সাংবাদিকেরা পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ by মাইকেল উলফ

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে লেখা বই ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি : ইনসাইড দ্য ট্রাম্প হোয়াইট হাউজ প্রকাশের পরই তোলপাড় শুরু হয়েছে মার্কিন মুল্লুকে। অনুসন্ধানী সাংবাদিক মাইকেল উলফের বইটির প্রকাশনা ঠেকাতে আইনি পদক্ষেপও নিয়েছিলেন ট্রাম্প। তবে তাতে কাজ হয়নি। বরং নির্ধারিত তারিখের আগেই গত ৫ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়েছে বইটি। প্রকাশের প্রথম দিনেই শেষ হয়ে যায় সব কপি। অগ্রিম অর্ডার দেয়া হয় ১০ লাখ কপির। বইটির চুম্বক অংশ নয়া দিগন্তের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো। ভাষান্তর করেছেন আহমেদ বায়েজীদ
[পর্ব-৬]

হোয়াইট হাউজজুড়েই বারবার এই প্রশ্ন উঠতে থাকে যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর ট্রাম্প তার অনিয়ন্ত্রিত ও উল্টোপাল্টা বক্তব্য সংবলিত টুইটার পোস্টগুলো চালু রাখবেন কি না। সবার কাছেই উত্তর ছিল- তিনি তা আগের মতোই রাখবেন। সরকার পরিচালনায় তিনি মৌলিক একটি বিষয় নিজ উদ্যোগে প্রবর্তন করেন। তা হলো, নিয়মিতভাবে, অনিয়ন্ত্রিত বিদ্বেষ ও ক্রোধের বিস্ফোরণ ঘটানো (যার শিকার হতেন তার আশপাশের ও মিডিয়ার লোকেরা)। প্রেসিডেন্টের প্রথম কাজগুলোর একটি ছিল সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (সিআইএ) সাথে বৈঠক। শপথ গ্রহণের পরদিন ২১ জানুয়ারি, শনিবার এই বৈঠকটির আয়োজন করেন জ্যারেড কুশনার। প্রথম সরকারি পরিদর্শনে এদিন ভার্জিনিয়ার ল্যাংলিতে সিআইএ হেডকোয়র্টারে যান ট্রাম্প। স্টিভ ব্যাননের আশা ছিল, ট্রাম্প হয়তো সেখানে কিছু রাজনৈতিক চাল চালবেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেয়া প্রথম বক্তৃতাটি তাই সতর্কতার সাথে প্রস্তুত করা হলেও ট্রাম্প সিআইএর বিরুদ্ধে তার বিখ্যাত সব স্তবক ঢেলে দিলেন। মার্কিন গোয়েন্দা জগতের বিতর্ক, বিভিন্ন সময় গোপন তথ্য ফাঁস- সব কিছুই টেনে আনলেন। প্রায় ৩০০ সিআইএ কর্মকর্তা আর হোয়াইট হাউজ স্টাফদের সামনে ছিল সেই বক্তৃতা।
এই বক্তৃতাকে আমরা সহজেই এক মার্কিন প্রেসিডেন্টের ‘সবচেয়ে অদ্ভুত বক্তৃতা’ বলতে পারি। ট্রাম্প বললেন, ‘ওয়েস্ট পয়েন্ট যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অ্যাকাডেমি সম্পর্কে অনেক কিছু জানি। শিক্ষা বা শিক্ষাবিদদের ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস। প্রায়ই বলি যে, আমার একজন চাচা ছিলেন ৩৫ বছর ধরে এমআইটির বিখ্যাত প্রফেসর। শিক্ষা বিষয়ে তার অনেক অবদান, তিনি একজন জিনিয়াস। তার প্রসঙ্গ এলে আমাকে প্রশ্ন করা হয়, ডোনাল্ড ট্রাম্পও কি অত্যন্ত মেধাবী? (আমি বলি) আস্থা রাখুন, আমিও স্মার্ট।’ ওই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেল মাইক পম্পেও, শিগগিরই যাকে সিআইএর ডিরেক্টর নিয়োগ করা হবে। আরো অনেকের মতো তিনিও হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। ট্রাম্প বলে চলেন, ‘আপনারা জানেন আমি যখন যুবক ছিলাম; অবশ্য নিজেকে এখনো আমি যুবকই মনে করি; মনে হয় ৩০, ৩৫ কিংবা ৩৯ বছরের। কেউ যদি প্রশ্ন করে, আপনি কি যুবক? বলি, আমার মনে হয় তাই। নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিনগুলোতে আমি প্রতিদিন ৪, ৫ এমনকি ৭ জায়গায় গিয়েছি। ২৫ থেকে ৩০ হাজার লোকের সামনে বক্তৃতা করেছি। নিজেকে যুবকের মতোই মনে হয়েছে। আমার মনে হয়, আমরা সবাই যুবক।’ ‘আমি যখন যুবক ছিলাম, এই দেশে আমরা সব কিছুতে জিততাম; কিন্তু অনেক বছর ধরে আমরা বাণিজ্যে জিততে পারছি না, যুদ্ধে জিততে পারছি না। একটি সময় যুক্তরাষ্ট্র কখনোই যুদ্ধে হারত না বলে শুনেছি। কিন্তু এখন আমরা কোথাও জিততে পারছি না। আপনারা পুরনো সেই নিয়মটা জানেন যে, বিজয়ীরাই যুদ্ধক্ষেত্রের সব সম্পদের মালিক হবে। মনে করে দেখুন, আমি সব সময় বলি, তেল দখলে রাখা উচিত।’ এক সিআইএ কর্মী বোকার মতো প্রশ্ন করলেন, ‘কাদের তেল দখলে রাখা উচিত?’ ট্রাম্পের জবাব, ‘আমি ইরাকের বিষয়ে আগ্রহী ছিলাম না। ইরাক যুদ্ধের পক্ষে ছিলাম না। আপনাদের বলতে চাই, আমরা সেখানে গেলাম এবং ভুল পন্থায় বের হয়ে এলাম। সবসময়ই আমি বলেছি, তেলটা নিজেদের দখলে রাখুন। এখন সেটা বলছি অর্থনৈতিক কারণে; কিন্তু আপনারা যদি বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেন তাহলে বুঝতে পারবেন, আমরা তেল সম্পদ দখলে রাখতে পারলে আইএসের মোকাবেলা করতে হতো না। কারণ আইএসের অর্থের প্রধান উৎস তেল। তাহলে কেন আমরা তেল দখলে রাখলাম না? তবে হয়তো আমরা আবার সুযোগ পাবো। কিন্তু আসল বিষয় সেটাই যে, ওই সময়ই আমাদের তেল সম্পদ দখলে রাখা উচিত ছিল।’ এই বলে প্রেসিডেন্ট কিছুটা থামলেন। আত্মবিশ্বাস ও সন্তুষ্টি নিয়ে মুচকি হাসলেন। এরপর আবার বললেন, ‘সব কিছুর আগে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। কারণ আপনারা জানেন যে, সংবাদমাধ্যমের সাথে আমার যুদ্ধ চলছে। তারা বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ মানুষদের কাতারে আছে। তারা প্রচার করছে যে, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সাথে আমার বিরোধ আছে। তাদের এ ধারণা ভুল প্রমাণিত করতে, তারা যা ভাবে তা মিথ্যা প্রমাণ করতে আমি প্রথমে আপনাদের কাছে এসেছি। উপস্থিত লোকদের সংখ্যার বিষয়ে আমাকে ধারণা দেয়া হয়েছিল।
গতকাল যে বক্তৃতা দিয়েছি সবাই কি তা পছন্দ করেছে? আপনারা হয়তো করতে বাধ্য; কিন্তু আমাদের বিশাল একটি সাধারণ জনগোষ্ঠী আছে। আপনারা দেখেছেন তাদের ভিড় (তারা স্বেচ্ছায় এসেছে)। আজ সকালে আমি ঘুম থেকে উঠে টিভিতে চোখ রাখলাম। তারা একটি খালি মাঠের দৃশ্য দেখিয়েছে; কিন্তু আমি তো সেই মাঠের দিকে তাকিয়েছি। আমার কাছে মনে হয়েছে, ১০ থেকে ১৫ লাখ লোক ছিল সেখানে। টিভিতে এমন একটি মাঠ দেখিয়েছে যেখানে আসলে কেউ ছিল না। এরপর বলল, ডোনাল্ড ট্রাম্পের আয়োজন ভালো হয়নি, লোক টানতে পারেননি। আমি বলছি, তখন বৃষ্টি ‘আসি আসি’ করছিল; কিন্তু বিধাতা দেখলেন এবং বললেন, তোমার আয়োজনে আমি বৃষ্টি দেবো না। এরপর বক্তৃতা শুরু করলাম। প্রথম বাক্যটি বলার সময় আমার গায়েও কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ল। আমি বললাম, খুবই বাজে অবস্থা। তবে আমরা এর মধ্যেই অনুষ্ঠান চালিয়ে যাবো। সত্য কথা হলো দ্রুতই বৃষ্টি থেমে গেল। ‘না, বৃষ্টি থামেনি।’ ট্রাম্পের সফরসঙ্গী এক নারী কর্মকর্তা মুখ ফসকে বলে ফেললেন কথাটি। ভয় পেয়ে তাকালেন যে, ট্রাম্প শুনে ফেলেছেন কি না! কিন্তু ট্রাম্প বলেই চলছেন, ‘এরপর ঝকঝকে রোদ উঠল। (বক্তৃতা শেষ করে) আমি চলে এলাম। আমরা চলে আসার পর বৃষ্টি নামল। আরেকটি চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছে। ওভাল অফিসে ডক্টর মার্টিন লুথার কিংয়ের একটি ভাস্কর্য ছিল, যেটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে আমি স্থান পেয়েছি ১৪ থেকে ১৫ বার। আমার বিশ্বাস টাইম ম্যাগাজিনের ইতিহাসে এটি একটি রেকর্ড। এক বছরে ১৫ বার! আমার মনে হচ্ছে এই রেকর্ড ভাঙা সম্ভব নয়, মাইক পম্পেও, আপনার কি মনে হয় ভাঙা সম্ভব?’ ‘না’ আতঙ্কিত কণ্ঠে জবাব দিলেন পম্পেও। ‘আপনারা জানেন, সেই টাইম ম্যাগাজিন বলেছে ডোনাল্ড ট্রাম্প ভাস্কর্যটি সরিয়েছে। জেকে... এমন নামের একজন টাইম ম্যাগাজিনে লিখেছে, আমি সেটি সরিয়েছি। আমি কখনোই এ কাজ করিনি। মার্টিন লুথার কিংকে আমি খুবই সম্মান করি। কিন্তু অসৎ মিডিয়ার কাজ এটি। আমি সততা পছন্দ করি, সেটি জানিয়ে দিতে চাই। বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টিং পছন্দ করি। শেষবারের মতো তাদের বলছি, আমি আপনাদের পছন্দ করি। আপনাদের যতটা সম্মান করি, আর কাউকে নয়। আপনারা ভালোভাবে কাজ করলে আমরা আবারো সবকিছুতে জিততে শুরু করব।’

No comments

Powered by Blogger.