এ্যানির স্বপ্নেও হানা দেয় সেই দুঃসহ স্মৃতি by মরিয়ম চম্পা

স্বামী ও সন্তানকে হারিয়ে প্রতিদিনই দুঃস্বপ্নে ঘুম ভাঙে আলমুন নাহার এ্যানির। ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলার ভেঙে পড়া বিমানের ঝাঁকুনিটা এখনো যেন গায়ে লাগে তার। বার্ন ইউনিটের ৬ষ্ঠ তলার ৫ নং ভিআইপি কেবিনে চিকিৎসাধীন এ্যানি এমনটাই জানালেন। ওই দুর্ঘটনায় স্বামী ফারুক হোসেন প্রিয়ক ও শিশু কন্যা প্রিয়ংময়ীকে হারান এ্যানি। এদিকে বিমান দুর্ঘটনার দুর্বিষহ মুহূর্ত ভুলে থাকতে চান ত্রিভুবন ট্র্যাজেডির বেঁচে ফেরা আহত শাহরিন আহমেদ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ কর্মের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এ্যানি বলেন, ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর প্রিয়কের সঙ্গে বিয়ের দেড় বছরের মাথায় আমাদের ছোট্ট পরী প্রিয়ংময়ীর জন্ম। মাত্র আড়াই বছর বয়সেই মেয়েটা আমাকে ছেড়ে চলে গেল। ত্রিভুবনে বিমান দুর্ঘটনার সূত্রপাতটা কীভাবে ছিল জানতে চাইলে এ্যানি বলেন, মাত্র আধা থেকে ১ মিনিটের মধ্যে কি যে হয়ে গেল ভাবতে পারছি না। ধোঁয়া আর আগুনের বাইরে তেমন কিছুই মনে করতে পারছি না। প্রিয়ংময়ী ওর বাবার কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। প্রিয়ক আর আমি গল্প করছিলাম। হঠাৎ করে বিমানে একটি ঝাঁকুনি দিয়ে আগুন ধরে যায়। আমার সিট বিমানের পাখা বরাবর হওয়ায় ওই পাশটা সবার আগে ভেঙে যায়। এসময় ধোঁয়ায় আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। আমার সিটবেল্ট খোলা থাকায় আমি দাঁড়িয়ে প্রিয়কের সিট বেল্ট খোলার চেষ্টা করি। এসময় প্রিয়ক অজ্ঞান হয়ে যায়। আমার গলায় থাকা ওড়নাতে প্যাঁচ লেগে যায়। এসময় হঠাৎ করে কে যেন আমার হাত ধরে টান দিয়ে বাইরে নিয়ে আসে। বাইরে বেরিয়ে আমি চিৎকার করে বলতে থাকি বিমানে আমার স্বামী ও মেয়ে আছে, আপনারা ওদের বাঁচান। এসময় নেপালের সেনাবাহিনীর ৪ জন  সদস্য এসে আমার কোনো কথা না শুনেই ওরা আমার হাত-পা ধরে একটি অ্যাম্বুলেন্সে তোলে। মাথায় ব্যথা ও হাঁটুতে ছোট একটি ক্ষতচিহ্ন থাকলেও শরীরের অন্য কোথাও তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি এ্যানির।
বিমান দুর্ঘটনার ভয়াবহ স্মৃতিচারণ করে এ্যানি বলেন, আমার চোখের সামনেই পাইলট পৃথূলাকে সিটে বসে থাকা অবস্থায় আহত হতে দেখেছি। একজন নেপালী যাত্রী বিমান থেকে বের হওয়ার পর চোখের সামনে মরে যেতে দেখেছি। এ্যানি স্বামী-সন্তান হারানোর শোক ভুলে মানুষের সেবা করে যেতে চান। মানুষের সেবায়ই তিনি প্রিয়ক প্রিয়ংময়ীকে খুঁজে পেতে চান। পাশে থাকা এ্যানির মা জানান, তার দুই মেয়ে। আমাদের কোনো পুত্র সন্তান না থাকলেও প্রিয়ককে পেয়ে ছেলের অভাব ভুলে গিয়েছিলাম। পুরো পরিবারকেই মাতিয়ে রাখতেন আমাদের ছোট্ট প্রিয়ংময়ী। প্রিয়ক ও প্রিয়ংময়ী যেখানেই থাকুক না কেন ওরা ভালো আছে এটাই এ্যানিকে বার বার বোঝাতে চেষ্টা করছেন তার মা। এ্যানির বাবা সালাহউদ্দিন জানান, ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পরপরই ভালো ছেলে পাওয়াতে এ্যানিকে বিয়ে দিয়ে দেই। এত কম বয়সে সে এমন অবস্থায় পড়বে ভাবতেও পারিনি।
২ নং কেবিনে শাহরিনের চিকিৎসা চলছে। শরীরের ক্ষত না শুকানোয় তার সঙ্গে কেউ সাক্ষাৎ করতে পারছেন না। সেখানে থাকা তার ফুফু জানান, শাহরিনের ট্রমা এখন অনেকটাই কমে এসেছে। খাওয়া-দাওয়া ও অন্যান্য শারীরিক অবস্থা অনেক ভালো।
ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, আহত শাহরিন আহমেদ ও এ্যানির বর্তমান শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভালো। তবে মেয়ে আর স্বামীকে কিছুতেই ভুলতে পারছেন না এ্যানি। পূর্ণাঙ্গ সুস্থ হতে তাদের আরো সময় লাগবে।
গত ১২ই মার্চ নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস-বাংলার বিমান ৬৭ যাত্রী ও চারজন ক্রু নিয়ে বিধ্বস্ত হয়। এ দুর্ঘটনায় ২৬ বাংলাদেশিসহ ৫১ জন নিহত হয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.