স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় মেটাতে দারিদ্র্যসীমার নিচে ৫ শতাংশ পরিবার by ফরিদ উদ্দিন আহমেদ

দেশে সরকারের মাথাপিছু স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় কমার কারণে হিমশিম খাচ্ছেন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পরিবারগুলো। এতে পাঁচ শতাংশ পরিবার স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ের  কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সর্বশেষ এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে আকস্মিক বিপর্যয়ে পড়েছেন। ইনস্টিটিউটটির পরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ এমন তথ্য জানিয়েছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রায় শতভাগ হেলথ কভারেজ থাকলেও ৫০ শতাংশের উপরে মানুষ ফার্মেসি বা হাতুড়ে চিকিৎসকদের কাছ থেকে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে থাকেন। যারা স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন তাদের কোনো মেডিকেল শিক্ষা নেই।
অন্যদিকে যাদের প্রাতিষ্ঠানিক মেডিকেল শিক্ষা আছে তাদের সংখ্যা ৪৫ শতাংশ। এখানেও মানসম্মত কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। পরিচালক বলেন, স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সরকারি ব্যবস্থাকে আরো কার্যকর করতে হবে। সরকারি কেন্দ্রগুলোতে রোগী কম আসার কারণ-চাহিদা ও সরবরাহে সমস্যা।
স্বাস্থ্যের জন্য ৬৭ শতাংশ খরচ ব্যক্তি নিজের পকেট থেকে করে। এটা রোগ নির্ণয় করতে গিয়ে ব্যক্তি বেশি খরচ করেন বলে গবেষকরা উল্লেখ করেন। অতিরিক্ত ওষুধ, অতিমাত্রায় ওষুধের দাম রাখা, বেশি বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেয়া, হাসপাতাল ও ক্লিনিকের নিজেদের মতো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি নির্ধারণ, হাসপাতালে রোগীর সিটের বা কেবিনের ভাড়া বাবদ বেশি টাকা ব্যয় করা, বেসরকারি হাসপাতালে অতিমাত্রায় কনসালটেশন ফি নেয়া, সরকারি হাসপাতালে এই টেবিল সেই টেবিলে খরচ এবং শহর এলাকায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার উপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে ব্যক্তির পকেট থেকে খরচ বেশি হচ্ছে বলে পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।
সেভ দ্য চিলড্রেন ও ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত সামপ্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯৭ সালে বছরে স্বাস্থ্যখাতে সরকারের মোট ব্যয়ের ৩৭ শতাংশ খরচ করলেও এখন ব্যয় করছে মাত্র ২৩ শতাংশ। স্বাস্থ্যের জন্য ৬৭ শতাংশ খরচ করে ব্যক্তি নিজের পকেট থেকে। বাকি ১৪ শতাংশ দাতাসহ অন্যরা। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বাস্থ্যসেবার জন্য বছরে মাথাপিছু কমপক্ষে ৮৬ মার্কিন ডলার খরচ করা দরকার। অথবা জিডিপির ৫ শতাংশ। প্রতিবছর বাংলাদেশে মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় বছরে ৩৭ ডলার। ‘বাংলাদেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা: কর্মকাণ্ড, চ্যালেঞ্জ, সুপারিশ ও প্রতিশ্রুতি’ বিষয়ক ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, গ্রাম ও শহর এলাকায় মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েছে। অর্থনৈতিক, শিক্ষা এবং ভৌগোলিক কারণেও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। বিনামূল্যে মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য নীতি প্রয়োজন। গবেষণায় সুপারিশে বলা হয়, ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ (ইউএইচসি) অর্জন করতে হলে এক্ষেত্রে সরকারের ব্যয় বাড়াতে হবে। ব্যক্তি নিজের পকেট থেকে ব্যয় কমানোর বিষয়ে জোর দিতে হবে। হেলথ সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট বাড়াতে হবে। দুর্গম এলাকাকে চিহ্নিত করে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে হবে। দেশের সীমানার মধ্যে সবার কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছাতে হবে।
স্বাস্থ্যসেবার পেছনে ব্যয় প্রতিবছর বিশ্বের প্রায় ১০ কোটি মানুষকে চরম দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। চলতি মাসে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা দু’টির প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দৈনিক ২ ডলারের কম অর্থের ওপর নির্ভরশীল হতদরিদ্র ও সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে থাকা মানুষেরা স্বাস্থ্যসেবা এবং খাদ্য ও শিক্ষাসহ সংসারের অন্যান্য প্রয়োজনের মধ্যে যে কোনো একটিকে বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সারা বিশ্বের ১২ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ স্বাস্থ্যসেবার ব্যয়ের কারণে দৈনিক ৩ ডলারের সামান্য কিছু বেশি অর্থ দিয়ে জীবনধারণ করতে বাধ্য হচ্ছে। ২০০০ সাল থেকে এ সংখ্যা বছরে ১৮ লাখ করে বেড়েছে। দৈনিক ৩ দশমিক ১০ ডলারে জীবন ধারণ মাঝারি দারিদ্র্যসীমা ধরা হয়। মোট ৮০ কোটি মানুষ তাদের পারিবারিক বাজেটের ১০ শতাংশের বেশি সাধ্যের অতীত স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় হিসাবে খরচ করে এবং এসব ব্যয় বীমা সেবার বাইরে।
বিশ্বব্যাংক গ্রুপের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যাবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক টিমোথি ইভান্স বলেন, সবচেয়ে দরিদ্র এক-পঞ্চমাংশ পরিবারের মাত্র ১৭ শতাংশ নারী পর্যাপ্ত মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য সেবা পেয়ে থাকে। এর বিপরীতে এক-পঞ্চমাংশ ধনী পরিবারগুলোর ৭৪ শতাংশ নারী এ সেবা গ্রহণের সুযোগ পায়। এ পরিস্থিতি কেবল বিশ্বের দরিদ্র অঞ্চলেরই সমস্যা নয় বরং সব দেশের সব আয়স্তরের জন্যই এটি সমস্যা। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা কভারেজ কেবল উন্নত স্বাস্থ্যের বিষয় নয়। বাস্তবতা হলো, যতক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বের কোটি মানুষ স্বাস্থ্যের পেছনে ব্যয়ের কারণে দরিদ্র হয়ে পড়ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য নিরসনে আমাদের সমন্বিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে (এসডিজি) পৌঁছাতে পারব না। বিশ্বব্যাংক ও ডব্লিউএইচওর লক্ষ্য, পরিবেশ-পরিস্থিতি নির্বিশেষে বিশ্বের সব মানুষকে অর্থকষ্টের ঝুঁকি ছাড়া স্বাস্থ্যসেবায় নিয়ে আসা। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা জাতিসংঘের এসডিজির অন্যতম লক্ষ্য হলেও, স্থানীয় সরকারগুলোর দৃঢ়প্রত্যয় ছাড়া এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। প্রতিবেদন অনুসারে, সারা বিশ্বের মধ্যে সামর্থ্যের বেশি স্বাস্থ্য ব্যয়ের কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার হার এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি। পারিবারিক বাজেটের ২৫ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবার পেছনে ব্যয় করা ৭২ শতাংশ মানুষ এশিয়ায় বসবাস করে। স্বাস্থ্যসেবার পেছনে ১০ শতাংশের বেশি পারিবারিক বাজেট ব্যয় করা মানুষের হার সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে আফ্রিকা অঞ্চলে।

No comments

Powered by Blogger.