খুলনায় এক মঞ্চে পাঁচ প্রার্থী

জলাবদ্ধতা, মাদক, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও যানজটমুক্ত খুলনা গড়ার অঙ্গীকার করলেন খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ৫ মেয়র প্রার্থী। গতকাল দুপুরে নগরীর প্রাণকেন্দ্র শহীদ হাদিস পার্কে জনগণের মুখোমুখি অনুষ্ঠানে হাত উঁচিয়ে এই অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক, বিএনপির  নজরুল ইসলাম মঞ্জু, জাতীয় পার্টির এস এম শফিকুর রহমান মুশফিক, ইসলামী আন্দোলনের মাওলানা মোজাম্মেল হক ও কমিউনিস্ট পার্টির মেয়র প্রার্থী মিজানুর রহমান বাবু। খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সুজনের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের শুরু হয় জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগের বিষয়ে শপথ বাক্য পাঠ করানো হয়। মঞ্চে উপস্থিত ৫ জন মেয়র প্রার্থীদের অঙ্গীকারপত্র পাঠ করানো হয়। এরপর শুরু হয় মেয়র প্রার্থীদের কাছে উপস্থিত জনতার প্রশ্ন। পুরো অনুষ্ঠানে প্রধান দু’দলের মেয়র প্রার্থীর প্রশ্নোত্তর পর্ব দেখতে অনুষ্ঠান স্থলে প্রচুর জনসমাগম হয়। তবে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাকর্মীরা নিজ নিজ প্রার্থীর পক্ষে করতালির মাধ্যমে শো’ডাউন দিয়ে তাদের অবস্থান তুলে ধরেন। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেককে নগরীর যানজট নিরসনে কি উদ্যোগ নিবেন, একজন ভোটারের প্রথম প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি নগর পিতা নির্বাচিত হলে সিটি করপোরেশনের মধ্যে ইজিবাইকসহ সকল গণপরিবহনের নির্দিষ্ট সংখ্যায় আনা হবে। নগরবাসীকে সুন্দর, পরিচ্ছন্ন একটি যানজটমুক্ত নগরী উপহার দেবো।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি মেয়র নির্বাচিত হলে নগরীতে মাদক বিক্রেতাসহ হোতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবো। খুলনাবাসীকে একটি মাদকমুক্ত নগরী উপহার দেয়ার অঙ্গীকার করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র প্রশ্ন করেন মাদকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আপনি কি চেয়ারে থাকতে পারবেন। তখন তিনি বলেন, মাদকের সঙ্গে কোনো আপস করা হবে না।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক এ মেয়র বলেন, বিগত দিনে আমি এ সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলাম। আমার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে নগরবাসী অবগত। খুলনাকে একটি আধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন বলে উপস্থিত জনতার কাছে প্রতিজ্ঞা করেন।
বিএনপি’র মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, নগরীতে লাইসেন্সবিহীন অতিরিক্ত ইজিবাইকের কারণে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। টোকেন বাণিজ্যের মাধ্যমে ইজিবাইক চালকদের কাছ থেকে ব্যাপক চাঁদাবাজি হচ্ছে। এটি কারা করছে তা সবার জানা। নির্বাচিত হলে চাঁদাবাজদের হাত থেকে ইজিবাইক চালকদের রক্ষা করা হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খুলনা শহরে পর্যাপ্ত খেলাধুলার মাঠ না থাকায় কিশোর এবং যুবকরা বিপথগামী হচ্ছে। এদের জন্য খেলার মাঠের ব্যবস্থা করা হবে। এরপরে খুলনার ঐতিহ্যবাহী সার্কিট হাউজ ময়দানের বাণিজ্য মেলা বন্ধ করে ক্রীড়ামোদীদের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। নজরুল ইসলাম মঞ্জুর প্রশ্নোত্তর পর্বের একপর্যায়ে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সার্বিকভাবে অনুষ্ঠানটি ভালোই হয়েছে। তবে, ‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তার’। এ কথা বলায় মঞ্চের সামনে বসা মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে অনুষ্ঠানস্থলে হট্টগোল শুরু হয়। মঞ্জু দু’টি প্রশ্নের জবাব দেয়ার পর ৩য় প্রশ্ন করার সময় একপক্ষ হট্টগোল শুরু করেন। এ অবস্থায় অনুষ্ঠানের সঞ্চালক প্রশ্নকারীকে থামিয়ে দেন। জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী এস এম শফিকুর রহমান মুশফিক বলেন, নির্বাচিত হলে নগরীর ফুটপাথ দখলমুক্ত, মাদকমুক্ত ও বস্তিবাসীর উন্নয়নে কাজ করবো।
ইসলামী আন্দোলন মনোনীত মেয়র প্রার্থী মাওলানা মুজাম্মিল হক বলেন, নির্বাচিত হলে মশা, সন্ত্রাস, দুর্নীতিমুক্ত খুলনা গড়ে তুলবো। তিনি সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেয়ার আহ্বান জানান। সিপিবি মনোনীত মেয়র প্রার্থী মিজানুর রহমান বাবু বলেন, নির্বাচিত হলে মাদকমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত ও জলাবদ্ধমুক্ত খুলনা গড়ে তুলবো। বন্ধ শিল্প-কল কারখানা চালু ও বস্তির উন্নয়নে আন্তরিক হবো। তিনি ভাত কাপড়ের লড়াইয়ের সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। এর আগে মেয়র প্রার্থীরা অঙ্গীকার করেন- নির্বাচিত হলে দুর্নীতিমুক্ত সিটি করপোরেশন, কর আদায়ে জোর প্রচেষ্টা, নির্বাচনে গণরায় মেনে নেয়া, নির্বাচিত মেয়রকে সহযোগিতা, পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা, সৌন্দর্য বৃদ্ধি, কেসিসির পরিধি বৃদ্ধি, প্রতি বছর নগরবাসীকে নিজের আয় ও ব্যয়ের হিসাব এবং যৌতুক ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলবেন।
খালিশপুর শিল্পাঞ্চলে তালুকদার খালেকের গণসংযোগ: শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে যা কিছু করা প্রয়োজন তাই করা হবে, এমন প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা মার্কার প্রার্থী আলহাজ তালুকদার আবদুল খালেক। একই সঙ্গে তিনি বকেয়া বেতন ভাতাসহ শ্রমিকের ন্যায্য সকল দাবির প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। মেয়র প্রার্থী বলেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার শ্রমিকবান্ধব সরকার। তিনি বলেন, খুলনাঞ্চলের শ্রমিকের বকেয়া বেতন-ভাতা যাতে দ্রুত পরিশোধ করা হয় সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক গতকাল সকাল ৮টায় নগরীর খালিশপুর থানাধীন ১০নং ওয়ার্ডে গণসংযোগ ও সুধীজনদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এ কথা বলেন। আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থী বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলে খুলনাকে মৃত নগরীতে পরিণত করছিল। একের পর এক শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে শ্রমিকদের বেকার করেছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে বন্ধ মিল-কল কারখানা চালুসহ শ্রমিকরা যাতে সুখে শান্তিতে থাকতে পারেন সে ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছেন। নির্বাচিত হলে খুলনা মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন ও মাদকমুক্ত একটি আধুনিক পরিচ্ছন্ন নগরী গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন তালুকদার আবদুল খালেক। তিনি খুলনার উন্নয়ন ও শ্রমিকের স্বার্থে নৌকা প্রতীকে ভোট দেয়ার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এ সময় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও নির্বাচনের সমন্বয়কারী এস এম কামাল হোসেনসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। এরপর নগরীর ১০নং ওয়ার্ডের অবশিষ্ট অংশ ও ৭নং ওয়ার্ডে গণসংযোগে অংশ নেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক।
অবৈধ খাল দখলমুক্ত ও হকারদের লাইসেন্স দেয়ার অঙ্গীকার মঞ্জুর: দখল হয়ে যাওয়া খালসমূহ দখলমুক্ত করে এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়ে নগরীর জলাবদ্ধতা দূর করার অঙ্গীকার করলেন কেসিসি নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু। জনসাধারণের চলাচলের সুবিধার্থে ফুটপাথগুলো দখলমুক্ত করার পাশাপাশি হকারদের লাইসেন্স প্রদান এবং সপ্তাহে এক একদিন একটি করে সড়ক হকারদের ব্যবসার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার কথাও জানালেন তিনি। যাতে স্বল্প আয়ের নগরবাসী ন্যায্যমূল্যে কেনাকাটা করতে পারে। তিনি বলেন, শাসক দলীয় প্রার্থীর হাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ রয়েছে। আমি দরিদ্র প্রার্থী হিসেবে এই নগরীর খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষই আমার ভরসাস্থল।
নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে গতকাল সকাল ও দুপুরে দুই দফায় নগরীর বৈকালী মোড়-বাজার এলাকা এবং পরে হাদিস পার্ক, ডাকবাংলো, ফেরিঘাট, খানজাহান আলী রোড, শান্তিধাম, সিমেট্রি রোড, পিকচার প্যালেস মোড় এলাকায় গণসংযোগকালে এসব কথা বলেন তিনি।
সকাল ৯টায় বৈকালী বাজার ও দুপুর সাড়ে ১২টায় নগরীর প্রাণকেন্দ্রে গণসংযোগকালে বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মী ও এলাকাবাসী এতে অংশ নেন।
ধানের শীষের পক্ষে পিরোজপুর বিএনপির গণসংযোগ: কেসিসি নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জুর পক্ষে খুলনা মহানগরীর ২২নং ওয়ার্ড নতুন বাজারের চরে গতকাল সকাল থেকে ব্যাপক গণসংযোগ করেছেন পিরোজপুর জেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দ। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও পিরোজপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল এলাকার ভোটারদের মাঝে ধানের শীষের লিফলেট বিতরণ করেন এবং মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের জন্য ভোট চান। এদিকে পাইকগাছা উপজেলা বিএনপির একটি শক্তিশালী সাংগঠনিক টিম নগরীর ৩১নং ওয়ার্ডে ব্যাপক গণসংযোগ ও ধানের শীষের লিফলেট বিতরণ করেছে।
কেসিসিতে ভোট না দেয়ার ঘোষণা ২৫ হাজার শ্রমিকের: ‘পকেটে টাকা নাই, পেটে ভাত নাই, সংসার চলছে না। তিন মাস মজুরি পাই না। সাত পাটকলের শ্রমিকদের প্রায় ১০০ কোটি টাকা বকেয়া। বার বার শুধু প্রতিশ্রুতিই পাই। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি নির্বাচনে ভোট দিতে যাবো না’। খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে গতকাল সকালে পাটকল সিবিএ-ননসিবিএ শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক দ্বীন ইসলাম এ কথা বলেন। তিনি বলেন, মজুরি কমিশনসহ ১১ দফা দাবি না মানা হলে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সাতটি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্য ভোট না দেয়ার।

No comments

Powered by Blogger.