মালয়েশিয়ায় মোসাদের অভিযানের নেপথ্যে

মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে ইসরাইলের দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের অভিযানে নিহত হয়েছেন ফিলিস্তিনের এক অস্ত্র বিশেষজ্ঞ। শনিবার ভোরে স্থানীয় একটি মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় করতে যাওয়ার সময় তার মাথায় ও বুকে গুলি করে মোসাদ সদস্যরা। পুলিশ হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল উদ্ধার করেছে। সন্দেহভাজন অপরাধীদের কম্পিউটারে তৈরি ছবিও প্রকাশ করেছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে নি। পুলিশের ধারণা, হত্যাকারীরা এখনো মালয়েশিয়া ত্যাগ করে নি। হত্যাকা-ের ধরন ও প্রকৃতি দেখে বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরাইলের গোয়েন্দারাই এই হত্যাকা- ঘটিয়েছে। শনিবার মালয়েশিয়ার সহকারী প্রধানমন্ত্রী আহমদ জাহিদ হামিদি বলেন, সন্দেহভাজন অপরাধীরা ছিল ইউরোপীয়, যাদের সঙ্গে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার যোগাযোগ ছিল। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ ফিলিস্তিনের জন্য মঙ্গলজনক কোনো বিষয় ভুল করে দিতে যেকোনো কিছু করতে পারে। তারা ফিলিস্তিনের বিশেষজ্ঞদের টার্গেট করেছে। যেন ফিলিস্তিনে কোনো ইন্তিফাদা না ঘটতে পারে।
নিহত ফিলিস্তিনি বিজ্ঞানী ফাদি আল বাতশ মূলত একজন প্রকৌশলী ও প্রভাষক। যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত ড্রোন তৈরিতে তার বিশেষ দক্ষতা ছিল। এই বিষয়ে তার লেখা অনেক গবেষণাপত্রও রয়েছে। তিনি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের একজন সক্রিয় সদস্য। বলা হচ্ছে, অস্ত্রবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শিতা অর্জনের জন্য হামাসই তাকে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছে। ফাদি আল বাতশ এর পরিবার হত্যাকা-ের জন্য মোসাদকে দায়ী করছে। মধ্যপ্রাচ্যের গোয়েন্দারা বলছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে আকাশ ও পানিতে বিচরণযোগ্য ড্রোন তৈরির ক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রগতি লাভ করেছিলেন ফাদি। এই অগ্রগতিই তাকে মোসাদের টার্গেটে পরিণত করেছে। তাদের দাবি, মোসাদ প্রধান ইয়োসি কোহেন নিজেই এই হত্যাকান্ডের নির্দেশ দিয়েছেন। যদিও ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাভিগদর লিবারম্যান ফাদি হত্যাকা-ের সঙ্গে তার দেশের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছেন।
ফাদি আল বাতশ এর হত্যাকান্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। বহু বছর ধরেই হামাসের কোনো সদস্য যেন বিশেষ দক্ষতা অর্জন না করতে পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখে মোসাদ। এর আগে এ বছরের জানুয়ারি মাসে লেবাননে গাড়ি বোমা হামলার শিকার হন হামাস কর্মকর্তা মোহাম্মদ হামদান। এতে গুরুতর আহত হন তিনি। তাকে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণ তৈরি দায়িত্ব দিয়েছিল হামাস। ২০১৬ সালে হামাসের আরেক ড্রোন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ জাউরিকে হত্যা করা হয়। তিনি তিউনিসিয়ায় বসবাস করতেন। নিজের গাড়িতে উঠার পর অজ্ঞাত ব্যক্তি সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল দিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করে। ২০১১ সালে ইউক্রেনের একটি ট্রেন থেকে ফিলিস্তিনি প্রকৌশলী দিরার আবু সিসিকে অপহরণ করা হয়। পরে হামাসের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে সহায়তা করার দায়ে তাকে ২১ বছরের কারাদ- দেয় ইসরাইল। বর্তমানে তিনি ইসরাইলে বন্দি রয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক বছর ধরেই হামাসের অস্ত্র বিশেষজ্ঞদের টার্গেট করে হামলা চালাচ্ছে মোসাদ। ফাদি আল বাতশের হত্যাকা- তারই ধারাবাহিকতা মাত্র। এদিকে, নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উত্তর কোরিয়া থেকে অস্ত্র ক্রয় করার জন্য হামাসের পক্ষে মধ্যস্থতা করছিলেন ফাদি আল বাতশ। উত্তর কোরিয়ার তৈরি অস্ত্র গোপনে হামাসের কাছে পৌঁছানোর পরিকল্পনা করছিলেন তিনি। এমনটিই জানিয়েছেন গোয়েন্দারা। একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে টাইমস ম্যাগাজিনের খবরে বলা হয়েছে, সম্প্রতি উত্তর কোরিয়া থেকে রকেট তৈরির উপাদান কিনেছিল হামাস। গাজায় পাঠানোর সময় সেগুলো আটক করে মিসরীয় সেনারা। এগুলো কেনার ক্ষেত্রে মধ্যস্থতা করেন ফাদি আল বাতশ। বিষয়টি ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার নজরে আসে। অবধারিতভাবেই তিনি মোসাদের টার্গেটে পরিণত হন।
ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, তুরস্কভিত্তিক একটি দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ফাদি। যারা হামাসের হয়ে বিভিন্ন গবেষণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতো। এ ছাড়া বিভিন্ন গবেষণার জন্য হামাসের পক্ষে বিদেশি বিজ্ঞানীও নিয়োগ দিত তারা। নিহত হওয়ার দিন তার ইস্তাম্বুলে যাওয়ার কথা ছিল।
গত বছর জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অস্ত্র বিক্রি করার জন্য উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছে। এই কোম্পানি কুয়ালালামপুরকে অস্ত্র বিক্রির কেন্দ্রস্থল হিসেবে ব্যবহার করে। আর মালয়েশিয়া গুটিকয়েক দেশের মধ্যে অন্যতম, যারা ‘হারমিট স্টেটের’ (আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে স্বেচ্ছায় বা জোরপূর্বকভাবে বিচ্ছিন্ন দেশ) সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। এমনকি মালয়েশিয়া ও হারমিট স্টেটের মধ্যে ভিসামুক্ত ভ্রমণ সুবিধাও রয়েছে। ফাদি আল বাতশ উত্তর কোরিয়ার এই কোম্পানির সহায়তায় হামাসের জন্য অস্ত্র কেনার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন। বিষয়টি মোসাদের দৃষ্টিগোচর হয়। ঊর্ধ্বতন মহল থেকে ফাদিকে হত্যা করার নির্দেশ আসে।
মার্কিন সাপ্তাহিক নিউজউইকে প্রকাশিত প্রতিবেদন অবলম্বনে।

No comments

Powered by Blogger.