মাদক নিরাময় কেন্দ্রে মাদকসেবীর দিনরাত by আল-আমিন

‘আঠারো বছরের তরুণ রুবন। বনানীর একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ও’লেভেলের ছাত্র। সকালে ঘুম থেকে উঠেই তার ইয়াবা সেবনের পাশাপাশি ধূমপানের নেশা ছিল। কিন্তু, এখন ঘুম থেকে উঠেই রুবন এক গ্লাস শরবত পান করেন। যাতে থাকে পুষ্টিকর ফলের রস। বাবা ও মায়ের একমাত্র সন্তান সুঠাম দেহের এই তরুণ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার ছলে নেশায় আসক্ত পড়ে। ছন্নছাড়া জীবন হয়ে যায় তার। বাবা ও মা কঠিন এক দুশ্চিন্তার সাগরে নিপতিত হয়। অনেক শাসন ও নিষেধের পরও তাকে এই সর্বগ্রাসী নেশা থেকে বিরত রাখা যায়নি। একপর্যায়ে রুবনের চিকিৎসার জন্য ঢাকার গুলশানের ‘মুক্তি’ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ভর্তি করা হয়। সেখানে ২৪ ঘণ্টা তাকে চিকিৎসক ও কর্মচারীরা পর্যবেক্ষণে রাখছেন। বলা যায় তার এখন একপ্রকারের বন্দি জীবন। চিকিৎসকের ওষুধের থেরাপি ছাড়াও তাকে মানসিকভাবে শক্তি দেয়ার জন্য নিয়মিত ‘কাউন্সিলিং’ করা হয়। এই অবস্থায় রুবনের ভবিষ্যত চিন্তায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত তার বাবা- মা। মাদকাশক্তি নিরাময় কেন্দ্র চিকিৎসা শেষে সেই পুরনো রুবন তাদের বুকে ফিরে আসবে এই আশায় বুক বেঁধে বসে আছেন তারা।
এ বিষয়ে মানসিক অ্যান্ড মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের (মুক্তি) জিএম আবদুর রশীদ মানবজমিনকে বলেন, মুক্তি ঢাকার নামকরা মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র। এই প্রতিষ্ঠানে ৪৬ জন রোগী ভর্তি আছেন। তার মধ্যে ৪ জন নারী। তিনি জানান, ভর্তিরত রোগীর মধ্যে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী। বাকিরা অন্য পেশায় নিয়জিত। একজন মাদকাসক্ত রোগীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে কাজ করে যাচ্ছে মুক্তি। মাদকাসক্ত রোগীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য ওষুধ সেবন করানোর পাশাপাশি প্রত্যেকের জন্য আলাদা ও গ্রুপ কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা আছে। তাদের এমবিবিএস চিকিৎসকসহ একটি কাউন্সিলিং বোর্ড রয়েছে। গতকাল সকালে ওই প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা যায়, জেনারেল ম্যানেজারের কক্ষে ভর্তিরত স্বজনদের ভিড়। ম্যানেজারের কাছে তাদের রোগীদের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চান। তাকে যেন পূর্ণ সুস্থ করা যায় এজন্য কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। কেউ খাবার বা বিভিন্ন পণ্য কেনার জন্য অতিরিক্ত টাকা দিচ্ছেন। মিরপুর থেকে আসা সুমাইয়া আক্তার নামে এক গৃহিণী জানান, তার মেয়ে ঢাকার একটি নামকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কয়েকমাস আগে ইয়াবায় আসক্ত হড়ে পড়ে। নেশার অতিরিক্ত টাকার চাহিদার কারণে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠি। একপর্যায়ে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। তাকে চিকিৎসা দেয়ার জন্য মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছে। নিরাময় কেন্দ্র মুক্তি, সেখানে ভর্তিরত রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ভর্তিরত একজন রোগীকে ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। প্রতিদিন সকাল ৭ টার দিকে তাদের ঘুম থেকে উঠানো হয়। ঘুম থেকে উঠেই তাদের এক ফলের শরবত দেয়া হয়। সেখানে নিয়োজিত নার্স ও কর্মচারীরা সর্বক্ষণ তাদের অনুসরণ করেন। এরপর তাদের সকাল ৮টায় সময় নাস্তা দেয়া হয়। নাস্তা শেষে রোগীদের পাঠানো হয় স্টাডি রুমে। তারা সেখানে ডেইলি পত্রিকাসহ বিভিন্ন বই পড়েন। কেউ আবার টেলিভিশন দেখেন। বেলা ১১টায় তারা আবার চলে যান নিজ নিজ বেডে। সেখানে চিকিৎসকরা প্রত্যেকটি বেডে রাউন্ড দেন। সময় ধরে মাদকাসক্ত রোগীর সর্বশেষ অবস্থা জানতে চান। চিকিৎসক রোগীর ওষুধ সেবনের বিষয়টি জানতে চান।
সূত্র জানায়, দুপুর ১২ টার পর তারা বিশ্রাম নেন। দুপুর ১ টার দিকে তারা গোসল করেন। গোসলের পর তারা নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী প্রার্থনা করেন। প্রার্থনা শেষে তাদের দুপুরের খাবার দেয়া হয়। খাবারে তিন বেলায় পুষ্টিকর সবজি রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। দুপুরের খাবারের পর তারা আবার বিশ্রামে চলে যান। বিকাল ৪ টার দিকে তাদের জন্য একক বা গ্রুপ কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করা হয়। কাউন্সিলিং এর পাশাপাশি কাউকে যোগ ব্যায়াম করানো হয়। কাউন্সিলিংয়ে জীবনের মূল্য, নৈতিকতা, শিষ্টাচার ও জীবনের শেষ গন্তব্যের পথ দেখানো হয়। পরিবারের প্রতি ভালোবাসা, সমাজ ও দেশের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে অবগত করা হয়। সন্ধ্যার পর ২০ মিনিট তাদের ধর্মীয় বয়ান দেয়া হয়। এরপার আবার তারা নিজ নিজ বেডে চলে যান। তখন তাদের হালকা নাশতা দেয়া হয়। ঠিক রাত ৮ বাজলেই আবার চিকিৎসক প্রত্যেকটি বেডে রাউন্ড দেন।
রাত পৌঁনে ৯ টার দিকে তাদের রাতের খাবার দেয়া হয়। খাবারের পর তারা ওষুধ সেবন করেন। রাত ১০ থেকে ১১ টা পর্যন্ত তাদের বিনোদনের জন্য টেলিভিশন দেখতে দেয়া হয়। টেলিভিশন দেখার জন্য একটি আলাদা কক্ষই আছে। তবে মাদকসেবীরা নিজেরা পছন্দ অনুযায়ী চ্যানেল দেখতে পারেন না। কর্তৃপক্ষ তাদের শিক্ষামূলক চ্যানেল দেখতে দেন। যাতে তাদের জীবনাবোধের শক্তি বাড়ে। রাত ১১ টা হলে তারা আবার নিজ বেডে ঘুমানোর জন্য চলে যান। এ সময় ঘুমানোর জন্য নিরাময় কেন্দ্রের বাতি বন্ধ করে দেয়া হয়। একজন রোগীর ৪ মাস এভাবেই তার জীবন রুটিনে বন্দি থাকে। তাদের স্বজনরা আশায় বসে থাকেন, আবার হয়তো সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে তিনি ফিরে আসবেন। নিরাময় কেন্দ্রে দিনের কার্যসূচিতে যাতে কোনরকম হেরফের না হয় এজন্য কর্মচারীরা তৎপর থাকেন। কোন রোগী দিনের নিয়মিত কাজে অলসতা করলে তাকে অনেক বুঝিয়ে ও ভালোবাসা দিয়ে রুটিন অনুযায়ী চলার পরামর্শ দেন।
জানা গেছে, নিরাময় কেন্দ্রে একটি বড় সমস্যা মোকাবিলা করতে হয় কর্তৃপক্ষকে। তা হচ্ছে- ভর্তিরত অনেক মাদকসেবী পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু, নার্স ও সেখানে কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তাদের সর্বক্ষণ নজরদারির কারণে তারা সেখান থেকে পালিয়ে যেতে পারেন না। মূল গেটে ২৪ ঘণ্টা একজন নিরাপত্তারক্ষী দায়িত্ব পালন করেন। তার হাতে একটি চাবি থাকে। ঢোকা ও বের হওয়ার ক্ষেত্রে তার জবাবদিহিতার মধ্যে পড়তে হয়। এর আগে মুক্তি নিরাময় কেন্দ্র থেকে কয়েকজন রোগী বাইরে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে গেটে তাদের আটকে দেয়া হয়। পরে তাদের স্বজনদের খবর দেয়া হয়। তবে যেসব রোগীর পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় তাদের বেশি করে কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করা হয়। মুক্তিতে ভর্তিরত একজন রোগী জানান, আমি একা একা অনেক চেষ্টা করেছি মাদক ছেড়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু পারিনি। পরিবারের সঙ্গে পরামর্শ করে নিজেই এই মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র ভর্তি হয়েছি। আমি আশা করি মরণ নেশা মাদক থেকে মুক্তি পাবো।
এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের চিকিৎসক ডা. রশিদুল হক জানান, নিরাময় কেন্দ্র একজন মাদকাসক্ত রোগীকে মাদক সেবন থেকে বিরত রাখতে ভালো ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে যে কাউন্সিলিং করা হয় তাতে রোগী জীবনের ছন্দ খুঁজে পায়।

No comments

Powered by Blogger.