্রেসিডেন্ট ডনাল্ট ট্রাম্পের ঘোষণার কিছুক্ষণ পরই রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেয়া ভাষণে এসব কথা বলেন রুহানি। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রকে পাশ কাটিয়ে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী অন্য দেশগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করে চুক্তি অব্যাহত রাখবে ইরান। অন্য সদস্যদের সহায়তায় আমরা যদি চুক্তির মূল লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হই, তাহলে চুক্তি বহাল থাকবে।’ ইতিমধ্যেই পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে চীন ও রাশিয়াসহ অন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করার নির্দেশ দিয়েছেন রুহানি। অন্যদিকে, চুক্তি বাতিল হলে আবারো পারমাণবিক কর্মসূচি পরিচালনা করার হুমকি দেন রুহানি। তিনি বলেন, আমি ইরানের আণবিক শক্তি সংগঠনকে নিদের্শনা দিয়েছি। যেন তারা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে পারে। আর এবারের পারমাণবিক কর্মসূচিতে কোনো মাত্রা না রাখার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। রুহানি বলেন, আমরা এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার জন্য কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করবো। তার আগে আমাদের বন্ধু, মিত্র ও চুক্তির অন্য অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনা করবো।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থান মানেই চুক্তি বাতিল নয়: যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও চুক্তি অব্যাহত রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী ইউরোপীয় দেশগুলো। ফ্রান্স বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়া মানেই ইরানের পারমাণবিক চুক্তি বাতিল নয়। সম্ভব হলে যুক্তরাষ্ট্রকে বাইরে রেখেই এই চুক্তি বহাল রাখা হবে। মঙ্গলবার দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিন ইয়াভেস দ্রিয়ান এ কথা বলেন। ফ্রেন্স রেডিওতে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, শুধু যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এ চুক্তি এখনো বাতিল হয়নি। তা বহাল আছে। আগামী সোমবার ইরানের সঙ্গে বৈঠকে বসবে বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানি। তখন চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হবে। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এতে স্বাক্ষরকারী অন্য দেশগুলো এই চুক্তি অব্যাহত রাখার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে হতাশা প্রকাশ করেছে রাশিয়া ও চীন। অন্যদিকে, ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে ইসরাইল ও সৌদি আরব। 
তেলের দাম বৃদ্ধি: পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে তেলের দরে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। ডনাল্ড ট্রাম্প চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়ার পর থেকেই বাড়তে থাকে তেলের দর। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিব্যারেল তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়ে ৭৭ ডলারে পৌঁছেছে। মঙ্গলবার প্রতি ব্যারেল ক্রুড তেলের দাম দাড়ায় ৭৭.২০ ডলার। সে অনুযায়ী, একদিনে ক্রুড তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৩.১ শতাংশ। উল্লেখ্য, ইরান প্রতিদিন বিশ্বে মোট তেলের চাহিদার ৩ শতাংশ যোগান দেয়। দেশটি প্রতিদিন ২৫ লাখ ব্যারেলেরও বেশি তেল রপ্তানি করে।

No comments

Powered by Blogger.