পরিত্যক্ত ঘরে দুঃসহ জীবন মুক্তিযোদ্ধা আলী মাস্টারের by আশরাফুল ইসলাম

পরিত্যক্ত ঘরে দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা হযরত আলী মাস্টার। অকুতোভয় এই মুক্তিযোদ্ধা রণাঙ্গণ থেকে বিজয়ীর বেশে মুক্ত স্বদেশে ফিরলেও জীবনযুদ্ধে যেন এক পরাজিত সৈনিক। স্বজনদের হামলায় দফায় দফায় রক্তাক্ত হয়ে তাঁকে ছাড়তে হয়েছে পৈত্রিক ভিটেমাটি। বুকভরা দীর্ঘশ্বাস আর আশাভঙ্গের বেদনা নিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন পাকুন্দিয়ার মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ের পরিত্যক্ত অন্ধকার কুঠুরীতে। দিবস আসে দিবস যায়, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হযরত আলী মাষ্টারের কেউ খোঁজ রাখে না। সেই অন্ধকার কুঠুরীতেই হয়তো তাঁর শেষ নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে কালের অতলে হারিয়ে যাবে চিরকুমার কালজয়ী এই বীরের বীরত্বপূর্ণ আর সাহসিকতার মহাআখ্যান। পাকুন্দিয়া জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নের দগদগা গ্রামের মৃত আবু সরকারের পুত্র হযরত আলী।
ছোট বড় সবার কাছে তিনি মুক্তিযোদ্ধা আলী মাস্টার নামে পরিচিত। নয় ভাইবোনের মধ্যে অষ্টম হযরত আলী মাত্র নয় বছর বয়সে পিতৃহারা হন। ১৯৫৯ সালে হোসেনপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজে ভর্তি হন। সেখানেই মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির আদর্শে রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি হয়। ১৯৬২ সালে আইএসসি পাশ করে পাকুন্দিয়া উপজেলার চরপলাশ স্কুলে সহকারী শিক্ষক পদে যোগ দেন। এরপর কিছুদিন তারাকান্দি মাদরাসা ও হোসেন্দী স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬৫ সনে পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি অংশ নিয়ে একজন অকুতোভয় যোদ্ধা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি ১২০ জন যোদ্ধার কমান্ডার নিযুক্ত হন এবং জামালপুর জেলার সীমান্তে দায়িত্ব পালন করেন। পাক-ভারত যুদ্ধের ইতি ঘটলে রণাঙ্গণ থেকে ফিরে ১৯৬৬ সালে তিনি উপজেলার কোদালিয়া স্কুলে সহকারী শিক্ষক পদে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ হযরত আলী মাষ্টারকে ফের উদ্দীপ্ত করে। ৭ই মার্চের ভাষণ শোনার পর থেকে ভেতরে ভেতরে মুক্তিসংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন তিনি। এ জন্যে রাতের বেলা স্কুল প্রাঙ্গণে এলাকার যুবক, ছাত্রদের বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেন। তার এই প্রশিক্ষণে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সৈনিক উপজেলার আজলদী গ্রামের আব্দুল মান্নান। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনী কয়েক দফা অভিযান চালায় ওই স্কুলে এবং স্কুলের আসবাবপত্র ভাঙচুরের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকার ক্ষতিসাধন করে। ২৫শে মার্চ ঢাকায় নিরীহ লোকজনের ওপর হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত হামলার সংবাদ পান আলী মাষ্টার। ২৬শে মার্চ কিশোরগঞ্জ স্টেডিয়ামে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সভায় যোগ দিয়ে সভা চলার সময়েই রামদা হাতে মঞ্চে উঠে আলী মাষ্টার হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এ সময় তিনি সাহসী যুবকদের সঙ্গে নিয়ে পাশের মহকুমা কারাগারের গেইট ভেঙ্গে বন্দীদের মুক্ত করেন। এর পর পরই আলী মাষ্টার ভারতে চলে যান। সেখানে বিদেশী চর (গোয়েন্দা) সন্দেহে গ্রেপ্তার হন তিনি। বাংলা ভাষার পাশাপাশি উর্দু, হিন্দি, আরবী ও ইংরেজি ভাষা আয়ত্বে ছিল বলেই তাকে গোয়েন্দা ভেবে সন্দেহ করে ভারত সরকার। ভারতে ২৫ দিন বন্দি অবস্থায় থাকার সময়ে চার বার ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি করা হয় আলী মাস্টারকে। তথ্যপ্রমাণ দিয়ে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। প্রকৃত বাংলাদেশী হিসেবে বিশ্বাস অর্জনের পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় তুরা ক্যান্টনমেন্টে। ক্যান্টনমেন্টের ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে ছিলেন চট্টগ্রামের বাসিন্দা ইপিআর’এর সুবেদার আব্দুল গফুর। প্রশিক্ষণে চৌকস মেধাবীর পরিচয় দেয়ায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কিছুদিন উইং কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। প্রশিক্ষণ শেষে ২৬০ জন যোদ্ধার কোম্পানী কমান্ডার হিসেবে অস্ত্র ও গোলা বারুদ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। প্রথম এক মাস সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার সীমান্ত এলাকায়, পরে ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল, কিশোরগঞ্জ সদর, হোসেনপুর, পাকুন্দিয়া, কটিয়াদী, কুলিয়ারচর, ভৈরব ও গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার টোক এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনায় নেতৃত্ব দেন তিনি। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে উদয় হয় বিজয়ের সূর্য। যুদ্ধ শেষে অস্ত্র জমা দিয়ে তিনি পুনরায় ফিরে যান কর্মজীবন শিক্ষকতায়।
আলী মাস্টার জানান, সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করায় ১৯৭৫ সালের ৪ঠা জানুয়ারি পাকুন্দিয়া থানার সামনে থেকে গ্রেপ্তার হন তিনি। টানা ১৮ দিন ডিএসবি শেলে জিজ্ঞাসাবাদের পর ময়মনসিংহ কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয় তাকে। কারাগার থেকে মুক্তি পান ২৮শে জানুয়ারি। মুক্তি পেয়ে ফিরে আরো কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। ১৯৭৯ সালে শিক্ষকতা থেকে ইস্তফা দিয়ে বাড়িতে ফিরে যান। মনোনিবেশ করেন কৃষি কাজে, হয়ে উঠেন গবাদি পশুপ্রেমী, বৃক্ষপ্রেমী এক কৃষক। এরই মধ্যে মেঘে মেঘে অনেক বেলা গড়িয়ে যায়। কখন যে যৌবনকাল পেরিয়ে গেছে বুঝতেও পারেননি তিনি। আজও তিনি সঙ্গীবিহীন একাকী জীবন কাটাচ্ছেন। এরই মাঝে ১৯৮২ সালে স্বজনদের হামলায় আহত হন তিনি। এরপর ৯৪, ৯৭ ও ২০০০ সালে আরো ৩ দফা হামলায় রক্তাক্ত হন আলী মাস্টার। সর্বশেষ আহত হওয়ার ঘটনায় তিনি থানায় মামলা করেন। এখনো মামলাটি আদালতে বিচারাধীন। বাড়িঘর জমাজমি বেশির ভাগই দখল করে নিয়েছে ভাতিজারা। ঠাই নিয়েছেন পরিত্যক্ত মুক্তিযোদ্ধা কার্যালয়ে। বেশির ভাগ সময় নিজেই রান্না করেন। পরিত্যক্ত এ কার্যালয়টির চারপাশে বিদ্যুৎ থাকলেও তিনি থাকেন বিদ্যুৎহীন একটি কক্ষে। একরাশ হতাশা আর অবহেলায় আজ কেবলই বিষাদময় এই বীরযোদ্ধার জীবন।

No comments

Powered by Blogger.