এভাবে চলতে থাকলে অর্থনীতি ধসে পড়বে by পিয়াস সরকার

ব্যাংকিং ও শিক্ষাখাতে দুর্নীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ড. ইফতেখারুজ্জামান। হতাশও তিনি। এ দুটি খাত দেশের চালিকাশক্তি। আর এ খাতে দুর্নীতি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হতে পারে। এমনটাই আশঙ্কা তার। মানবজমিন-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি সকল দুর্নীতিকেই ক্ষতির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
বলেন, ব্যাংকখাতে চলা দুর্নীতি অব্যাহত থাকলে দেশের অর্থনীতিতে ধস নামবে। আর শিক্ষাখাতের দুর্নীতি দেশকে পঙ্গু করে দেয়। ড. ইফতেখারুজ্জামান দুর্নীতি রোধে ব্যাপক সংস্কারের কথা বলেছেন। এজন্য নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের পরামর্শ দিয়ে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দেয়ার কথাও বলেন। টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক পরিচালনা পর্ষদেরও সদস্য। দীর্ঘদিন ধরে দেশের নানা খাতের দুর্নীতি নিয়ে কাজ করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এ সংস্থাটি দেশের বিভিন্ন খাতে জরিপ চালায়। পরে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করে। মানবজমিন-এর পক্ষ থেকে তার মুখোমুখি হলে তিনি দুর্নীতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন। বিভিন্ন সময় সরকারের পক্ষ থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার কথাও বলেন তিনি। দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের অগ্রগতি হয়েছে। আমরা একসময় সর্বনিম্নে ছিলাম। বর্তমানে আমরা বৈশ্বয়িক তালিকায় নিচের দিক থেকে পঞ্চদশ অবস্থানে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা শুধুমাত্র আফগানিস্তান থেকে ভালো অবস্থানে। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সার্বিক বিবেচনায় আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ নেই। তিনি বলেন, এই সূচক যেহেতু আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে হয়, তাই বলা যায় আমরা ভালো করার চেয়ে অন্যান্য কিছু দেশ খারাপ করেছে বেশি। সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রীর সহনীয় মাত্রায় ঘুষ গ্রহণের বক্তব্যকে তিনি মনে করেন এটি ঘুষকে বৈধতা দেয়ার শামিল। ড. ইফতেখার বলেন, শিক্ষাখাতে দুর্নীতি অন্যসব খাতের তুলনায় অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এবং দীর্ঘমেয়াদি। প্রশ্নপত্র ফাঁস, টেক্সটবুক জালিয়াতি কিংবা অন্যায়ভাবে চাকরি দেয়ার মাধ্যমে দেশকে মেধাহীন করে তোলা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, মন্ত্রীর এমন বক্তব্য অপারগতার দৃষ্টান্ত। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে এসব দুর্নীতির সঙ্গে সরকারদলীয় কেউ জড়িত কিনা? দুর্নীতিবাজদের মন্ত্রী সুরক্ষা দিতে চাইছেন কিনা? ড. ইফতেখার বলেন, মন্ত্রীর উচিত ছিল দুর্নীতিবাজদের শাস্তি নিশ্চিত করে সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। তিনি বলেন, প্রায় সব ব্যাংকই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। লুটপাটের সঙ্গে জড়িত। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই অর্থনীতি ধসে পড়বে। সাইবার অপরাধ সম্পর্কে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে দিন দিন অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। আর এ অপরাধ রোধ করতে হবে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেই। টিআইবি এক্ষেত্রে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কারণ আধুনিক হাতিয়ার ব্যবহারে পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত না হলে মৌলিক অধিকার বাক-স্বাধীনতা খর্ব হতে পারে। ৫৭ ধারার অপব্যবহারের মাধ্যমে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি- পেশার মানুষ হয়রানির শিকার হয়েছেন। তাই আমরা সরকারকে পরামর্শ দিয়েছি সুনির্দিষ্ট বিধিমালা তৈরি এবং নিশ্চিত করার। তিনি বলেন, বিধিমালা তৈরিতে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিতে পারে সরকার। প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় দুর্নীতি দমন কমিশনের কতিপয় কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যের দুর্নীতির চিত্র উঠে আসে। এ বিষয়টি নিয়ে বলবেন? এ প্রশ্নে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এটা এলার্মিং। যাদের হাতে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তারাই যদি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে যান তাহলে স্বাভাবিকভাবেই অপরাধ বাড়বে। যার ফলে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সৃষ্টি হবে। তবে আশার কথা হচ্ছে-সম্প্রতি দুদক দুর্নীতি প্রতিরোধে সোচ্চার। তারা চেষ্টা করছে দৃষ্টান্ত স্থাপনের। এটাকে সবার সমর্থন জানাতে হবে। তিনি বলেন, সর্বপ্রথম সাধারণ মানুষ পুলিশের কাছে যায়। সেখানে স্বজনপ্রীতি কিংবা অর্থের বিনিময়ে সেবা প্রদানের মাধ্যমে দুর্নীতিকে এক প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়। টিআইবি’র কার্যক্রম দুর্নীতির চিত্র পরিবর্তনে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পেরেছে? এ প্রশ্নে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, চাহিদা সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান হলো টিআইবি। আমরা জনগণকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে উৎসাহ দেই। দুদক, বিচার বিভাগ, জাতীয় সংসদ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসনসহ যাদের ওপর দুর্নীতি দমনের দায়িত্ব তাদের যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি করা টিআইবি’র কাজ। পাশাপাশি পরিবেশ সৃষ্টির জন্য আমরা গবেষণা ও বিভিন্ন পরামর্শের মাধ্যমে আইনি সংস্কারের প্রস্তাব বা সরকারের সঙ্গে কাজ করি। আমাদের কাজের ফলে বেশকিছু আইনি সংস্কার আনা সম্ভব হয়েছে। আমাদের এডভোকেসিতে দুদকের সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের পরামর্শের ফলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশে পরিণত হয়েছে। তথ্য অধিকার আইন, তথ্য সুরক্ষা আইন সংসদে পাস হয়েছে। গতবছর থেকে বাংলাদেশ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে ৯ই ডিসেম্বর দুর্নীতি বিরোধী দিবস পালনের। ড. ইফতেখার বলেন, আমি বলছি না, এর মাধ্যমে দুর্নীতি নির্মূল হয়ে যাবে। তবে এটা সরকারের দুর্নীতিবিরোধী সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। আরেক প্রশ্নের জবাবে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, টিআইবি’র কাজ এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমে দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা সম্ভব। তিনি বলেন, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা যতবেশি বিকাশ লাভ করবে ততবেশি দুর্নীতি বা অপরাধ নির্মূলে সাহায্য করবে। সেই বিবেচনায় আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। যেমন সেরা অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের পুরস্কৃতরা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ, অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ফেলোশিপ প্রদান ইত্যাদি। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মূলকথা হলো-অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং দুর্নীতি দমনের আন্দোলন একই সূত্রে গাথা। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার যে স্বপ্ন ছিল, সেই স্বপ্ন এখনো আমার অটুট রয়েছে। স্বাধীনতার স্বপ্নে দুর্নীতি নামক কোনো শব্দ ছিল না। আমার স্বপ্ন এমন একটা দেশ হবে- যেখানে মেধা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দেশ গঠন হবে। দুর্নীতি নামক কোনো শব্দ থাকবে না। সুশাসন প্রতিষ্ঠা পাবে। সকল মানুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা হবে।

No comments

Powered by Blogger.