রহস্যে ঘেরা সিলেটের জোড়া খুন: তানিয়া ধরা পড়েনি পালিয়েছে সুমনও by ওয়েছ খছরু

সিলেটের মিরাবাজারে আলোচিত মা ও ছেলে খুনের ঘটনার কোনো রহস্য উদঘাটন হয়নি। অজ্ঞাত খুনিদের সন্ধানে মাঠে নেমেছে পুলিশের   কয়েকটি টিম। এরপরও গতকাল বিকাল পর্যন্ত জোড়া খুনের ঘটনার প্রধান সন্দেহভাজন কাজের মেয়ে তানিয়ার খোঁজ মিলেনি। ওদিকে- এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে কাঞ্চা সুমন ও তার সহযোগীরা। লাশ উদ্ধারের দিন রোববার গভীর রাতে সিলেটের কোতোয়ালি থানায় অজ্ঞাত ৪-৫ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন নিহত রোকেয়া বেগমের ছোটো ভাই জাকির হোসেন। গতকাল দুপুরে নিহত রোকেয়া বেগম ও তার ছেলে রবিউল ইসলাম রূপমের লাশের ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে- আলোচিত এ জোড়াখুনের ঘটনার একমাত্র সাক্ষী শিশু রাইসা। চিকিৎসা শেষে রাইসাকে সিলেটের কোতোয়ালি থানার ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখা হয়েছে। পুলিশ এরই মধ্যে আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছে। রাইসা পুলিশকে কিছু তথ্য দিয়েছে। এই তথ্যে উঠে এসেছে কাজের মেয়ে তানিয়ার নাম। তানিয়া কয়েক মাস আগে কাজের মেয়ে হিসেবে রোকেয়ার বাসায় আসে। এলাকার কাঞ্চা সুমন, পাপলু, শিপন সহ কয়েক যুবক তানিয়ার পক্ষ নিয়ে রোকেয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিল। এ নিয়ে এলাকার ওই যুবকদের সঙ্গে বিরোধ তুঙ্গে ছিল রোকেয়ার। মোবাইল ফোন চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাঁধে। এরপর থেকে তানিয়া ওই বাসা থেকে কাজ ছেড়ে চলে গেলেও কাঞ্চা সুমন সহ ওই তিন যুবক বাসাতে আসা-যাওয়া করতো। রাইসার বক্তব্য থেকে পুলিশ জেনেছে খুনের ঘটনার সময়ে তানিয়া বাসাতে ছিল। তার সঙ্গে আরো কয়েক যুবক ছিল। ওই যুবকদের নাম বলতে পারেনি রাইসা। পুলিশ লাশ উদ্ধারের দিন রোববার দুপুর থেকে তানিয়ার সন্ধানে নেমেছে। গতকাল বিকালে সিলেটের কোতোয়ালি থানার ওসি গৌসুল হোসেন জানিয়েছেন- তারা তানিয়াকে খুঁজে ফিরছেন। কিন্তু এখনো তানিয়াকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তানিয়া নগরীর খারপাড়া এলাকায় বসবাস করতো বলে জানান তিনি। ওসি জানান- মামলায় কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি। তবে- অজ্ঞাত ৪-৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলা দায়েরের পর পুলিশের একাধিক টিমের পক্ষ থেকে প্রধান সন্দেহভাজন তানিয়া বেগম ও তার সহযোগী কাঞ্চা সুমনসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাদের গ্রেপ্তারে প্রযুক্তিগত অনুসন্ধান চলছে। নিহত রোকেয়ার ভাই জাকির আহমদ জানান- তার বোন মাসখানেক আগে তাকে ফোনে জানিয়েছিলেন ওই এলাকায় থাকা যাবে না। তার জন্য বাসা দেখতে অনুরোধ করেন। একই কথা গত শুক্রবার তিনি বোনের কাছেও জানিয়েছিলেন। দ্রুত বাসা ছেড়ে দেয়ার তাগিদ দিয়েছিলেন রোকেয়া। কিন্তু শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে রোকেয়ার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এ কারণে পুলিশও ধারণা করছে- শুক্রবার সন্ধ্যায় খুন হতে পারেন রোকেয়া ও তার ছেলে রূপম। খারপাড়ার মিতালী আবাসিক এলাকার ১৫-জে বাসার নিচ তলা থেকে লাশ উদ্ধারের সময় গোয়েন্দা পুলিশ বাসার ভেতর থেকে বেশ কিছু আলামত সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে দেখা গেছে- রোকেয়ার বেড রুমে বেনসন সিগারেটের প্যাকেট ছিল। ধারণা করা হচ্ছে- তানিয়ার বেড রুমে কোনো পুরুষ ছিল। বাসার পার্শ্ববর্তী পাড়ার দোকানি নাজমুল ইসলাম জানিয়েছেন- রূপম প্রায় সময় এসে তার দোকান থেকে এসে বেনসন সিগারেট নিয়ে যেত। কিন্তু রূপম সিগারেট পান করতো না। কার জন্য সিগারেট নিয়ে যেত সেটি তিনি জানেন না। শনিবার রাতেও এসে রূপম তার দোকান থেকে বেনসন সিগারেট নিয়ে গেছে বলেও জানান ওই দোকানি। বাসার মালিক সালমান হোসেন ঘটনার দিনই সাংবাদিকদের জানিয়েছেন- ২০১৭ সালের ১লা এপ্রিল রোকেয়া বেগমের স্বামী হেলাল আহমদ ১৩ হাজার টাকার রেন্টে বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। ওই সময় লোকন মিয়া নামে এক পুরুষ থাকবে বলে জানানো হয়েছিল। কিন্তু লোকন মিয়াকে এলাকার কেউ চিনেন না। কিংবা ওই নামে কাউকে দেখেছেন বলেও কেউ চিহ্নিত করতে পারেননি। তবে- মাঝে মধ্যে কাজের মেয়ে তানিয়ার কাছে এক পুরুষ আসতো বলে এলাকার মানুষ দেখেছেন। রোকেয়া বেগমের স্বামী হেলাল উদ্দিনের পরিবারের কেউ গতকাল মা ও পুত্রের জানাজায় অংশ নেয়নি। ফলে রোকেয়ার পরিবারের সদস্যরাই বিকালে তাদের সমাহিত করেন হজরত মানিকপীর (রহ.) মাজারস্থ গোরস্থানে। হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে প্রায় এক বছর ধরে সঙ্গ ছাড়া রোকেয়ার। এর ফলে দ্বিতীয় স্ত্রী সুলতানা তান্নাকে নিয়ে তিনি নগরীর বারুতখানাস্থ বাসায় বসবাস করেন। এক বছর আগে ব্রেইন স্ট্রোক করেছেন জগন্নাথপুরের বাসিন্দা হেলাল উদ্দিন। এরপর থেকে তিনি বাসাতেই অচেতন অবস্থায় রয়েছেন। হেলালের দ্বিতীয় স্ত্রী সুলতানা তান্না জানিয়েছেন- হেলালের ভাইয়েরা লন্ডনে থাকে। তারা ওখান থেকে টাকা পাঠায়। আর ওই টাকা দিয়ে তাদের সংসার চলে। ফলে স্বামীর সঙ্গ ছাড়া রোকেয়া বেগম নিজ থেকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লড়াই চালাচ্ছিলেন। নগরীর পাঠানটুলা এলাকায় তিনি বিউটি পার্লার খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। রোকেয়ার টাকার উৎস সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। নিহত রূপম মীরাবাজারের জামেয়া স্কুলের শিক্ষার্থী ছিল। সে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। কাঞ্চা সুমন, পাপলু ও রিপন ছিল এলাকার বখাটে। রাজনীতির আড়ালে তারা বেশ দাপটও খাটাতো। বিশেষ করে ভাড়াটিয়ারা তাদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ থাকতো। এলাকার লোকজন জানিয়েছেন- কাঞ্চা সুমন ও তার সহযোগীরা শনিবার থেকে এলাকায় নেই। ওই দিন তাদের পাড়ায় আড্ডা দিতে দেখা যায়নি। গতকালও এলাকায় খবর নিয়ে তাদের খোঁজ মিলেনি। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর দিনার খান হাসুও ঘটনার নেপথ্যের কারণ সম্পর্কে এখনো কিছুই জানেন না। তবে- কাঞ্চা সুমন ও তার সহযোগীরা এলাকা ছাড়া রয়েছে বলে তার কাছেও খবর এসেছে। গত এক মাস তারা রোকেয়া বেগমের বাসার আশপাশে বেশি ঘুরাঘুরি করেছে। তারা হঠাৎ হাওয়া হয়ে যাওয়ায় এলাকায় নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে বলে জানান তিনি। সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া) আব্দুল ওয়াহাব মানবজমিনকে জানিয়েছেন- ঘটনার সূত্র ধরে পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে। পাশাপাশি চলছে অভিযানও। কাজের মেয়ে তানিয়াকে পাওয়া গেলে অনেক কিছুই পরিষ্কার হবে। পুলিশ ঘটনার কারণ উদঘাটনে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.