সৌদিই ব্যতিক্রম by রোকনুজ্জামান পিয়াস

ব্যতিক্রম শুধু সৌদি আরব। মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটিতে চলতি বছর রেকর্ডসংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী গেছেন। এছাড়া অন্যদেশগুলোতে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য কাজের পরিসর ছোট হয়ে আসছে। কুয়েত আর মালয়েশিয়া ছাড়া অন্য  সব দেশে কমছে বাংলাদেশি কর্মী প্রেরণ। এর প্রভাব পড়েছে রেমিটেন্সেও। এছাড়া কিছু দেশে কর্মী গেলেও কাজ না থাকায় অনেকে বেকার সময় কাটাচ্ছেন।
শ্রমবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছে বাংলাদেশের শ্রমবাজার এখন বড় এক চ্যালেঞ্জের মুখে। যদিও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় বলছে, এ বছর রেকর্ড সংখ্যক কর্মী বিদেশে গেছেন। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত বিদেশে কর্মী গেছেন ৯ লাখ ৩১ হাজার ৮৩২ জন। ১৯৭৬ সালে বিদেশে বাংলাদেশি কর্মী প্রেরণ শুরু হওয়ার পর সংখ্যার দিক থেকে এখন পর্যন্ত এটিই সর্বোচ্চ। এর আগে ২০০৮ সালে কর্মী গিয়েছিলো ৮ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫ জন।
সংখ্যার দিক থেকে অতীতের রেকর্ড ছাড়ালেও এক দেশনির্ভর হয়ে পড়েছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ খাতটি। সৌদি আরব ছাড়া প্রায় সকল দেশেই শ্রমবাজারে ধস নেমেছে। মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটিতে এ যাবৎকালের মধ্যে এবার সর্বোচ্চ কর্মী গেছে। গত নয় মাসে সেখানে কাজের সন্ধানে গেছে ৫ লাখ ১৩ হাজার ৮৬২ জন। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, এই বাংলাদেশি কর্মীদের একটি অংশ বেকার হয়ে পড়েছেন। কাজ না থাকার পরও মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সৌদি আররে কর্মী পাঠানো হচ্ছে এমন অভিযোগ আসছে দীর্ঘদিন থেকেই। চলতি বছরের কর্মী প্রেরণের হার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সৌদি আরবে কর্মী প্রেরণ অস্বাভাবিক হারে বাড়লেও বেশিরভাগ দেশেই কমেছে। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে ১৬৩ দেশে কর্মী পাঠানো হচ্ছে এমন ঘোষণা দিলেও বাস্তবে কোনো অগ্রগতি নেই।
সূত্র মতে, এ বছর কর্মী পাঠানো হয়েছে ৯৭টি দেশে। যার মধ্যে ৩৮টি দেশে কর্মী গমনের সংখ্যা ১ থেকে ৯ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এদিকে কর্মী প্রেরণের সংখ্যা বাড়লেও ধস নেমেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে। গত বছরের তুলনায় এ বছর আড়াই লাখ কর্মী বেশি বিদেশ গেছেন। এর বিপরীতে রেমিটেন্স এসেছে ১ হাজার মিলিয়র ডলার কম। অন্যদিকে আফ্রিকার মতো অতি দরিদ্র দেশেও কর্মী পাঠানো হয়েছে। সুদান, সোমালিয়ার মতো দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করা দেশে কর্মী পাঠানোয় সংশ্লিষ্ট মহলে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সবমিলে চ্যালেঞ্জের মুখে বাংলাদেশের শ্রমবাজার। এ অবস্থায় আজ ১৮ই ডিসেম্বর পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবস-২০১৭। এ উপলক্ষে গতকাল দুপুরে ইস্কাটনের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। এতে তিনি এ খাতে সরকারের নানা অর্জন তুলে ধরেন।
সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী বলেন, চলতি বছরে প্রায় ১০ লাখের অধিক কর্মী বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। যা বাংলাদেশে অভিবাসন খাতের এযাবৎ কালের সর্বোচ্চ সংখ্যক। তিনি বলেন, এ বছর আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ হতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মোট ৯ লাখ ৭৩ হাজার কর্মীর বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ১৮ হাজার মহিলা কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে।
এদিকে বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শুধুমাত্র সৌদি আরব ছাড়া প্রায় সবগুলো দেশেই কর্মী প্রেরণের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। বিএমইটির পরিসংখ্যান মতে, এ বছর নভেম্বর পর্যন্ত ওমানে কর্মী গমনের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। এ বছর দেশটিতে কর্মী গিয়েছিলো ৮৩ হাজার ১৬ জন। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৮৮ হাজার ২৪৭ জন। কাতারে গেছে ৭৭ হাজার ১৪৫ জন যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৬০ হাজার কম। বাহরাইনে গত বছর গিয়েছিলো ৭২ হাজার ১৬৭ জন। এ বছর নেমে দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজারে। লেবাননে গত বছর কর্মী যায় ১৫ হাজার ৯৫ জন। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত একই দেশে গেছে ৭ হাজার ৪০৭ জন। জর্ডানে কর্মী প্রেরণ ২৩ হাজার ১৭ থেকে নেমে গেছে ২০ হাজারে। সিঙ্গাপুরে ৫৪ হাজার ৭৩০ জন থেকে নেমে গেছে ৩৮ হাজারে। এভাবে বিশ্বের নানা প্রান্তে যেসব দেশে বাংলাদেশের কর্মীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে তার প্রায় সবক’টিই সংকুচিত হয়ে এসেছে। তবে মালয়েশিয়ায় গত বছরের তুলনায় এ বছর কর্মী প্রেরণ কিছুটা বেড়েছে।
এদিকে সৌদি আরবে কর্মী প্রেরণের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় সেদেশে বেকার হয়ে পড়ছে বাংলাদেশিরা। সমপ্রতি সৌদি আরব থেকে ফিরে আসা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তাও বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, দেশটিতে ফ্রি ভিসার নামে যারা গেছেন, তাদের প্রায় সবাই বেকার অবস্থায় দিন পার করছেন। এছাড়া আর্থিক মন্দার কারণে বিভিন্ন কোম্পানি থেকেও তাদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। এদিকে কর্মহীন কর্মীদের বেশ কয়েকজন জানান, কতিপয় রিক্রুটিং এজেন্সি শুধু টাকার লোভে কাজ না থাকা সত্ত্বেও প্রলোভন দিয়ে সৌদি আরব পাঠাচ্ছে। বেকার কর্মীদের কয়েকজন জানান, ‘আমেলে মনজিল’ ভিসা বা বাসাবাড়ির কাজ নিয়ে অনেকেই সৌদি আরব আসছেন। কিন্তু তাদের কেউই কাজ পাচ্ছেন না। কর্মীরা জানান, নির্দিষ্ট এই ভিসার কারণে বাসাবাড়ির বাইরে তাদের কাজ করার সুযোগ নেই। ফলে তাদেরকে অন্য কোথাও কাজ করতে দেখলে পুলিশ ধরে দেশে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু অনেকে ভিটেমাটি বিক্রি করে আসায় কষ্ট হলেও পালিয়ে বেড়ায়। এছাড়া ফ্রি ভিসার নামে গিয়েও হাজার হাজার কর্মী কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। তারা আরো বলেন, ‘আমেলে মনজিল’ ভিসায় গিয়ে সংশ্লিষ্ট মালিকের বাসায় কাজ তো পাওয়াই যায় না, উল্টো প্রতিবছর তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতে হবে। তাদের অভিযোগ সেদেশে কাজ তো নেই-ই বরং আগে থেকে অনেকেই যারা কাজ করতো তাদের ছাঁটাই করে দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে কর্মী প্রেরণ করা হচ্ছে দারিদ্র্য সীমার নিচেই বাস করা আফ্রিকার দেশ সোমালিয়া ও সুদানেও। জনশক্তি রপ্তানি ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) ছাড়পত্র নিয়ে সুদান গেছে, ১৫৭৪ জন। অন্যদিকে সোমালিয়ায় পাঠানো হয়েছে ১০৪ বাংলাদেশি কর্মীকে।
রেমিটেন্স কমেছে: কর্মী প্রেরণের সংখ্যা বাড়লেও রেমিটেন্স কমেছে এ বছর। চলতি বছরের গত ৯ মাসের বিএমইটির তথ্যমতে, এ বছর প্রায় ২ লাখ কর্মী বেশি বিদেশে গেছে। গত বছর ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩১ জন প্রবাসী কর্মী রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন ১৩ হাজার ৬০৯ দশমিক ৭৭ মিলিয়ন ডলার। আর চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ৯ লাখ ৩১ হাজার ৮৩২ জন কর্মী রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন ১২ হাজার ৩৫৯ দশমিক ৬৬ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বছর শেষে রেমিটেন্স ঘাটতি দাঁড়াবে প্রায় ১ হাজার মিলিয়ন ডলার।
এদিকে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস উপলক্ষে আজ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থা নানা কর্মসূচি পালন করেছে। গতকাল মন্ত্রণালয় প্রবাসী ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি তুলে ধরা হয়। মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি জানান, অভিবাসী দিবসটিতে প্রতিটি জেলায় র‌্যালি, আলোচনা সভার পাশাপাশি সচেতনতা সৃষ্টিমূলক প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাজধানীতে আজ সকাল ৮টায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা থেকে মূল র‌্যালি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) যাবে। সেখানে সকাল সাড়ে ৯টায় আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি থাকবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। প্রবাসী কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি মতবিনিময়, অভিবাসী মেলা-২০১৭, অভিবাসন বিষয়ক গম্ভীরা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হবে। দিনের ২য় ভাগে বিকাল ১৫টা ১০ মিনিটে ‘সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করা সম্ভব’ বিষয়ক বিতর্ক প্রতিযোগিতা। বিকাল ৪টা ১৫ মিনিটে চিত্রাঙ্কন, রচনা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও অভিবাসী মেলায় নির্বাচিত সেরা স্টলের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। বিকাল ৪টা ৫০ মিনিটে দ্বিতীয় পর্বের প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখবেন মো. ইসরাফিল আলম, এমপি।

No comments

Powered by Blogger.